446

[ গত সংখ্যার পর ]
একটা কথা আছে বিধি কৃপা কর তুমি একটু নচচর।’
‘জয়তুন শোন। আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দে। আমি যা কই, তাই কর। তোর ঘরে তো পোলাপান হইল না। অইবোও না। বিয়া শাদি আর করমু না আমি। তোরে নিয়াই সংসার করমু।’
মনুর কথায় জয়তুনের ভেতরটা তিড়িংবিড়িং করে নেচে ওঠে খুশিতে। বাচ্চা না হওয়ার জন্য অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয় তাকে। মার খেতে হয়। জয়তুন অবাক হয়ে মনুর দিকে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে ঝিলমিল করে হাসি।
‘জয়তুন, তোর সাথে অনেক খারাপ আচরণ করছি।’ জয়তুনের হাতটা নিজের হাতে পুরে নিয়ে মনু বলে, ‘আমারে মাপ কইরা দিস। আবার নতুন কইরা সুখের সংসার করবার চাই। তুই আমার কতা শুনবি?’
জয়তুন মনুর মুখে এমন কথা আগে কখনো শোনেনি। আকাশের চাঁদ যেন জয়তুনের ঘরে নেমে এসেছে। দীর্ঘ সাত বছরে বিবাহিত জীবনে এমন মুহূর্ত কল্পনাও করতেও পারেনি সে। তাই তো জয়তুন আহ্লাদে গলে যায়। ‘তুমি যা কইবা সব শুনমু।’
জয়তুনের ঘাড়ে হাত রেখে মনু বলে, ‘এত বড়ো একটা সুযোগ পাইছি। এইডা হাতছাড়া করন যাইবো না। সব ট্যাহা রূপী দিব। শুধু বিমানভাড়া আমায় দিতে অইবো। যদি বাপের বাড়ি থিকা হাজার তিরিশ ট্যাহা আনবার পারস। বাকি ট্যাহা আমি ঋণ করমু।’
এ কথা শুনে জয়তুন আলাভোলা হয়ে যায়। বলে, ‘বাজানের তো ট্যাহা দেওনের ক্ষমতা নাই। তাও বাজানের কাছে গিয়া কই।’
‘জয়তুন কাইল বাপের বাড়ি যাইবি।’
এককান-দুকান করে জয়তুনের বিদেশ যাওয়ার খবর সারা গ্রামে রটে যায়। গাঁয়ের মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে আজেবাজে কথাও বলতে থাকে।
জয়তুনের বাপের বাড়ি কয়েক গ্রাম পর। গ্রামের নাম, জগরমান। লাল টকটকে একটা শাড়ি পরে মাথায় প্রিন্টের ওড়না পেঁচিয়ে ছাতা মাথায় সে চলে জগরমানের উদ্দেশে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর, দুপুরের খাঁখাঁ রোদে এসে দাঁড়ায় বাবার বাড়ির উঠানে।
জয়তুনের মা ছালেতন মেয়েকে দেখে আঁতকে ওঠে, ‘আরে গেদি তুই? এই ভরা দুপুরে? রৌদে বাইরে পা দেওন যায় না। কোনো খবর দিলি না যে?’ জয়তুনকে ঘরের মেঝেতে বসিয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করে ছালেতন। ‘গেদি কোনো খারাপ খবর? মুনডা বেজার ক্যা?’
‘মা, বাজান কই?’
‘তোর বাজান পুব চহে গেছে। কিছু কইবি? আমার কাছে কইয়া ফালা। তোরে দেইখা আমার ভালো মুনে হইতাছে না।’
জয়তুন মায়ের গলা জড়িয়ে বলে, ‘মা আমার ঘর যদি ঠিক রাখবার চাও, তাইলে ৩০ হাজার ট্যাহা দিতে অইবো। তা না হইলে তোমাগো জামাই আমারে তালাক দিব।’
‘৩০ হাজার ট্যাহা? কই পাইমু? তোর বাজান কামলা খাটে। জমি-জিরাতও নাই। এই ভিটা ছাড়া আর তো আমগো কিছুই নাই।’
‘মা, তোমাগো জামাই আমারে বিদেশ পাঠাইবো। আমি বিদেশে চাকুরি কইরা অনেক ট্যাহা পাঠাইমু।’
‘তওবা-তওবা! কী কস? তওবা পড়। মরতে অইবো না? এই দুনিয়া কয় দিনের? এমুন নাফরমানি কাম তুই করবি? তুই শ্বশুরবাড়ি যাইবি না। আমরা বাঁইচা থাকতে তোরে বিদেশ যাইবার দিমু না। তোর বাজান আসুক। জামাইরে খবর দিবার কইমু। ম্যায়ামানুষ বিদেশ যায়? এমুন কথা তো আইজ পর্যন্ত শুনি নাই।’
ছালেতনের চিৎকার-চ্যাঁচামেচির মাঝেই নাটু হাজির। ‘জয়তুনের মাও, কী হইছে? চিল্লাচিল্লি করতাছ ক্যা?’
‘ও গেদির বাপ, এমুন সর্বনাইশা কতা তো কোনো দিন শুনি নাই। আপনার ম্যায়া কী কয়? শোনেন!’ হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় ছালেতন।
‘তুমি কান্দিতাছ ক্যা? কী হইছে? কও শুনি।’
ছালেতন চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘আপনের ম্যায়া আসচে। তার কাছেই শুনেন।’
নাটু গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে। জয়তুনের গাল বেয়ে নোনা পানির ঢল নামছে। নাটুর ভেতরটা আঁতকে ওঠে। মুখটা মুহূর্তে কালো হয়ে যায় তার। ভয়ে ভয়ে বলে, ‘গেদি কোন সুময় আইছো?’ জয়তুন উত্তর দিচ্ছে না। নাটু ভাবে, হয়তো মনু মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাচ্চা না-হওয়ায় অপরাধে মেয়েকে জামাই প্রায়ই মারধর করে, নাটু এটা জানে।
নাটু মেয়ের কাছে বসে মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘মা রে, আমার কাছে বল। জামাই কি তোরে খেদাই দিছে?’ জয়তুন মাথা নেড়ে না-সূচক জবাব দেয়। ‘তাইলে কী হইছে?’
জয়তুন আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সব বৃত্তান্ত বলে।
‘তা গেদি, ম্যায়ারা বিদেশ যায়? তারা বিদেশ গিয়া কী করব?’
‘কুহপডরার এক ম্যায়া বিদেশে থাকে, বাজান। হে বিদেশ থিকা ছুটিতে আইছে। আমাগো বাড়িও গেছাল। দেশে অনেক ট্যাহাও পাঠাইছে।’
‘কুহপডরা কার ম্যায়া?’
‘তা তো জানি না, বাজান। তোমাগো জামাই কইতে পারব।’
‘মা, আমি খবর নিয়া দেখি। তুই চিন্তা করিস না। তোর বাপ বাঁইচা আছে। ব্যবস্থা একটা অইবো।’
ছালেতন বলে, ‘আইচ্ছা তোগোর গাঁয়ের গুতু ফকির আইছল। বিহানের দিকে। অর ম্যায়ার কথা কইল। পানসির বিয়া হইছে। তয় ফকিরের শরীলডা ভালা না। তাই বই গেলো। কইলো আইজ আর গাওয়ার (ফেরি) করবো না।’
নাটু মেয়ের জামাইকে খবর দেয়। মনু এসে খুব ভক্তি সহকারে শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে।
‘জামাই, তোমার কতা আমি বুঝলাম। প্রথম কথা হইল। মানুষ কী কইবো, ম্যায়ামানুষ বিদাশ গেলে মান-ইজ্জত থাকবো? দ্বিতীয় কতা হইল, এই ট্যাহা পাইমু কই?’
মনু বলে, ‘আব্বা কুহপডরা রূপীর সাথে আমি কইছি। এদেশে মেলা ম্যায়্যরা বিদেশে গেছে। তারা ভালা চাকুরি করে। কোনো সমস্যা নাই। জয়তুন যাওনের কিছুদিন বাদে আমিও যাইমু।’
‘মনু মিয়া, তুমি তো আমার খবর জানো। তার পরও চেষ্টা কইরা দেখি।’ নাটু পান খেতে খেতে বাইরে বেরিয়ে যায়।
মনু জয়তুনকে ডেকে বলে, ‘আমি বাড়ি গেলাম। তুই ট্যাহা ছাড়া আস্লে বাড়ি উঠাইমু না।’
পানসি স্বামীর বাড়ি গেছে বেশ কিছুদিন হলো। পুতি আর পাতা উঠানে বসে আছে। ছাগলটা বাহিরবাড়ি নিমগাছের সঙ্গে বাঁধা। ম্যা-ম্যা করে ডাকছে। দুধজান কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। বহিরবাড়ি বসে বাতাসে সে গা জুড়ায় কিছুক্ষণ। আষাঢ মাস। চারদিকে থইথই পানি। দুধজানের ভেতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগে। নিজে নিজেই ভাবতে থাকে, এমন লাগছে কেন? মেয়েটার কোনো সমস্যা হলো না তো? মাথার মধ্যে নানারকম দুশ্চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। এরই মধ্যে একটা নৌকা ঘাটে এসে থামে। নৌকা থেকে গুতু ফকির টালমাতাল অবস্থায় নেমে আসে।
‘কী ব্যাপার? আপনি? শরীর খারাপ? মুখটা অমন ক্যা?’ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে করতে দুধজান গুতুকে ধরে।
‘আমার ভালা লাগতাছে না, আমারে ঘরে নিয়া যাও।’
দুধজান ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে গুতুকে শুইয়ে দেয়। ভীষণ গরম। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। দুধজান পাখা দিয়ে বাতাস করে আর গুতু ফকিরের মাথার চুলগুলিতে আঙুল বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে গুতু ফকির।
দুধজান স্বামীর পাশে বসে বাতাস করতে থাকে, যাতে আরামে ঘুমাতে পারে তার স্বামী। পাতা এসে বলে, ‘মাইয়া, মনুভাইয়ের বউ বিদাশ যাইবো। বাপের বাড়ি গেছে ট্যাহার জুন্যে। মনুভাই শ্বশুরবাড়ি যাইতাছে। আমারে কইল, দোয়া করিস ট্যাহাডা জোগাড় হইলেই যাইতে পারবো।’
দুধজান নির্লিপ্ত। মেয়ের কথায় কোনো কর্ণপাত করে না সে। একা একা বকবক করে পাতা চলে যায়।
মাঝরাতে গুতু ফকিরের ঘুম ভেঙে যায়। দুধজানকে ডাকে, ‘ও বড়ো গেদির মাও, বড়ো গেদির মাও!’
দুধজান ধড়ফড় করে ওঠে। ‘কী, বলেন?’
‘আমার জানি কেমুন লাগতাছে। এক গিলাস পানি দে।’
দুধজান পানি এনে খাইয়ে দেয়। ‘বুকের ভিতরে কেমন যায় ধড়ফড় করতাছে। গেদিগো ডাকো।’
দুধজান ডাকে, ‘মাঝ গেদি, ছোটো গেদি ওঠ।’
পাতা ও পুতি হাই ছেড়ে ঘুম থেকে ওঠে। চোখ কচলাতে কচলাতে পুতি বলে, ‘মাইয়া কী হইছে?’
‘দেখ, তোর বাজান কেমুন করতাছে!’ পাতা ও পুতি দুজনেই বাপের পাশে বসে। কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। হঠাৎ গুতু ফকির বলে, ‘বড়ো গেদিরে আর দেখুম না?’ এরপর সে কী বলে তা কেউ বুঝতে পারে না। শুধু মেয়েদের হাত ধরে কী যেন বোঝাতে চায়, তা কেউ বুঝতে পারে না। পৃথিবীর জঞ্জাল থেকে বিদায় নেয় গুতু ফকির চিরতরে। চারদিক সব নীরব হয়ে যায়। দুধজানের বুকে চেপে বসে ভারী বোঝা। এই বোঝা বুকে নিয়ে হাঁটতে হবে কত যুগ, তা সে নিজেও জানে না।
মনু মিয়া শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে গুতু ফকিরের মৃত্যুসংবাদ পায়। প্রতিবেশী গুতুর কাছে প্রায়ই যাতায়াত করত সে। তাই তার মনের মধ্যে কিছুটা কষ্ট অনুভ‚ত হয়। দুধজানকে সান্ত¡না দিয়ে সে জানায়, ‘জয়তুন গুতুচাচা বলতে অজ্ঞান, অথচ সে দেখতে পারল না। জয়তুন খবরটা শুনে অনেক কষ্ট পাইবো।’
দুধজান শুধু বলে, ‘জয়তুনরে কবে নিয়া আইবা?’
‘চাচি, দু-এক দিনের মধ্যে আইবো।’
এদিকে জয়তুন সারাক্ষণ কাঁদে আর ছালেতন বকাবকি করে। এভাবে কয়েক দিন কেটে যায়। নাটু বলে, ‘মা রে, তুই জামাই বাড়ি যা। দেখি কী করন যায়।’
জয়তুন হরিপুর ফিরে আসে। জয়তুন নিশ্চয়ই টাকা নিয়ে এসেছে। দুটো স্বপ্ন পূরণ হবে। প্রথমত, জয়তুন বিদেশে যেতে পারলে মনুও স্বপ্নের দেশে গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করবে আর রূপীকে আপন করে কাছে পাবে। মনু ওকে দেখে খুশিতে এগিয়ে আসে। দেখে জয়তুনের মুখটা কালো।
জয়তুনের কাঁধে হাত রেখে আদর মেশানো গলায় বলে, ‘জয়তুন তুই ছাড়া আমার সময় কাটে না।’
জয়তুন কোনো কথা বলে না। মাথার ওড়নাটা খুলে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ে।
‘বাজান, কইছে ট্যাহা জোগাড় কইরা খবর দিব।’
‘তাইলে হইছে, বুঝছি। সোজা আঙুলে ঘি উঠব না। আঙুল ব্যাহা করতে অইবো।’ মেজাজ গরম করে উঠে যায় মনু।
জয়তুন বিকালে গুতুর বাড়ি আসে। ‘চাচি, খবরডা শুইনা খুব খারাপ লাগল। চাচামিয়ার তো তেমন কোনো অসুখ আছাল না, বালা মানুষই দুনিয়া ছাইড়া যায়।’ পানসির চোখে পানি। চোখ মুছতে-মুছতে পিঁড়ি এগিয়ে দেয় বসতে।
জয়তুন পিঁড়িতে বসে বলে, ‘বড়ো গেদি, তাও ভালো, তোমার বিয়াডা দিয়া গেছে। তা গেদি, তোমার জামাই বাড়ির খবর কী? তোমার হাশুড়ি কেমুন?’
‘ভাবি, তারা সবাই ভালা। পেট ভইরা চাইড্ডা ভাত খাবার পারি। আর কী লাগে?’ এ সময় ঠকঠক করে লাঠিতে ভর করে ধলাবুড়ি এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘বড়ো গেদি, তোর মায় কই?’
পানসি পিঁড়ি এনে দেয় ধলাবুড়িকে। উঠানের কোনো পিঁড়িতে বসে বলে, ‘বড়ো গেদি পান নিয়া আয়।’ তারপর জয়তুনের দিকে চোখ পড়তেই বলে, ‘আর এই যে মনুর বউ, তুমি আসলে একটা বেহায়া। তুমি যে কতা কও। তোমার শরম নাই। > চলবে

বেহায়াগিরি করবার যাইবা বিদেশে যাও। এই গাঁয়ে যে কয়দিন থাকবা, মাথা নিচু কইরা থাকবা।’
পানসি পান দিতে দিতে বলে, ‘ধলাদাদি, থাইক। ভাবির কী দোষ। মনুভাই-ই তো পাঠাইতাছে।’
‘আরে, রাখ। ও না গেলে কার খ্যামতা আছে পাঠায়?’
