যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান মুখোমুখি

133

জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে একটি খবরে সমস্ত, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র তথা সারা বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এমন কি জাতিসংঘও উদ্বিগ্ন। ইরানের শীর্ষ জেনারেলদের অন্যতম কাসেম সোলাইমানি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার ঘটনায় নতুনভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু হয়েছে। কারণ এই ভয়াবহ ঘটনার পর ইরানের শীর্ষ নিরাপত্তা কাউন্সিল কোন রাখ-ঢাক ছাড়াই পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছে সঠিক সময়ে এবং সঠিক জায়গায় এ হত্যার যথোপযুক্ত প্রতিশোধ নেওয়া হবে। ইরানের নিরাপত্ত কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনী। এই ঘটনা আকষ্মিক হলেও আশ্চর্যজনক বা অপ্রত্যাশিত ছিলনা। কারণ এর দু’দিন আগে ইরান কর্তৃক পরিচালিত পি.এম.এফ (Popular Mobilization Forces) ইরাকে অবস্থিত মার্কিন দুতাবাসে হামলা চালিয়ে ছিল। বরং সবচাইতে আশ্চর্যজনক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কংগ্রেস কমিটিকে অন্ধকারে রেখে, উক্ত কমিটির সম্পূর্ণ অজান্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের দায়িত্বেই এই হামলার হুকুম দিয়েছিলেন। এক বিবৃতিতে হাউসের পররাষ্ট্র সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান ইলিয়ট এঞ্জেল বলেছেন কংগ্রেসকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এরকম একটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বিরাট একটি আইনী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং সরকারের অংশ হিসেবে কংগ্রেসের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা প্রত্যাহার করার আহবান জানিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসকে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের নির্বাচিত সিনেটের টিম কেইন। ইরানী জেনারেল কাসেম সোলাইমানি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার পরক্ষণেই তিনি এক টুইট বার্তায় বলেছেন ২০১৫ সালে ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত পরমাণু সমঝোতা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং ইরানের সাথে আবার সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় আমরা মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে গেছি। তার মতে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার সাথে সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা দূরে সরে যাবে এবং শত্রুরা জোট পাকানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যাবে।
আসলে ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রগুলি শত অনুরোধ সত্ত্বে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সাথে ৬ জাতির (পি৫+১) সাথে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত চুক্তি থেকে বের করে নিয়ে আসার পর থেকেই ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছিল। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া এবং চীন। বাকী পাঁচ সদস্য এখনও কায়মনোবাক্যে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত সেই চুক্তি টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ওবামা। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী তখনও ছিলেন বর্তমানের নেতানিয়াহু, যিনি ছিলেন এই চুক্তির ঘোর-বিরোধী। তিনি তখন আমেরিকার শক্তিশালী ইহুদি লবী পর্যন্ত ব্যবহার করে এই চুক্তি বানচাল করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি সক্ষম হন নাই। ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমেরিকার ইহুদী লবী ভীষণ শক্তিশালী হয়ে উঠে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ের জামাতা একজন ইহুদী এবং তিনি বর্তমানে হোয়াট হাউসে প্রেসিডেন্টের শক্তিশালী এবং ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা। মধ্যপ্রাচ্য এবং ইসরাইলের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসাবে সবকিছু উনার মেয়ের জামাতাই দেখাশুনা করেন। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বা নিবে বলে মনে হয়না।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরানের উপর বিভিন্ন প্রকারের নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশিত শর্তে পারমাণবিক চুক্তি নবায়ন করার বহু চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু ইরানকে আমেরিকার সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসাতে সক্ষম হয় নাই। তখন থেকে ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন প্রকারের অসহনীয় অর্থনৈতিক বিধি নিষেধ আরোপ করতে থাকে। তখন ইরান আণবিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য দেশগুলিকে এব্যাপারে বারবার অবহিত করলেও তাঁরা আমেরিকার ব্যাপারে কোন উল্লেখযোগ্য এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হন নাই। ইরান ব্যর্থ হয়ে আবার আণবিক অস্ত্র তৈয়ারির কার্যক্রম শুরু করতে বাধ্য হয়। গত বৎসর যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন ইরান হরমুজ প্রণালীতে ভূ-পাতিত করেছিল, তবে ইরানের বক্তব্য হলো সে ড্রোন ইরানী ভূমিতে প্রবেশ করেছিল। হতে পারে ইরানের জেনারেল সোলাইমানি একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, তার অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাশক্তি ও সুসভ্য দেশ হয়ে তৃতীয় একটি দেশে চোরাগুপ্তা পথে তাকে হত্যা করার অধিকার রাখে। এতে যে ভবিষ্যতে বিশ্বের জন্য একটি অতীব নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমেরিকার পেন্টাগন এই হত্যাকার পর একটি বিবৃতি দিয়েছে যাতে বলা হয়েছে জেনারেল সোলাইমানি ইরাকে এবং সারা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সদস্য এবং কূটনৈতিকদের হত্যার করার একটি গোপন পরিকল্পনা করেছিলেন এবং শুধু সে পরিকল্পনা নস্যাৎ করার জন্য এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এই ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবাদিকদের সাথে একটি বিবৃতি দিয়েছেন তাতে তিনি বলেছেন, ‘Soleimani had been assassinated to stop war not to start war.’ অর্থাৎ সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়েছে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য, যুদ্ধ শুরু করার জন্য নয়। এর উত্তরে ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র বলেছেন, ‘The legal, Political, security and military consequences of this crime is on the U.S. Govt.’ ‘এই অপরাধের আইনত; রাজনৈতিক, সামরিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্ত দায়-দায়িত্ব মার্কিন সরকারের উপরই বর্তায়।’ এদিকে ইসরাইল ও তাদের সেনাবাহিনীকে সতর্কতামূলক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সোলাইমানিকে হত্যার পর একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এই অঞ্চলে যতগুলি যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী যুদ্ধংদেহী মনোভাবসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশ রয়েছে, তাদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো একটি অকল্পনীয় পরিবর্তন অতিদ্রুত এসেছে। তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যেকোন মূল্যের বিনিময়ে তারা সম্মিলিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিরস্মরণীয় হয় মতো একটি পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইরানের জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করার জন্য ইরাকের মাটি ব্যবহার করে আমেরিকা ইরাকের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করেছে এবং এতে একথা প্রমাণিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য করেনা বরং ইহাকে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত রাষ্ট্রই মনে করে। এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য কোন রাষ্ট্রই বরদাস্ত করতে পারে না। ইরাকের মতো শত শত বৎসরের পুরোনো একটি সভ্যতা, ইহা সহ্য করার প্রশ্নই আসেনা। ইতিমধ্যেই ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদিল আব্দুল মাহদি বলেছেন, ‘ইহা ইরাকের সার্বভৌমত্বের উপর হামলা। যাই হউক গত ৮/১/২০২০ এ ইরাকের মার্কিন বিমান ঘাঁটির উপর ২২টি ব্যালিষ্টিক মিসাইল ছেড়ে কাসেম সোলাইমানি হত্যার জবাব দিয়েছে ইরান। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলে ইরবিল ও আইন আল-আসাদে অন্তত: দু’টি মার্কিন স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন ঘোষণা করেছেন।
এদিকে ইরানের পর-রাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এক টুইট বার্তায় বলেছেন ‘ইরান জাতিসংঘের ৫১ ধারা অনুসরণ করে তার আত্মরক্ষায় যথাযথ জবাব দিয়েছে এবং জবাব দেওয়া শেষ হয়েছে। তিনি আরও বলেন আমরা পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত করতে চাইনা বা যুদ্ধ চাইনা কিন্তু আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করব।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও সুর পাল্টিয়ে দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় দেশগুলিসহ প্রায় দেশ ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এমনকি জাতিসংঘও এর তীব্র সমালোচনা করতে পিছ পা হয় নাই। বিশ্ব জনমতের চাপে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সুর পাল্টিয়ে দিয়েছেন বলে মনে হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন ইরানের বিরুদ্ধে অনর্থক সামরিক শক্তি প্রয়োগ করার কোন প্রয়োজন নেই। সাথে সাথে ইরানের সঙ্গে কোন শর্ত ছাড়া আলোচনার দ্বার খোলা আছে বলে জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য ইরান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। পরিস্থিতি একটু বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, উভয় দেশের (ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র) অবস্থা এমন যে, ‘আবার সাধিলে খাইবে’। শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষ সাধিলে উভয়ের সম্মান রক্ষা হয়। কিন্তু আজকের বিশ্বের বড় দুর্ভাগ্য হলো, যেসব দেশ বিশ্ব-শান্তির উদ্যোগ নিলে অবশ্যই বিশ্ব-শান্তি কায়েম হবে, সেসব দেশের নেতাদের বিশ্ব শান্তির চাইতে অস্ত্র বিক্রয়ে দিকে ঝোঁক বেশি। কারণ এতে আপাতত: দেশেরও লাভ এবং নিজেরও লাভ।

লেখক : কলামিস্ট