গাছ পাখি আর রোদের হাসি রুনা তাসমিনা গাছ পাখি আর রোদের

332

-ইস! শুকনো এই ডাল কী বিচ্ছিরি করে রেখেছে আমায়।
কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদ এসে পড়েছে বটের গায়ে। রোদ পোহাতে পোহাতে ভীষণ বিরক্তিতে বললো সে। শীতে জবুথবু হয়ে আছে একটু দূরে ছোট্ট আমগাছ। তার গায়ে এখনো রোদের আঁচ লাগেনি। বটগাছের বিরক্তি দেখে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-কী হয়েছে বটবাবু?
-দেখো তো, এই ডালটা আমাকে কেমন বিচ্ছিরি বানিয়ে রেখেছে।
ছোট্ট আমগাছ বেশিদিন হয়নি মাটির ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কালচে লাল কচিপাতাগুলো শিশির ভেজা গায়ে থরথর করে কাঁপছে আর দেখছে বটগাছের উপর পড়া মিষ্টি রোদ।
– বটবাবু,এই ডালগুলোর জন্যই তো পাখিরা এসে তোমার সঙ্গে গল্প করে। পথিক এসে তোমার ছায়ায় বসে। সবাই তোমাকে কতো ভালোবাসে! রোদ এসেও আগে তোমাকেই ছোঁয়। আমাকে দেখো! শিশির এখনো শুকোয়নি আমার গা থেকে। কখন রোদ এসে আমার গায়ে পড়বে সেই অপেক্ষায় আছি। তুমি ডালটাকে বকা দিও না।
-অত বকবক করোনা তো। পিচ্চি আমগাছ। আমি হলাম এখানকার সবচেয়ে বড় গাছ। আমার গোটা খেয়ে পাখিরা খিদে মেটায়। মানুষ আমার ছায়ায় বসে জিরোয়। ওরা আমার কাছে না এসে কোথায় যাবে?
বটগাছের কথায় ছোট্ট আমগাছের মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবে কখন বড় হবে। খানিক পরেই রোদ এসে আলতো করে হাত রাখে আম পাতায়। শিশিরগুলো যত্ন করে মুছে নিতে নিতে বলে,
-ছোট্ট আমগাছ, মন খারাপ নাকি?
-বটগাছ কী বকাটাই না দিলো আমাকে। আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?
-ও বড় অহংকারী। ওর কথায় মন খারাপ করো না। একদিন তুমিও বড় হবে। তোমার ডালে এসে পাখিরা বসে গল্প করবে। মানুষ তোমার ছায়ায় বসে জিরোবে। মিষ্টি হেসে রোদ বললো,
-তোমার তো আরো একটি গুণ বেশি আছে।
-কী গুণ! ছোট্ট আমগাছ অবাক হয়ে বললো।
-যখন আম ধরবে, মিষ্টি আম খেয়ে সবাই তোমার কতো তারিফ করবে!
রোদের কথায় মন খুব ভালো হয়ে যায় আমগাছের। খুশিতে দুলে ওঠে কালচে লাল কচিপাতা। বিকেলের দিকে বিদায় নিয়ে চলে যায় রোদ। সন্ধ্যা নেমে আসতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট আমগাছ।
মড়াৎ করে এক বিকট শব্দে ছোট্ট আমগাছের ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকারে পরিষ্কারভাবে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। কার যেনো গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে বটগাছের গোড়া থেকে। ছোট্ট আমগাছের বুক ভয়ে কাঁপছে। ভয়ে ভয়ে বটগাছকে জিগ্যেস করলো,
-বটবাবু,কী হয়েছে?
-ওই শুকনো ডালটা আমার গা থেকে ভেঙে পড়েছে।
– সে কী! কেউ মনে হয় খুব ব্যথা পেয়েছে। গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
-হ্যাঁ ভাই। আমিও শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু এতো উঁচু থেকে আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।
-তুমি তো ওই ডালের ওপর খুব বিরক্ত ছিলে।
-তবুও ভাই। আমি তো মা। ওই ডাল আমার সন্তান। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বটগাছ বললো।
-তুমি একটু দেখোনা ভাই,কে ব্যথা পেলো?
বটবাবুর দুঃখে ছোট্ট আমগাছের মনেও দুঃখ লাগলো। তাই কথা আর বাড়ালো না। অন্ধকারে কিছু ভালো করে দেখাও যাচ্ছেনা। টুপটাপ করে ঝরে পড়া শিশিরে ভিজতে ভিজতে অপেক্ষা করতে লাগলো সকালের।
চোখের পাতা একটু লেগে এসেছিল। এমন সময় লোকজনের কথার শব্দে ঘুম ছুটে গেলো ছোট্ট আমগাছের। উঁকি মেরে দেখলো, প্রতিদিন যে পাগল ভিক্ষুকটি বটবাবুর নীচে ঘুমাতো সে বটের ডালের নীচে চাপা পড়ে আছে। লোকজন ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। কেউ দেখলো না ওই ভিক্ষুকের জন্য বটগাছ, আমগাছ দু’জনেই ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির ফেলে কাঁদছে।
বটের পাতা ঝরিয়ে,ঘাসে শিশির মাখিয়ে শীত বিদায় নিলো। বসন্ত এলো চারদিক মাতিয়ে। ফুলের মৌ মৌ গন্ধ নিয়ে। মৌমাছিরা গুনগুন করে গাইতে গাইতে ফুল থেকে মধু নিয়ে ফিরছে মৌচাকে। প্রজাপতি রঙ বেরঙের ডানা উড়িয়ে ফুলের সঙ্গে কানাকানি করছে। কোকিল কুউউ.. করে ডেকে কখনো বটগাছে,কখনো আমগাছে ছুটে পাখির বাসা খুঁজছে ডিম পাড়ার জন্যে। ছোট্ট আমগাছ হয়ে উঠেছে দুরন্ত কিশোর। কালচে লাল পাতাগুলো গাঢ় সবুজ হয়েছে। বাতাসের সঙ্গে হেসে লুটোপুটি খায় পাতাগুলো। বটগাছও সুন্দর হয়ে উঠেছে নতুন পাতায়। দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম এসে হাজির। একদিন সকালে নিজেকে দেখে আমগাছ অবাক! তার ডালে মুকুল ফুটেছে! খুশিতে বটগাছকে ডেকে বললো,
– বটবাবু,দেখো দেখো, আমার ডালে বোল ফুটেছে।
বটগাছ তাকিয়ে দেখে সত্যিই তো! বললো,
-এবার পাখিরা তোমার ডালে বসবে, গল্প করবে। আর তোমারা মিষ্টি ফল খাবে।
খুশিতে ডগমগ হয়ে আমগাছ বললো,
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ ভাই। আমার যে কী খুশি লাগছে!
দিনে দিনে বোলগুলো আমের আকৃতি নিয়ে বেশ নাদুস নুদুস হয়ে ওঠলো। সবুজ আম ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে গাছে ঝুলতে লাগলো। পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ পেড়ে খায়,কেউ ছিঁড়ে খেয়ে আমগাছের খুব তারিফ করে। পাখিরা এসে খুঁটে খুঁটে খায় আমের শাঁস। রমরমা অবস্থা আমগাছের। বটগাছ দেখে আর অনুশোচনা করে। একদিন বলেই ফেললো মনের কথা।
-ছোট্ট আমগাছ? তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও। বটবাবুর গলার আওয়াজ বেশ গম্ভীর শোনায়।
-কেন! কী হয়েছে? আমগাছ অবাক হয়ে তাকায় বটবাবুর দিকে।
-যখন ছোটো ছিলে ‘পিচ্চি’ বলে উপহাস করেছি। আমার খুব অহংকার ছিল বড় বলে।
-এসব কী বলছো বটবাবু! তুমি কেন শুধু শুধু মনে কষ্ট পাচ্ছ? আমি কবেই ভুলে গেছি ওসব কথা।
– তুমি অনেক ভালো ছোট্ট আমগাছ।
-আমরা দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকবো,একজন আরেকজনের বন্ধু হয়ে। কেমন?
বটগাছের মুখে হাসি ফুটে ওঠলো। হাসছে আমগাছও। মেঘের দেশ থেকে হেসে উঠলো সূর্য, হাসলো রোদ। ওদের হাসিতে যোগ দিল কাঠবিড়ালি, কাক, চড়–ইপাখি। সুস্থ হয়ে বটগাছের নীচে বসে হাসছে সেই পাগল ভিক্ষুকও। সে কেন হাসছে সে-ই জানে।