জয়তুন কাঁদো কাঁদো মুখ করে উঠে যায়। ‘ধলাদাদি, তোমার কথায় ভাবি কষ্ট পাইছে।’ বলে পানসি।
‘বড়ো গেদি, ওরা আসলে ভালা না। কী তার কষ্ট! একটা কতা আছে না, জাতের ম্যায়া কালা ভালা গাঙের পানি ঘোলা ভালা।’ একটু থেমে আবার বলে, ‘মনু বিয়া করছে আজাইত ঘরে। হেই জুন্যেই তো অভিশাপ লাগছে। মনুর বউ হইছে ভালা কথা। ওর বাপের কথা খোদা সহ্য করব কেমুন কইরা। জয়তুনের মাও আছাল দক্ষিণপাড়ার ফটুর বউ। কার্য্যা কইরা ফটু বউডারে তালাক দিছে। পরে ফটু বুঝল, তার ভুল হইছে তালাক দেওয়া। ইচ্ছা করলেই তো আর বউ ফিরায়া আনতে পারব না। ফটু গাঁয়ের মুরুব্বিগো মনের কথা জানাইল। বউ আবার ফেরত আনতে চায়। মুরুব্বিরা মসজিদের হারুন মোল্লারে নিয়া সালিশ বসে। সালিশে ফটুরে জিজ্ঞাইল, পুনরায় বিয়া পড়ানোর পর আরেক জুনের সাথে হিল্লা বিয়া অইবো। তার সাথে আড়াই দিন থাকার পর হে তালাক দিব। তার বাদে তুমি বউ ফিরা পাইবা। তুমি এতে রাজি? যদি রাজি থাকো তাইলে কার সাথে হিল্লা বিয়া দিবা তা ঠিক করো। ফটু রাজি হইলো। নাটু হইল ফটুর দোস্ত। বিয়া পড়ানোর পর ফটু বিশ্বাস কইরা নাটুর সাথে হিল্লা বিয়া দেয়। নাটুরে ফটুর বাড়ি থাকতে কইল। কিন্তু নাটু রাজি হইল না। হে আড়াই দিন পর নিয়া আইব বইলা বউরে নিজ বাড়ি জগরমান নিয়া যায়। হেই যে গেল আর আসলো না। ফটু বহুত চেষ্টা করছে, আর ফেরত পাইল না। হেই বাটপাড় নাটুর ম্যায়া জয়তুন। হের ম্যায়া আর কত ভালা অইবো।’
পুতি এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ধলাবুড়ির কথা শুনছিল। সে ধলাবুড়ির সাদা চুলগুলিতে উকুন আনতে আনতে বলে, ‘ধলাদাদি, জয়তুনভাবির বাপ-মায় কী করছে তা অনেক আগের কথা, তার সাথে ভাবির বিদেশ যাওয়া কত সৌভাগ্যের কথা। কয়জুনে পারে? ইস? আমি যদি এইরকম সুযোগ পাইতাম। তয় নাচতে নাচতে যাইতাম।’
এ কথা শুনে বুড়ির চোখ দুটি রাগে জ¦লে ওঠে, ‘এই ছেড়ি, তুই কী কস! তোর মাথা ঠিক আছে? গুতুর ম্যায়া হইয়া এমন কথা কস! বড়ো গেদি, তোর বোইনের মতিগতি ভালা না। গুতু তো মইরা গেছে। এইডা কোন হস্তিনী রাইকা গেল? তোর বোইনের মতিগতি ভালা না। গুতু তো মইরা গেছে। এইডা কোন হস্তিনী রাইখা গেল? খোদায়ই জানে।’ বুড়ি মাথা থেকে পুতির হাত সরিয়ে কাপড়টা টেনে উঠে পড়ে। রাগে লাঠি ঠকঠক করে চলে যায়।
বুড়ি রাস্তা দিয়ে যায় আর বকবক করতে থাকে। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঝিনাই নদী। এখন বর্ষাকাল। নদী পানিতে ভরপুর। রাস্তার এক পাশে বড়ো একটি শিমুলগাছ। শিমুলতলে বসে বিভিন্ন বয়সের লোক আড্ডা দেয়। কেউ কেউ নদীতে বড়শি ফেলে মাছ ধরে। শিমুলতলে ধলাবুড়ি এলে ছেলেরা প্রশ্ন করে, ‘কি গো ধলাদাদি, বকবক করতাছ কার সাথে?’
‘তুই জইনদালি না? তোর শ্বশুরবাড়ি থিকা আইলাম। তোর ছোটো শালী পাতা, বড়োই বেলেহাজ। তার কথাবার্তা, হাঁটা-চলন ভালা না।’
‘ধলাদাদি, পুতির কথা কইতাছ? পুতি কী কইছে? কও, আমি ওর বিচার করুম।’
‘আরে, ঐ যে মনু মিয়ার বউ নাকি বিদেশ যাইবো। ভালা ম্যায়ারা বিদেশ যায়? তাই কইছি। পুতি জয়তুনের পক্ষ নিয়া কথা কয়।’
‘তুমি বাড়ি যাও। আমি পুতিরে মজা দেখাইমু।’
বুড়ি চলে যাওয়ার পর ওখানে সবাই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে থাকে। কেউ বলে, ‘আরে ম্যায়ারা বিদেশ যায় দুই নম্বরি কাম করতে। মনু মিয়া একটা বেক্কল। তাই নিজের বউডারে খারাপ কামে পাঠাইবো।’

এক সপ্তাহ কেটে যায়। মনু মিয়া জানতে চায়, ‘জয়তুন, তোর বাপে তো আসলো না? আর তো সহ্য হয় না।’
জয়তুন একটু রেগেই উত্তর দেয়, ‘সহ্য হয় না? কী করবা? মারবা? মারো।’
‘হু, তা-ই করা উচিত। বদজাত, তুই তোর বাপরে আসতে না করছোস।’
‘আমার বাপের জমিদারি আছে? না দিতে পারলে আমি কি বাজানরে খুন করমু? আমি বিদেশ যাইমু না। পাড়ার মানুষ আমারে খারাপ কয়।’
‘এই বেলেহাজ? তুই আমার ঘর করস, না পাড়ার মানুষের ঘর করস? আমি যা কইমু তা-ই শুনবি।’
‘আমি তোমার কথা শুনমু না। আমারে মারো, তালাক দেও। যা খুশি করো।’
মনু মিয়ার চোখ রাগে রক্তজবার মতো টকটকে হয়ে ওঠে। হুংকার দিয়ে চুলের মুঠি ধরে দেয় মার। ইচ্ছেমতো চলে কিল-ঘুসি-লাথি।
জয়তুনের চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এসে ছাড়িয়ে দেয়। জয়তুনের চোখের ওপর জখম হয়ে ফুলে ওঠে, মাটিতে পড়ে গোঙাতে থাকে সে।
বাড়ি থেকে লোকজন চলে গেলে মনু মিয়া শ্বশুরকে খবর পাঠায় মেয়েকে নিয়ে যেতে। খবর পাওয়ামাত্র নাটু মিয়া চলে আসে। মেয়ের অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
মনু মিয়া সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, ‘কাহিন্দা লাভ নাই। ম্যায়া নিয়া যান। আমি ওরে রাখমু না।’
নাটু মিয়া জামাইর হাত ধরে বলে, ‘আগামী সাত দিনের মইধ্যে আমি ট্যাহা জুটাইমু।’
মনু মিয়া সোজা বলে দেয়, ‘ম্যায়া নিয়া যান। যদি ট্যাহা জোগাড় করতে পারেন, তয় ম্যায়া পাঠাবেন। তা নইলে দরকার নাই। এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এর মধ্যে না হইলে ওরে তালাক দিমু।’
নাটু কেঁদে কেঁদে আশ্বাস দেয়, ‘না বাজান, ও কথা কয় না। আমি ট্যাহা দিমু।’ জয়তুনকে নিয়ে চলে যায় নাটু।
ছালেতন মেয়েকে দেখে বিলাপ করতে থাকে, ‘হায় হায় রে, নিরবংশা ম্যায়ারে মাইরা ফালাইছে গো।’
জয়তুন ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। নাটু মিয়া বলে, ‘গেদির মাও, গেদির গতরে তেল ডুইলা দেও। কাইন্দো না। খোদায় আমার উপরে গজব ফালাইছে।’
বাড়ির সামনে দুই শতাংশ জায়গার দাম ৫ হাজার টাকা। বাড়ির ঘাটে বাঁধা নৌকায় উঠে নাটু মিয়া নৌকার দড়িতে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে, কী করবে। কার কাছে যাবে। দড়ি থেকে হাতটা সরিয়ে নৌকার মাঝখানে বসে। মেয়ের বীভৎস মুখটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আত্মার ভেতর শেলের মতো বিঁধতে থাকে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। ভিটাবাড়ি বিক্রি করে টাকা দেবে, তাও যদি মেয়ের সুখ ফেরত আসে। যেই কথা সেই কাজ। গাঁয়ের মহাজনের কাছে ভিটাবাড়ি ও সামনের দুই শতাংশ জায়গা বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দেয়।
জয়তুনের বুকের ভেতর ভ‚মিকম্প আঘাত হানতে থাকে। তার বাবা-মা কোথায় দাঁড়াবে?
নাটুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাজান এইডা তুমি কী করলা? আমারে তালাক দিলে দিত। ভিক্ষা কইরা খাইতাম। তোমাগো পথে বসাইয়া আমার সুখের দরকার নাই। তুমি ট্যাহা ফেরত নেও।’
নাটু মিয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দেয়, ‘মা রে, আমরা একটা ব্যবস্থা করমু। তুই যদি সুখে থাকস, তাইলে পথে পথে ঘুইরাও সুখ পাইমু। যা মা। বিদেশে যাওনের তারিখ হইলে খবর দিস।’
জয়তুনের ভেতরে জলোচ্ছ¡াস উথলে উঠেছে। চোখ দিয়ে উপচে পড়ছে বড়ো বড়ো ঢেউয়ের লোনা জল। পেছন ফিরে বাবা-মায়ের নীড়হারা চেহারা বারবার দেখে নেয়।
জয়তুন ঘরে ঢুকে টাকার পোঁটলাটা ছুড়ে দেয় মনু মিয়ার দিকে। মনু মিয়া খুশিতে টাকাটা তুলে নিয়ে বলে, ‘সোজা আঙুলে কাম হয় না। আঙুল ব্যাহা করাতে টাকা ঠিকই আসছে। আমি আজই রূপীর কাছে যাইমু।’ টাকার পুঁটুলিটা কোঁচড়ে গুঁজে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মনু। জয়তুন চেয়ে থাকে মনু মিয়ার গমনপথের দিকে। নিজেকে মনে হয় গহিন অরণ্যে হারানো পথিক। নষ্ট পচা কুমড়োর মতো সে গলিত জীবন নিয়ে পাষÐ মনু মিয়ার ঘরে পড়ে আছে।
মাঠের সবুজ শস্যের দিকে চোখটা মোড় নেয় তার। লম্বা লম্বা পাটগাছগুলো যেন খেমটানাচে মত্ত। খেতের মধ্যে বর্ষার টলটলে হাঁটুজল। সেই জলে ব্যাং লাফালাফি করতে থাকে। হঠাৎ একটা সাপ ব্যাংটাকে ধরার জন্য ধাওয়া দেয়। ব্যাংটা প্রাণপণে ছুটতে থাকে। সাপটা অনেক চেষ্টার পরও ব্যাংটাকে ধরতে পারে না। ব্যাং জয়ী হয়। ঘরের পাশে কড়ইগাছে কাঠঠোকরা কাঠ খোদাই করতে থাকে। তার লম্বা চিকন ঠোঁট দিয়ে অনেক্ষণ ধরে ঠোকর মারতে থাকে। বেশ বড়ো গর্তও করে ফেলে।
দুটো দৃশ্য অবলোকন করার পর নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন টের পায় জয়তুন। প্রতিশোধের মত্ত মাদল বেজে ওঠে ওর বুকে। চোখের জল মুছে ফেলে সে। নিজেকে তৈরি করতে হবে শক্ত করে। মনু মিয়া তার ওপর অনেক অত্যাচার করেছে। বিদেশে গিয়ে টাকা রোজগার করবে সে। মনু মিয়া তার কাছে হাত পাতবে। তখন মনু পরাজিত হবে আর সে নিজে হবে জয়ী।

রূপী মনু মিয়াকে দেখে একটা হাসি দেয়। ‘দোস্ত, জানি তুমি পারবে। বলেছিলাম না? ইচ্ছা।’ টাকা হাতে নিয়ে কাব্যিক ঢঙে বলে সে, ‘তুমি আমার ভালোবাসার লীলাভ‚মি। তোমার সুখ আমার সুখ। এক মাসের মধ্যে জয়তুনের সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি জয়তুনকে আমার সঙ্গেই নিয়ে যাব। অন্য কেউ হলে এমনিই পাঠিয়ে দিতাম। তোমার বউ, তাই ওকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব।’
‘রূপী, বিদেশ গিয়া আমারে ভুলবা না তো!’
‘মনু, কী যে বলো। তোমার জন্য এত তাড়াহুড়া করছি। তোমাকে কত তাড়াতাড়ি আমার কাছে নিতে যেতে পারব, সে চেষ্টায়ই থাকব।’
‘পথহারা পথিক হয়ে সব হারিয়ে ঘুরপাক খেয়ে পড়ে আছি। রূপী, একটা বিষয় পরিষ্কার করবা?’
‘কোন বিষয়?’
‘জয়তুন যদি আমারে বিদেশ নেয়, তাইলে আমি কি তোমার কাছে বইতে পারমু?’
‘মনু তুমি একটা গাধা। সহজ ব্যাপার, তোমারে তো নেব আমি। বিদেশ গিয়ে জয়তুনরে তালাক দিবা। সব ঝামেলা শেষ।’
‘তোমার কথার শান্তি পাইলাম। রূপী, তোমার জন্য আমার শিরা-উপশিরা ধমনিতে রক্ত টগবগ করে। এতদিন আমার প্রেম আছিল আন্ধারে। অকন তোমার ভালোবাসার ছোঁয়ায় দেহের সোনালি শিকল খুইলা গেছে, স্নিগ্ধ অন্ধ পিরিতের সুবাস ছড়াইয়া গেছে সবুজ শ্যামল বাংলার মাঠে ঘাটে। অন্তরের তার ছিঁড়া আসমান জুইড়া ছড়াইয়া পড়ছে ভালোবাসার নীল রং।’
‘বাহ্! মনু, তুমি তো কবি হয়ে গেছ। তোমাকে ভোলা সম্ভব নয়। মনু, মাটির সিথানে আমার ধূপ-চন্দনের পাপ, রক্তে আসমানের কালো রং, কলঙ্ক মিশ্রিত চাঁদের পূর্ণিমাহীন অন্তপুরে শুধু তুমি, শুধু তুমি,’ বলতে বলতে কেমন রহস্যময় হাসি হাসে রূপী।
‘রূপী, পিরিতের বাক্স আপাতত তুইলা রাখো। বাকি ট্যাহা কেমনে জোগাইমু?’
‘মনু, দেখো। আমি তো আছি। তোমার ব্যাপার আলাদা। তোমার কাছে আমার হৃদয়-মন সব জমা রেখেছি। মনু, তুমি আর একটা কাজ করবে। সেটা হলো, আমি যাওয়ার পর আরো কয়েকটা মেয়ে ঠিক করে দেবে। এতে তোমার লাভ হবে। তাদের বেলায় এক লাখ টাকা লাগবে। প্রতিজনে তুমি পাবে বিশ হাজার টাকা। তোমার গাঁয়ে পাতা নামে একটা মেয়ে আছে না?’
‘হু, গুতুচাচার ছোটো ম্যায়া।’
‘মেয়েটা অনেক স্মার্ট। এই ধরনের মেয়েরা বিদেশ গেলে অনেক ভালো করতে পারবে। আরেকটা মেয়ে দেখেছি, আমেনা।’
‘হু, আয়জানের ম্যায়া। ওর মায়রে তালাক দিছে। আয়জান ম্যায়াডা নিয়া কী যে কষ্ট করে। আমেনার বাপ চোর। জায়গায়-জায়গায় চুরি করে। আবার ধরাও পড়ে মাইর খায়। চোরায় আয়জানরে তালাক দিয়া আরেকটা বিয়া কইরা বউ নিয়া নিরুদ্দেশ।’
রূপী মনে মনে ভাবে, তাহলে বড়শি ফেললে গিলবে। আমেনা ও পাতা মেয়ে দুটো অনেক সুন্দর। লম্বাও আছে।
‘রূপী, এত মনোযোগ দিয়া কী ভাবতাছ?’
‘না, কিছু না।’
‘তাহলে আমি উঠি।’

রাতে জয়তুন ও মনু শুয়ে আছে। মনু জয়তুনের উদ্দেশে বলে, ‘ঘুমাই গেছ?’ জয়তুন ‘না’ সূচক উত্তর দেয়।
‘রূপী পুতি ও আমেনার কথা কইল। ওরা বিদেশ যাইতে পারে। কী কও?’
‘কুষ্টার গহরের সাথে আমেনার বিয়ার কথা চলতাছে।’
‘জয়তুন, গহর বিয়া করবো না। আমি জানি। আমারে কইছে একজুনরে মনের ভিতর জায়গা দিছাল। সেই মাইয়া তারে হিট দিছে। তাই শপথ করছে কোনো দিন বিয়া করবো না।’

বিজন রাতে ছোট্ট মাটির ঘরের দাওয়ার বাঁশি বাজায় গহর। তার বাঁশিতে বেদনার সুর বেজে ওঠে। সে সুর ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকারে শুয়ে থাকা মাটির উদোম শরীরে। সে বিরহের বিষণœ সুর বর্ষার জলে ভেসে গিয়ে পৌঁছায় পানসির মাটির পইঠায়।
বিরহিণী পানসি হৃদয় ব্যথাতুর সুরের গাঙে উথাল-পাথাল করে। গভীর রাতে ভেঙে পড়ে সবকিছু সেই ব্যাকুল বাঁশির টানে। চারদিকে চেয়ে দেখে রুক্ষ জল।
গহর উঠে দাঁড়ায়। ‘ক্যারা গো তুমি’ বলতেই গাছের আড়ালে লুকোয় ছায়ামূর্তি। গহর গাছের কাছে গিয়ে দেখে, এদিকে-সেদিক দেখে, না কোথাও নেই। এই মেয়েটা প্রায়ই তার সামনে এভাবেই লুকোচুরি খেলে।
গহর অবশ্য এতে ভয় পায় না। রহস্যটা খুঁজে বেড়ায়। এই রহস্য অনুসন্ধান করেই কেটে যায় তার সময়।
আজও গভীর রাতে গহরের ঘুম ভেঙে যায়। প্রতি রাতে এ সময় দুটি হিয়া কল্পনার রথে চড়ে বেড়ায়Ñ কত ভ্রমণ, কত গল্পÑ পানসি আর গহর। ধড়মড় করে উঠে হাতড়িয়ে বাঁশিটা খোঁজে। অন্ধকার! বাঁশিটা তার সিথানেই থাকে। হাত দিলেই পেয়ে যায়। কিন্তু আজ খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ সেই নারীমূর্তি বাঁশিটা গহরের হাতে তুলে দেয়। গহর বাঁশিটা হাতে নিয়ে বলে, এই তুমি ক্যারা? ক্যারা? কথা কও না ক্যা? যখনই গহর উত্তেজিত হয়ে ছায়ামূর্তির হাতটা ধরতে যায়, প্রতিবারই দেখে সামনে ফাঁকা। গহর ভেবে পায় না এর রহস্য কী। কেনই-বা তার চোখের সামনে সে আসে। কিন্তু আজ এত কাছে এসে বাঁশিটা হাতে তুলে দেয়! এই ঘোরের মধ্যেই সমস্ত রাত কেটে যায় তার।

জয়তুন বিদেশ চলে গেছে। মনু মিয়া শূন্য ঘরে বসে বসে কত স্বপ্নই যে দেখে। দুই মাস কেটে যায়। কোনো খবর নেই। গাঁয়ের লোকেরা নানা কথা বলতে থাকে। এদিকে ভিটে হারিয়ে নাটু মিয়া আর ছালেতন জায়গা নেয় কালিহাতী বাসস্ট্যান্ডের পাশে বড়ো রাস্তার ঢালুতে। একটা ছই তুলে তার নিচে বাস করে দুজন। নাটু মিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছে; আর ছালেতন ভিক্ষা করে।
আরব দেশে জয়তুনকে একটি বাসার ভেতরে নেওয়া হয়। রূপী তাকে বিভিন্নভাবে বোঝায়, তোমাকে আগে ট্রেনিং নিতে হবে। এই নাও, ড্রেস পরো। তোমার বাঙালি পুরাতন কাপড় রাখো। গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্ট পরো! জয়তুন আঁতকে ওঠে।
‘বুজি! এই ব্যাটা মানুষের পোশাক আমি পিন্দিমু? আমি পারমু না।’
রূপী জয়তুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ল²ী বোন, এই দেশে ঐসব পোশাক চলে না।’
‘বুজি, এইডা না মুসলিম দেশ? মুসলমান ম্যায়ারা এই পোশাক পিন্দে?’
‘জয়তুন, আমাদের দেশের মানুষ বেশি গোঁড়া। আর এদেশের মানুষ আধুনিক। এই জন্যে এদেশ এত ধনী।’
‘যা-ই বলেন, আমি ঐ পোশাক পরতে পারমু না।’
রূপী অনেক চেষ্টা করেও জয়তুনকে কিছুই শেখাতে পারে না। বাধ্য হয়ে তাকে একটা বাসায় কাজ করতে দেয়।
জয়তুনকে বাসার মালিক ইশারায় বুঝিয়ে দেয় বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুতে। প্রতিদিন ইশারায় সব বুঝিয়ে দেয়। এভাবে এক মাস কেটে যায়। জয়তুনের দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। নিজে বোবা না হয়েও বোবার মতো থাকতে হচ্ছে। কাজ কিছু কিছু করতে পারে। কিন্তু কথা বোঝে না। যদি চায় পানি, জয়তুন দেয় সিগারেট। তখন তার গালে ঠাস করে বসিয়ে দেয় এক থাপ্পড়। মাস দুই কেটে যাওয়ার পর জয়তুন ওদের কথা কিছু কিছু বুঝতে পারে। দু-একটা বলতেও পারে। বাড়ির মালিকের বউকে ডাকে মামা।
বাসার মালিক বাইরে চলে যাওয়ার পর ওই মহিলা প্রায়ই ট্যাক্সিতে করে এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যায়। যুবকটা বাংলাদেশি ড্রাইভার। জয়তুন এখন অনেক কিছু বুঝতে পারে। মনে প্রশ্ন জাগে। এরা নাকি মুসলমান, অথচ চালচলন ইসলামবিরোধী। মহিলারা বাইরে যায় বোরকা পরে। কিন্তু ঘরে যে ড্রেস পরে তা দেখে জয়তুন নিজেই লজ্জিত হয়।
সকালের নাশতায় এক ধরনের খবুজ তৈরি করে। বড়ো তাওয়ার মধ্যে পাতলা করে ময়দার মোরান করে বসিয়ে দেয়। নাশতা খেয়ে যে যার কাজে চলে গেছে। জয়তুনের মামা বাইরে চলে গেছে সেই ড্রাইভারের সঙ্গে। বাচ্চা স্কুলে। জয়তুন রান্না করতে থাকে। দুপুরের খাবার তালিকায় মাছ, মাংস, ফ্রাইড রাইস। মাছ চুলায় প্রথমে আঁশসহ পুড়ে নেয়। মুরগি আস্ত পোড়ে। জয়তুন প্রথম প্রথম এগুলি খেতে পারত না। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। রান্নাও করতে পারে, খেতেও পারে। কলবেলের শব্দে সে তাড়াতাড়ি তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে দরজা খুলে দিতেই বাড়ির মালিক হাসি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। টিভির রুমে গিয়ে সোফায় বসে রিমোট দিয়ে টিভিটা অন করে বলে, ‘জয়তুন, আনা মাই।’ অর্থাৎ এক গøাস পানি। জয়তুন পানি এনে দেয়। লোকটি পানি পান করে জয়তুনের হাতে আলতো করে চিমটি কেটে হেসে বলে, ‘কেমন কাটছে?’
জয়তুন এখন বেশ সুন্দর হয়েছে, চোখে পড়ার মতো। মামার ভাই মাঝে মাঝে এসে ইশারায় কী যেন বলে। জয়তুন একটু আঁচ করতে পারে, তাই সে এলে তার সামনে প্রয়োজন ছাড়া বের হয় না। কিন্তু আজ মালিকও যেন কেমন কুমতলব করছে। পানির গøাস নিয়ে যেতেই লোকটি জাপটে ধরে তাকে। জয়তুন চিৎকার দিয়ে ওঠে। এইডা কী করেন, আমারে ছাইড়া দেন। এরই মধ্যে মালিকের মেয়ে বাসায় এসে পড়ায় সে রক্ষা পায়। ছেড়ে দেয় তাকে।

জয়তুন প্রায়ই বাইরে গিয়ে ডাস্টবিনে ময়লা ফেলে। সেখানে কথা হয় বাংলাদেশি যুবক আফাজের সঙ্গে। আজও বাইরে এসেছে ময়লা ফেলতে। মনে মনে ভাবে, যদি আফাজের সঙ্গে দেখা হতো। আজ তার মনটা খারাপ। তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো লাগত। ময়লাটা ডাস্টবিনে ফেলে এদিকে-সেদিক তাকায়। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায়।
‘কি জয়তুন? কেমন চলছে দিনকাল?’
‘না ভাই, ভালা না। মামা মোটামুটি ভালাই। কিন্তু বাবা ভালা না। বাবার মতলব খারাপ। শেষ পর্যন্ত ইজ্জত বাঁচাইতে পারমু কি না?’
‘তোমাকে বেতন কত দেয়?’
‘বেতন কত জানি না। তয় তিন মাস ধইরা এই বাসায় আইছি। তিন মাসে পনেরো হাজার ট্যাহা দিছে। অহনকা ট্যাহাডা বাড়িতে পাঠান দরকার। কিন্তু কীভাবে পাঠাইমু?’
‘তুমি আমার কাছে দিতে পারো। আমি তোমার স্বামীর ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব।’
‘তাইলে কহিল নিয়া অহিমু।’
‘জয়তুন শোনো। তোমার কাহিনি আমি শুনেছি। কত কষ্ট করে স্বপ্নের দেশে এসেছ। অথচ, তোমাকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে বেতন ধার্য করেছে। এই কয়টা টাকা দিয়ে কী করবে? আর তোমার বাড়ির মালিকের খাইছলতও ভালো না। শেষ পর্যন্ত তোমার ইজ্জত লুট করেই ছাড়বে। বাড়ির মহিলার কাছে বিচার দিয়েছ। অথচ সে তোমাকেই উলটো বকা দিয়েছে।’
‘আফাজভাই, এই বিষয়ডা আমি বুঝি না। মামার ভাইয়ের কথা শুইনাও আমারে বকল, আবার বাবার কথা শুইনাও আমারে বকল। কেন?’
‘শোনো জয়তুন, এ দেশে পুরুষরা তিন-চারটা করে বিয়ে করে, তার ধর্মীয় কারণ আছে। আমরা ধর্মের কতটুকু জানি। আমরা তো শুইনা মুসলমান।’ আফাজ জয়তুনকে ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি বোঝায়। ‘পৃথিবীতে দাসপ্রথা চালু হয় মুসলিম যাত্রার শুরু থেকেই। দাসপ্রথার ইতিহাসে একটাই ধারণা উঠে এসেছে, ইউরোপীয় শে^তাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের দাস হিসেবে ব্যবহার করছে। সেখান থেকেই দাস প্রথার জন্ম। অথচ দাস প্রথার মূল কর্ণধার যারা, তারা আজ দাসত্বের ঘৃণ্য ব্যবস্থা হতে মুক্ত। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে তার সত্যতা মিলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা আজও উত্তরাধিকার সূত্রে দাস প্রথা বজায় রেখেছে। বাস্তবায়নের ধারাটা ভিন্ন।’
‘আফাজভাই, ঠিক কইছেন। হেরা আমারে দাস ছাড়া কিছু ভাবে না।’
‘জয়তুন বিষয়টা বলছি শোনো, কৃষ্ণাঙ্গ দাসব্যবস্থা একমাত্র দাসব্যবস্থা নয়। আরব, তুর্কি, ভারতীয় এবং এমনকি লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় একসময় দাসব্যবস্থার শিকার হয়েছিল। এ ব্যবস্থার একটি অংশ ছিল যৌন দাসত্ব এবং খোজাকরণ। এই কাজগুলি যারা করত তারা ছিল মুসলমান। ইতিহাসে আছে, স্বয়ং নবি দৈব প্রত্যাদেশ পেয়ে বৈধতাপ্রাপ্ত হয়ে বহুসংখ্যক আরব উপজাতি নারী ও শিশুদেরকে দাস বানিয়ে ইসলামি দাস প্রথার সূচনা ঘটিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইসলামি ক্ষমতার সঙ্গে দাসব্যবস্থা বিস্তার লাভ করে। সেনাপতি মুসা ৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দ-উত্তর আফ্রিকা জয় করে ৩ লক্ষ মানুষকে দাস বানিয়েছিলেন এবং ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্পেন জয় করেন। সেখানে লুটেরা মালের সঙ্গে ৩০ ছিল হাজার ছিল শ্বেতাঙ্গ কুমারী। সুলতান মাহমুদ ১০০১-২ খ্রিষ্টাব্দে ভারত আক্রমণ অভিযান সমাপ্ত করে ৫ লক্ষ নারী ও শিশুকে দাস হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যান। ইউরোপীয় ইসলামি দাসব্যবস্থার কম শিকার হয়নি। ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনার দ্বারপ্রান্তে তাদের চ‚ড়ান্ত পরাজয়ের পর পালানোর সময়ও ৮০ হাজার শ্বেতাঙ্গ বন্দিকে দাস হিসাবে সঙ্গে নেয়। উত্তর আফ্রিকার জলদস্যুরা ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় বাণিজ্য জাহাজগুলি এবং ইউরোপের উপক‚লীয় গ্রাম ও দ্বীপগুলো থেকে ১৫ লক্ষ ইউরোপীয়কে দাস হিসাবে বন্দি করে। এর পর থেকে ইউরোপীয়রা আটলান্টিকপাড়ে, ব্যাপকভাবে দাসব্যবসা শুরু করে। আজ ইউরোপীয়রা মুসলিমদের দাস হিসেবে ব্যবহার করে তার বদলা নিচ্ছে। যাক, ওসব কথা। ইসলামি দাসত্বের ভয়ানক ও নৃশংসতম বৈশিষ্ট্য ছিল খোজাকরণ।’
জয়তুন প্রশ্ন রাখে, ‘খোজাকরণ কী?’
আফাজ বুঝিয়ে দেয় :
আফ্রিকান পুরুষদের পুরুষাঙ্গ কেটে তাদের খোজা বানাত। এতে অনেকে মৃত্যুবরণও করত। ইউরোপীয়রা আট শতাব্দীব্যাপী দাসব্যবস্থার শিকার ছিল। এখনো কৌশলে ইউরোপীয়রা মুসলমানকে দাস হিসেবে ব্যবহার করছে। আর কতগুলি ইসলামি দেশÑ মৌরিতানিয়া, সৌদি আরব ও সুদানে আজও দাসব্যবস্থা চলছে। এখন তো ইউরোপীয়দের সঙ্গে পেরে ওঠে না। বাংলাদেশ গরিব দেশ। ইদানীং ব্যাপক হারে মহিলাদের দাস হিসাবে বিক্রি করছে মধ্যপ্রাচ্যের নিকট।
আফাজ বলে, ‘তার শিকার আজ তুমি।’
জয়তুন বলে, ‘হ ভাই, ঠিক ভাই, ঠিক কইছেন। বাসার ময়লা ফালাইতে আসলে মাঝে মাঝে বাংলাদেশি দু-একজন মহিলার সঙ্গে কথা হয়। তারাও ভালা নাই, ভাই। একেক জনের একেক সমস্যা। সবাই কষ্টে আছে। এদেশের মানুষ দাসীরে মানুষ মুনে করে না।’
‘ঠিক বলেছ জয়তুন। ওরা বাংলাদেশের মানুষকে খাল্লিবাল্লি বলে, ফকির বলে।’
‘ভাই, ওরাও মুসলমান। আমরাও মুসলমান। তার পরও কোনো মায়া করে না!’
‘জয়তুন, এতক্ষণ যে ব্যাখ্যা দিলাম সেটা যাবে কোথায়? ওদের দোষ কী। ধর্মীয়ভাবেও দাসপ্রথা স্বীকৃত এ ব্যাপারে কোরআনের অনেক আয়াত আছে।
‘মোহাম্মদ তার কপটিক (খ্রিষ্টান) দাসী মারিয়ার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ইসলাম লুটেরা মাল হিসাবে আল্লাহ্র পথে জিহাদের পুরস্কার হিসাবে দাসীদের গ্রহণ করা অনুমোদন করে। ইবনে সাদ উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মদ মারিয়াকে পছন্দ করতেন। সে ছিল সুন্দরী, তার গায়ের রং ফরসা এবং চুলগুলি কোঁকড়ানো। মুহাম্মদ দাস প্রথা অনুমোদন করেন।’
জয়তুন আফাজের কথা শুনে অবাক হয়ে বলে, ‘আফাজভাই আপনার কথাগুলা কি সত্য?’
‘জয়তুন, এগুলি তো বানিয়ে বলি নাই। ইতিহাসের কথা। ধর্মের কথ। তোমরা তো হাদিস-কোরআন সম্পর্কে সঠিকভাবে জানো না। এই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা জেনেশুনে এবং বুঝে সেই অনুসারে কাজ করে। ওদের কাছে ধর্ম বড়ো। মানবতা মূল্যহীন। তুমি তো বললে, মন খারাপ হলে বা কান্না করলে তোমার মামা ধমকায়। অনেক দাসীকে মারধর করে বের করে দেয়। ওদের কাজকর্ম সব ঠিকমতো করতে হবে। ওদের কথামতো চলতে হবে। যত দুঃখ-যন্ত্রণা সবকিছু পাথর চাপা দিয়ে হাসি হাসিমুখ করে থাকতে হবে। কারণ দাসীদের বৈশিষ্ট্য যা থাকে তা পুরোপুরি এ দেশের মুসলমানরা মেনে চলে।’
‘ভাই, তাইলে তো চিন্তার বিষয়।’
‘শুধু তা-ই নয়, বিচার দেওয়া সত্তে¡ও তোমার মামা তোমাকে বকাবকি করে। তার কারণ এ দেশের পুরুষরা তিন-চারটা বিয়ে করে। ইসলাম ধর্মে পুরুষদের জন্য চারটা বিয়ে বৈধ। কাজেই এ দেশের ন্ত্রীরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। বাধ্য হয়ে মহিলারা সতিনের ঘর করে। অনেক মহিলা সতিন থেকে বাঁচার জন্য বাসায় কাজের মহিলাকে ইচ্ছে করে লেলিয়ে দেয়। যেমন, তোমার মামা বলেছে, পুরুষরা একটু এরকম করবেই। তুমি মেয়ে, মেনে নিতে হবে, কারণ ধর্মীয়ভাবে জায়েজ আছে। তুমি ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে। তোমার বেতন বাড়িয়ে দেবে। আর তার ভাই বা স্বামীর বিষয়ে কিছু বলবে না। কারণ বিয়ে করতে হলে মেয়েকে অনেক টাকার পণ দিতে হয় ওদের। এই পণের টাকা বেশিরভাগ যুবকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয় না। যুবকের তো শারীরিক চাহিদা আছে। এই দেশের আইন খুব কঠিন। যুবকেরা বাইরে কোনো মেয়ের সঙ্গে অবৈধ কাজ করলে একদিকে তার শারীরিক চাহিদা মিটল আবার পুলিশের ঝামেলা থেকেও বেঁচে গেল। এজন্য বাসার মালিকের বউরা এতে সাপোর্ট দেয়। কাজেই তোমার বাবা আর মামার ভাইয়ের চোখ যেহেতু তোমার ওপর পড়ছে, তুমি আর রক্ষা পাবে না। তুমি আমার দেশের মেয়ে? তোমাকে উপদেশ দেওয়া উচিত। উপদেশ দিচ্ছি, গ্রহণ করা-না-করা, তোমার ব্যাপার।’
‘আফাজভাই, আপনার কথা শুনমু না মানে, আপনারে আপন ভাইয়ের মতো ভাবি। তাই তো সব কথা কই। আপনে কী বলবেন, বলেন?’
‘তোমাকে ভালো একটা কাজ দিতে পারি। মাদ্রাসার ক্লিনারের কাজ। বেতন দেবে ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও বকশিশও পাবে। প্রতি মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা দেশে পাঠাতে পারবে। তোমার কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি চিন্তা করে আমাকে জানাবে।’
‘আফাজভাই, চিন্তাভাবনার কিছু নাই। আপনে কাজ দিলে আমি যাইমু। ঐ বাড়িতে আর সম্ভব নয়। মালিক যে কবে আমার সর্বনাশ করব?’
‘জয়তুন, তোমাকে সাবধানে ওই বাসা থেকে পালাতে হবে। কেউ যেন টের না পায়।’
‘ভাই পালাইমু কেমন কইরা?’
‘তোমার বাসা রাতে কখনো খালি থাকে না?’
‘মাঝেমইধ্যে খালি হয়।’
‘এই নাও, ফোন নাম্বার। যদি কখনো রাতে খালি হয়। তখন আমাকে ফোন করবে। আমি দরজায় টোকা দেব। তুমি বের হবে খালি হাতে। আমি তোমাকে নিয়ে পালাব।’
‘ভাই, পরশু দিন রাতে সবাই একটা বিয়ার অনুষ্ঠানে যাইব। তাইলে ঐ রাইতে আপনেরে ফোন দিমু।’
‘জয়তুন, তাহলে সে কথাই ঠিক হলো। তাহলে আসি।’
জয়তুন সমস্ত কাজ শেষ করে, দুপুরে নিজের ঘরে বিশ্রাম নেয়। মনটা চলে যায় ফেলে আসা বাংলাদেশে। একে একে চেনা মুখগুলি স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে তার। হঠাৎ পানসির মুখটা নাড়া দেয়। পানসির সঙ্গে মনের কথা বলত সে। কিন্তু পানসি ব্যতিক্রম। তার ভেতরে কীসের যেন হাহাকার, যেন গোপন কোনো কথা, অনেক চেষ্টা করেও যা কোনো দিন জানতে পারেনি জয়তুন। বিয়ের পর পানসি যন্ত্রের মতো সংসার করতে থাকে জইনদালির সঙ্গে। কিন্তু তার ভেতর কে বসত করে তা পানসির মুখ থেকে বের করতে পারেনি। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জয়তুন। মানুষের জীবন কেন এত বিচিত্র! কষ্টের ভেতর অতিবাহিত করতে হয়, নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখে। জয়তুনের গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু চেহারাটা মিষ্টি। বলা যায় সুইট কৃষ্ণকলি।

জয়তুন আফাজের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠে। আফাজ নিজেই গাড়ি চালায়।
‘ভাই, আপনি গাড়িও চালাইতে পারেন? আপনি কি ড্রাইভারের কাম করেন?’
‘না জয়তুন। এ গাড়ি আমার। আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করি, সেই কোম্পানি থেকে আমাকে দিয়েছে।’

‘শহরের আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে একসময় একটা বাসার সামনে এসে থামে তারা। আফাজ বাসায় ডোরবেল টেপে। কিছু সময়ের মধ্যে সুন্দর এক তরুণী বের হয়ে আসে। মেয়েটিকে দেখে জয়তুনের মন খুশিতে নেচে ওঠে। বাঙালি মেয়ে। এবার তার ভালোই হবে। জয়তুন কিছুই বুঝতে পারে না, আফাজ তরুণীর সঙ্গে কী বলে! জয়তুনের সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘জয়তুন, ও হলো জনতা। ওর বাড়ি বাংলাদেশের খুলনায়। জনতা সব বুঝিয়ে দেবে তোমাকে। আমি আসি।’
‘আফাজভাই, আপনি কিন্তু আবার আসবেন।’
জনতা জয়তুনকে ভেতরে নিয়ে যায়। জয়তুন, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। কাল তোমার সব কথা শুনব।’
পরদিন জনতা বলে, ‘জয়তুন, তোমার সব কাহিনি আফাজের কাছে শুনেছি। তোমার বাবা-মা ভিক্ষা করে তোমার কারণে। কাজেই তোমার কি উচিত না তাদের জন্য কিছু করা? তোমার কি উচিত না তোমার বাবার ভিটে ফিরিয়ে দেওয়া? তুমি এখানে আসার পর তাদের খোঁজ নিয়েছ?’
‘বুজি, আমি দেশ থিকা আসার পর কিছুই জানি না। টাকাও পাঠাইতে পারি নাই। আইছি ছয় মাস হইছে। এর মধ্যে আফাজভাইয়ের কাছে ১৫ হাজার টাকা পাঠাইছি।’
‘জয়তুন, তোমার সব হবে। তোমার স্বামী, বাবা-মায়ের খবর নিতে পারবে। টাকা পাঠাতে পারবে। শুধু আমি যেভাবে বলব, সেভাবে কাজ করবে। আমার কথা শুনবে।’
‘বুজি, আপনে তো আমার ভালাই করবেন। আপনের কথা তো শুনতেই অইবো।’
একরাতে জনতা একজন লোককে সঙ্গে নিয়ে আসে। জয়তুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওর নাম মমিন। বাড়ি গাজীপুর। লোকটির বয়স ৫০ বছরের মতো হবে। মাথায় টাক। দাঁড়ি-গোঁফ আছে। সৌদির বড়ো ব্যবসায়ী। ওর মতো লোক তোমার জীবনের করুণ কাহিনি শুনে এসেছে। তোমার জন্য ওর কষ্ট হয়। তাই চলে এসেছে। আমরা অনেক আশা করেও ওকে পাই না। জয়তুন তুমি ভাগ্যবতী। লোকটি বেশ কিছুক্ষণ জয়তুনের সঙ্গে কথা বলে। যাওয়া সময় জয়তুনকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করে। জয়তুন কাঁদতে কাঁদতে জনতাকে এসব বলে।
জনতা জয়তুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দেয়, ‘ও কিছু না। এটা এদেশে নিয়ম। তোমাকে খারাপ ভেবে দেয়নি।’
‘বুজি, এইডা মুসলমান দেশ? হাদিস-কোরান তো সব দেশের জুন্যে একই রকম। এই দেশের জুন্যে তো আলাদা না। যাক আমারে কামে দিবেন কবে?’
‘জয়তুন, তোমাকে বলছি না, যা-যা বলব তা শুনতে হবে। প্রথমত তোমার নামটা বদলাতে হবে। এই আদিকালের নাম এদেশে চলবে না। আমার আসল নাম কিন্তু জনতা না। জনতা নামটা এদেশে আসার পর হয়েছে। তোমার নাম জয়তুন বাংলাদেশের জন্য। এ দেশের জন্য তোমার নতুন নাম হবে সোনালু, নামটা সুন্দর না? আর তোমার ভাষা পরিবর্তন করতে হবে। সৌদি ভাষা যা পারো মোটামুটি চলবে। তোমার কাজের ক্ষেত্রে বাঙালিদেরকেও পাবে। কাজেই সুন্দর ভাষা আমার কাছ থেকে শিখবে। ১৫ দিনের মধ্যে এগুলি ঠিক করো। তারপর কাজে দেব।’
সোনালু এবার সিরিয়াস হয়। জনতার কথামতো চলতে হবে। গ্রামে চাষাভুষার তো কোনো দাম নেই। আধুনিক হতে হবে। তার ভেতরে একটা সংগ্রাম শুরু হয়। তার নিজের মধ্যে প্রতিবাদী ঝড় ওঠে। যেভাবেই হোক তাকে তাল মেলাতে হবে। গ্রাম্য খোলস বদলাতে হবে। নতুন কৃত্রিম মুখোশ পরতে হবে। এ বোধ সোনালুর মধ্যে সৃষ্টি হয়। জনতার হাত ধরে অনুনয় করে সে, দেশে ফেলে আসা আপনজনের খবর জানার ইচ্ছে প্রকাশ করে।
জনতা বলে, ‘আগে ভাষা ঠিক করো। আর আমাকে নাম ধরে ডাকবে? বলো, জনতা দেশের খবরটা জানা দরকার।’
সোনালু কথাটা জনতার মতো করে কপি করার চেষ্টা করে। তাকে যে পারতেই হবে। মানুষ পারে না, এমন কিছু নেই।
‘সোনালু, সুন্দর হয়েছে! তুমি চেষ্টা করলেই পারবে। তোমার দেশে খবর নিতে পারবে। তোমার স্বামীর ফোন আছে?’
‘না।’
‘তাহলে কার ফোনে কথা বললে তোমার স্বামী-বাবা-মার খবর নিতে পারবে?’
সোনালু একটু ভাবে। তারপর বলে, ‘কালিহাতী বাজারে ফটিকের ফোনের দোকান আছে। আমার কাছে নাম্বারটাও লেখা আছে।’
‘নাম্বার বের করো।’
সোনালু একটা কাগজ বের করে দেয়। জনতা ফোনে নাম্বারটা টেপে। ওপাশ থেকে ফটিকের গলা, ‘হ্যালো। আপনি কারা?’
‘আমি সৌদি থেকে বলছি। মনু মিয়ার বউ কথা বলবে।’
‘সোনালু ফোনটা কানে ধরল। হ্যালো। কি ফটিকভাই?’
‘ভাবি! কেমুন আছেন। আপনার খবর কী? যাওনের পর থিকা আর কোনো খবর নাই। ভাই তো বেজায় চিন্তায় পড়ছে।
‘ফটিকভাই, আমার বাবা-মায়ের খবর কী?’
‘আহা রে, ভাবি, আপনার বাবা প্যারালাইসিস হইয়া পইড়া রইছে। আর আপনের মায় ভিক্ষা করে। আর পঙ্গু মানুষটারে নিয়া বাসস্ট্যান্ডের ঢালে থাকে। তা তো দেইখাই গেছুন। পাশে বড়ো রাস্তার ঢালে ছই তুইলা থাকে। আর মনুভাইরে ঋণের টাকার জুন্যে মানুষ পাগল কইরা খাইল।’
‘ফটিকভাই, পনেরো হাজার টাকা পাঠিয়েছি। পেয়েছে?’
‘ভাবি, তা তো জানি না। ভাবি, আপনি তো অনেক ভালা কথা কওন শিখছেন।’
‘ফটিকভাই তারে বলবেন, আমি ভালোই আছি। এরপর থেকে নিয়মিত টাকা পাঠাব। রাখি, খোদা হাফেজ।’

ফটিক হন্তদন্ত হয়ে মনুর বাড়ি গিয়ে উঠানে দাঁড়ায়।
‘কারা? ফটিক?’
‘মনুভাই, ভাবি ফোন করছাল।’
মনু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফটিককে ধরে বলে, ‘জয়তুন কেমন আছে? কী কইল?’
‘ভাবি ভালো আছে। তোমার খবর নিল। পনেরো হাজার ট্যাহা নাহি পাঠাইছে?’
‘ফটিক, ট্যাহার কথা কইছে। কই? ট্যাহা তো পাই নাই। কবে পাঠাইছে?’
‘তা তো জানি না ভাই। তয় কইছে, এরপর থিকা নিয়মিত ট্যাহা পাঠাইব। তার বাপ-মায়ের কতা জিজ্ঞাইল।’
‘ফটিক আবার যদি ফোন করে, তাইলে কইবি, আমার নগে জানি কথা কয়। তুই কইবি, কহন ফোন করব? সময় জানি আগেই জানায়।’
‘আইচ্ছা ভাই, যাই।’ পা বাড়িয়ে আবার পিছনে ফিরে বলে, ‘ভাই, ভাবি যে কী সুন্দর ভাষায় কথা কইল। এই গ্রামের ভাষা তার মুখে এটুও শুনলাম না। মুনে হইল, ভাবি দেখতেও সুন্দর হইছে।’
মনু মিয়ার ভেতরটা একবার রোদ-আবার মেঘে ছেয়ে যায়। মনের ভিতর লুকোচুরি চলতে থাকে।

সোনালু ফুঁ