60

‘ইনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।’
দশ বছরের অপরাজিতা থ হয়ে গেল। সে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা কী বলছো তুমি! ইনি তো ভিক্ষুক। ভিক্ষুক আবার মুক্তিযোদ্ধা হয় কীভাবে?’
বাবা বললেন, ‘কোনো ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল কি না জানি না, তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুক হয়ে গেছেন। আমাদের দেশে এমন অনেকেই আছেন যারা নানা কষ্ট করে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়ে মারা গেছেন। আমরা তাঁদের জন্যে তেমন কিছুই করতে পারিনি মা।’
অপরাজিতা কৌত‚হলী দৃষ্টিতে ভিক্ষুকটার দিকে তাকিয়ে রইল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কাঁধে বন্দুক নিয়ে ছোটাছুটি করছেন এবং প্রচণ্ড আক্রোশে গুলি করে শত্রুদের হত্যা করে চলেছেন; এমন সব দৃশ্য অপরাজিতার মনে আলোছায়ার মতো খেলা করতে লাগল। এই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কেন জানি তার অসম্ভব দরদ আর শ্রদ্ধা জেগে ওঠেছে।
অপরাজিতা তার বাবাকে আবদার করে বলল, ‘বাবা আমি এখন এই মুক্তিযোদ্ধাকে পা ছুঁয়ে সেলাম করব।’ বাবা তাকে একটা হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ভিক্ষুকের পা ছুঁয়ে সেলাম করবে তুমি? লোকজন দেখলে কী বলবে, শুনি?’
এ কথা বলেই তার বাবা অপরাজিতাকে টেনে নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলেন।
অপরাজিতা চিৎকার করে বলছে, ‘তুমি না বললে, ইনি মুক্তিযোদ্ধা! তাহলে আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে এলে কেন?’ বাবা বললেন,‘ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তা ঠিক আছে। কিন্তু যিনি ভিক্ষা করেন তার আর কোনো পরিচয় থাকে না, সব মুছে যায়। এ পেশার মানুষকে কেউ মানুষ বলেই তো স্বীকার করে না; সেলাম করবে কোন সাহসে!’
পরের দিন স্কুলে গেল অপরাজিতা। স্কুল গেটে ছাত্র-ছাত্রী আর অভিভাবকদের ভিড়। সে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সোজা ভিক্ষুকের পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে সেলাম করতে লাগল। ভিক্ষুক বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে কৃতজ্ঞতার হাত বুলিয়ে দিল অপরাজিতার মাথায়। এ অপূর্ব দৃশ্য দেখে মুহূর্তে ভিড় জমে গেল। সবাই হতবাক!
‘মেয়েটি এমন করল কেন? কী হয়েছে তার? ভিক্ষুকের পায়ে পড়ে সেলাম! মাথা ঠিক আছে তো মেয়েটির!’
তার চারপাশে কৌত‚হলী লোকের ভিড় জমে গেল। ছাত্র ছাত্রী ও অভিভাবকদের অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে গেল অপরাজিতা। সে কার প্রশ্নের কী জবাব দিবে এর কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
কে একজন ফোন করে অপরাজিতার বাবাকে বলছে, ‘হ্যালো, আপনার মেয়ে স্কুল গেটে এ্যাবনরমাল আচরণ করছে, তাড়াতাড়ি চলে আসুন।‘
অপরাজিতার কান্না থামছে না। তার পিতা-মাতা ছুটে এসে তাকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেল। অপরাজিতার বাবা আদর করে বললেন, ‘এমন নিসপিস করছ কেন, মা। খারাপ লাগছে তোমার?’
অপরাজিতা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘খুবই খারাপ লাগছে বাবা। আমি এখন কাঁদব। মন খুলে কাঁদব। কাঁদলে আমার ভালো লাগবে। তোমরা আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ।’
কিছুদিন পরে অপরাজিতা স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিল। স্কুলগেটে গিয়েই তার বুকটা ধক্ করে উঠল। সেই ভিক্ষুকটি আর সেখানে নেই। তার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে।
অপরাজিতা এক মহিলা ভিক্ষুককে বলল, ‘আপনি কি দয়া করে বলবেন, এখানে দাঁড়িয়ে যে লোকটি ভিক্ষা করতেন তিনি এখন কোথায়?’ মহিলাটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অভিমানের সুরে বলল, ‘কোথায় আবার, গত পরশু না হ্যায় মারা গেছে। বড় বালা মানুষ আছিল গো, অভাবের জ্বালায় তার বউ-পোলা-মাইয়ারা হেরে ছাইড়া কই জানি চইলা গেছে। দেশের জন্যি যুদ্ধ করিছে বেটায়, গুলি খাইয়া তার এক পাও আর এক হাত অচল অইয়া গেছে। এহন হ্যার কোনো দাম নাই। হ্যায় খাইছে ভিক্কা কইরা। আমি তারে কইছিলাম, “তুমি না মুক্তিযোদ্ধা। সরহার ট্যাহা দেয়, যাওনা ক্যান?” হ্যায় কয় কি,“আমি যখন সব হারাইয়া পথের ভিক্ষুক অইয়া গেছি এহন আর কাউকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিমু না।” একটানে কথাগুলো বলে মহিলাটি আঁচলে চোখ মুছতে লাগল। অপরাজিতার সারাটা শরীর মায়ায় ভরে গেছে। কষ্টগুলো তার গলায় গিট পাকিয়ে আছে। তার চোখভরা জল ছলছল করছে। অপরাজিতা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওনাকে কবর দিয়েছে কোথায়?’ মহিলাটি বলল, ‘ফহিরগো আবার কব্বর। হেরে ওই সেতুডাঙ্গার ঢালে কব্বর দিয়া সাইনবোট লাগাইয়া দিছে।’
অপরাজিতা মহিলাকে নিয়ে ছুটে গেল কবরের পাশে।
সেতুডাঙ্গার ঢালুতে একটি মাত্র কবর। চারকোণে চারটা খেজুরের কাঁচা ডালা কোপানো। কবরের শিথানে কাঠিতে ঝুলানো আছে এ্যাবরো-থ্যাবরো টিনপ্লেট। প্লেটে আনাড়ী হাতের লেখা। এতে আছে- ‘মৃতের শেষ ইচ্ছায় লেখা- “কেউ আমাকে না চিনলেও সেদিন স্কুলগেটে একটি ছোট্ট মেয়ে আমাকে চিনেছিল। সে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আমার পা ছুঁয়ে সেলাম করেছিল সেদিনই আমি আমার স্বীকৃতি পেয়ে গেছি। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আমার সমস্ত কৃতিত্ব আর অহংকার সেই ছোট্ট মেয়েটিকে উৎসর্গ করলাম!”
লেখাটি পড়ে অপরাজিতার ফোঁটা ফোঁটা অশ্র গড়িয়ে পড়ল কবরের মাটিতে। সে দু‘হাত তুলে মোনাজাত করছে- ‘হে প্রভু! একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা তাঁর অর্জিত সমস্ত কৃতিত্ব আর অহংকার আমাকে উৎসর্গ করে গেলেন, আমাকে তার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করার শক্তি দাও। আমরা তাঁর কোনো মর্যাদা দিতে পারিনি। তুমি তাঁর উপযুক্ত মর্যাদা দিও। এতদিন তিনি যা গোপনে লালন করেছিলেন, আমি যেন তার চেতনা সবলে প্রকাশ করতে পারি।” মহিলা ভিক্ষুকটি ‘আমিন!’ ‘আমিন!!’ বলে চিঁ চিঁ করে কেঁদে উঠল।
অপরাজিতা চোখ মুছে কবরটা সামনে রেখে স্থির হয়ে শক্তপায়ে দাঁড়াল এবং সে সামরিক কায়দায় সেল্যুট করল। অতঃপর অপরাজিতা বীরমুক্তিযোদ্ধার সমস্ত কৃতিত্ব আর চেতনা বুকে ধারণ করে সগর্বে চলে গেল বাসায়। সামনে তার অনেক কাজ!