স্বাগতম ২০২০

128

২০২০ সাল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি নতুন আশাবাদের সাল। বছরটি মুজিব বছর হিসেবে ঘোষিত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালিত হবে। এই পালনটি তখনই আমাদের কাছে সুখের হবে যখন আমরা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের অগ্রগতি আরো সাফল্যের ধারায় এগিয়ে নিতে সক্ষম হবো। ২০২০ সাল যেন সেসব আশাবাদের স্ফুরণ ও বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় সেই লক্ষ্যেই সরকার ও রাজনীতি সচেতন মহলকে কাজ করতে হবে।
আজ ২০১৯ এর শেষ দিন। আগামীকাল নতুন বছর ২০২০ শুরু হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ২০১৯-এর অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে গণমাধ্যমে যথেষ্ট আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে, প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হচ্ছে নতুন বছর হিসেবে ২০২০-এ অনেক কিছু। এটি প্রচলিত ধারার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরাতন বছরে অর্জন ও ব্যর্থতার সালতামামি থেকে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয় নতুন বছরের বেশি বেশি যেন সাফল্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্জিত হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না। রাত পোহালেই পৃথিবীতে নতুন বছর নিয়ে মানুষের নানা প্রত্যাশার কথা শোনা যাবে। শুরু হবে যথারীতি নতুন বছর।
আজ বছরের শেষ দিন হিসেবে ফিরে দেখা যেতে পারে ফেলে আসা ৩৬৫ দিনের ২০১৯ কে। বছরটি শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৃতীয় মেয়াদের নতুন সরকারের দায়িত্বগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এক বছরে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা পুরোপুরি মূল্যায়ন করা না গেলেও বলা চলে এই মেয়াদে সরকার প্রথম বছরে বেশকিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষত এই মেয়াদে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজের দল এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান দেখাতে শুরু করেছে। এটি ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রতিশ্রæতি পূরণে শেখ হাসিনার দৃশ্যমান উদ্যোগ বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। পরপর তিন মেয়াদে সরকার গঠনের পর স্বভাবতই দল এবং অঙ্গসংগঠনের একশ্রেণির নেতাকর্মীর মধ্যে বেপরোয়া ভাব বেড়ে গিয়েছিল। বিষয়টি সচেতন মহলকেও বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। তবে আশার কথা হলো শেখ হাসিনা বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে যারা বিতর্কিত হয়ে পড়েছিল, কিংবা যাদের কারণে সংগঠন বিতর্কিত হয়ে পড়েছিল তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কয়েকজন সমালোচিত নেতা এখন কারারুদ্ধ আছেন। এই বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হিসেবে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের এটি বড় ধরনের ঘটনা। একইসঙ্গে অঙ্গসংগঠনগুলোর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়- যেগুলো থেকে বাদ পড়েন প্রভাবশালী অনেকেই। বলা চলে এসব অঙ্গসংগঠনের সম্মেলন ও নতুন নেতৃত্ব গঠনে শেখ হাসিনার উদ্যোগ রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। যেসব নেতাকর্মী ইতোপূর্বে এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল যে, শেখ হাসিনার আদেশ-নির্দেশ উপেক্ষা করে নানা ধরনের সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমে যারা জড়িয়ে পড়েছিল তারা সম্মেলনগুলোতে নেতৃত্ব লাভে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করতে সাহস দেখাতে পারেনি। একইভাবে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কেউ তেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টাও করেনি। এর কারণ হচ্ছে এ বছর দলীয়প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান ইত্যাদি পরিচালনায় জিরো টলারেন্সের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটির প্রতি সাধারণ মানুষ এবং তৃণমূলের সৎ ও আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান নেতাকর্মীদের ব্যাপক সমর্থন দৃশ্যমান হওয়ায় এরই মধ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা প্রভাব বিস্তার করছিলেন, নানা অপরাধ দুর্নীতিতে জড়িয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন তারা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সে কারণেই সব সম্মেলনেই শেখ হাসিনা তার নতুন রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন বিনা চ্যালেঞ্জে ঘটাতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০১৯ সালের এই অর্জনকে বিশেষভাবে মূল্যায়িত করতেই হবে। কেননা আমাদের দেশের রাজনীতি সামগ্রিকভাবেই দুর্নীতিবাজ, আদর্শহীন ও দুর্বৃত্তায়িত শক্তির কাছে অনেকটাই নত হয়ে পড়েছে- এটি সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন। কোনো রাজনৈতিক দলই নিজের দলের অভ্যন্তরে শক্তিমান দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ ও আদর্শহীনদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার পর্যায়ে নেই। বিশেষত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষে দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সেটি আমরা আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সময়েও দেখেছি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত এবং অনুপ্রবেশকারীদের শক্তি বৃদ্ধির প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে যেতে দেখেছি। আওয়ামী লীগ নানা পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল হওয়া সত্তে¡ও গত এক দশকে সাংগঠনিকভাবে নানা আদর্শগত বিচ্যুতির মুখে পড়েছে সংগঠনের অভ্যন্তরে দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীর অপকর্মের কারণে। সে কারণে মানুষের মধ্যে একদিকে যেমন হতাশা ছিল অন্যদিকে আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শেখ হাসিনা- যিনি তাদের আশা পূরণ করবেন, দলকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অবিতর্কিত দল হিসেবে প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেবেন। সে কারণে শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর সাধারণ মানুষ এবং আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়, ঘুরে দাঁড়ায় দৃশ্যপট, শক্তি পান শেখ হাসিনা নিজেও। সম্ভবত সে কারণেই তাঁর অভিযানের প্রথম পর্বটি তিনি অনেকটা বাধাহীনভাবে অতিক্রম করতে পেরেছেন। শুদ্ধি অভিযানের দ্বিতীয় পর্বটি হয়তো তিনি ২০২০ সালে পরিকল্পিতভাবে শুরু করবেন।
২০১৯ সালে দেশের রাজনীতিও অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। জঙ্গিবাদের নতুন করে উত্থান ঘটার সুযোগ দেয়া হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কিংবা এর মিত্র জোটসমূহ তেমন কোনো আন্দোলন ধার করাতে পারেনি। এমনকি ঐক্যজোট যে ধরনের ঘোষণা দিয়ে মানুষকে একটু-আধটু দোলা দিতে চেয়েছিল, নির্বাচনের পর থেকে তাদের সেই দোলাও খুব একটা কাজে লাগেনি। ঐক্যজোটের মধ্যেই অনৈক্য বাড়তে থাকে। বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনেও তেমন কোনো শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ ঐক্যজোটের কয়েকজন নেতার কিছু কিছু হুঙ্কার ছাড়া তেমন বিশেষ কিছু ছিল না। সরকার বছরটি আগের বছরের মতোই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সূচকসমূহ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ধরে রাখতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। তবে কিছু কিছু দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে সরকারকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে। তবে এই বছর খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ছিল। কিন্তু পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। এটি বৈশ্বিক বাজার সমস্যার কারণে বাংলাদেশেও ঘটেছে। প্রতিবেশী ভারতে পেঁয়াজের মূল্য একশ থেকে দুইশ-এর মধ্যে ওঠানামা করায় ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছিল। এছাড়া অন্যান্য পণ্যসামগ্রী নিয়ে ততটা ভোগান্তি ছিল না। তবে এ বছর সরকার বেশকিছু অভিযান পরিচালনা করে জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছেন। এর একটি হচ্ছে নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, অন্যটি হচ্ছে ভোক্তা অধিকার আইন বাস্তবায়নে আগের চেয়ে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা এই অভিযানগুলো বাংলাদেশে আইন, নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করার জন্য অতীব জরুরি। বলা চলে গোটা ২০১৯ সালেই সরকার নানা ধরনের অভিযানে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করতে পেরেছে। এসব দখলদারের বিরুদ্ধে নিকট অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারও খুব বেশি সাফল্য দেখাতে পারেনি, অন্যরা তো নয়ই। সেক্ষেত্রে বলা চলে শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের নতুন সরকার প্রথম বছরে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে যে দৃঢ়তার পরিচয় দেখাতে পেরেছে সেটি প্রশংসনীয়, এটি এখন দেশব্যাপী বিস্তৃত হচ্ছে সেখানে সাফল্য আসলে বাংলাদেশ নিয়মশৃঙ্খলায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করবে। আশা করা যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়িত শক্তির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখবে।
বলতে দ্বিধা নেই ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ পড়েছে। কেননা বিশ্ব অর্থনীতি বেশ সংকটের ভিতর দিয়েই চলছে। বাংলাদেশে এর অভিঘাত কম পড়েনি। তারপরও আমাদের অর্থনীতি এখনো আগের গতিধারায় চলছে- এটি আমাদের জন্য হয়তো সুখের বলা চলে। তবে ব্যাংকিং, শেয়ারবাজার, বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বছরটি তেমন সুখের বলা চলে না। প্রয়োজন এ খাতগুলোতে আরো মনোনিবেশ করা। তাহলে ২০২০ সালে আমাদের অর্থনীতি কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি লাভে সক্ষম হতে পারে।
২০২০ সাল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি নতুন আশাবাদের সাল হিসেবে অনেক আগেই সবার মনে জায়গা করে রেখে আছে। বছরটি মুজিব বছর হিসেবে ঘোষিত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালিত হবে। এই পালনটি তখনই আমাদের কাছে সুখের হবে যখন আমরা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের অগ্রগতি আরো সাফল্যের ধারায় এগিয়ে নিতে সক্ষম হবো, একইসঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা সাংস্কৃতিকভাবে আমরা ২০২০ সালে আরো বেশি সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবো। ২০২০ সালের শুরুতেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিজয় নিশ্চিত করা গেলে মুজিব বছরের ভাবাদর্শের প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। সে লক্ষ্যেই রাজনীতি সচেতন মহলকে মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে। ২০২০ সাল যেন সেসব আশাবাদের স্ফুরণ ও বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় সেই লক্ষ্যেই সরকার ও রাজনীতি সচেতন মহলকে কাজ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক