73

আষাঢ়। রিমঝিম বৃষ্টি। গাছে গাছে ত্থোকা ত্থোকা ফুটেছে কদম ফুল। এ বৃষ্টির দিনে কদম ফুল কুড়িয়ে পথপ্রান্তরে খিল-খিল হেসেমেতে দৌঁড়ে পথকলি বালিকারা। পেছনে পেছনে জলপাই রঙের পোশাক পরিহত এক ব্যক্তিও তাড়া করে; কিন্তু তারাতো চোর নয় তারাতো ফুলওয়ালী। অবস্থা এমনই ঠেকেছে মনে হয় না; বালিকারাও গা ঢাকা দিতে কি প্রাণপণ প্রচেষ্টা…
আষাঢ়ে কদমফুল কাব্যভাবনাও জেগে ওঠে। ‘জাগে রঙ্গণা-অঙ্গনার ভ‚ষণ, মল্লিকার অপরূপ যৌবন, চির উথলা হয় অঙ্গের কাঁকন হ্যায়, বারিত বর্ষানো কদম ফুলে…
স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সুন্দরী-ললনারা বেনিতে গোঁজে কদম ফুল। রাজধানীর হাইকোর্টের মাজার, দয়েল চত্বর, সোহরায়ার্দী উদ্যান, জাতিয় গ্রন্থকেন্দ্রের সম্মুখে, বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গন, টিএসসি চত্বর, অপরাজয় বাংলা, মধুদার কেন্টিন, লাইব্রেরীর আশেপাশে এবং সাহবাগ এলাকায়-যেন ফুল বিকিকিনির হাট বসে। সৌরভিত তন্বিতরুণেরাও ছুটে বাহিরে প্রাণে…
চতুর্দিকে চলছিল কড়াকড়ি নজরদারী। ঘাতকরা কেড়ে নিয়েছে এক মুক্তমনা লেখকের প্রাণ। তাই বলে কি তরুণদের তাড়াবে ; না, এটি অন্যরকম কাহিনি! শুধু এক লেখক প্রাণ হারাননি, প্রথাবিরোধী এক কবিও চাপাতির কষাঘাতে কালক্রমে প্রাণ হারান। আশ্চর্যজনকভাবে এসব লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেই চলেছে। মিল্টন কিংবা বিল্পব সুদুর লন্ডন বা সাইপাস থেকে বাংলাতীর্থ হিসেবে খ্যাত ‘অমর একুশে বই মেলা’য় ছুটে আসে। কিন্তু ওই পথ অতিক্রম করতে গিয়ে তরুণদ্বয়ের বুকও কেমন ধরপড় ধরপড় কেঁপে ওঠে। তারা এসকল অজানা ঘাতকদের ভয়ে থমকে যান এক কদমও এগোতে পারেনা; শুধু এ অনভিপ্রেত ঘটনায় বিগত কয়েক বছর তারা দেশে ফিরে নি। এবার মনে মনে মহাপরিকল্পনা আঁকেন। অন্তত অমর একুশে বই মেলাকে ঘিরে দেশে যাবে এবং স্বজনদের সাথে দেখা করবে, সে অন্যরকম মজা… প্রিয় দেশের মাটি মায়ের মতো পবিত্র এখন দেশে শান্তির সুবাতাস বইছে। লেখকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশকিছু প্রদক্ষেপও নিয়েছে। তাই, আইনশৃঙ্ঘলাবাহিনির এই বিশেষ টহল।
তারা দিগি¦দিক দেখে ‘টুপ’ করে বের হয়ে পড়ে। ‘ফুল নেবেন ফুল, আপা কদম ফুল, বাসি না; ক্ষণিক আগে পেড়েছি। দেখেন এখনো কেমন টাটকা। দাম আপনি যা দেন;’ ‘আহ্! যাওতো ফুল নেব না!’ বিরক্তির সাথে বলেন তিনি।
আপা নেন, বাসার ছোট আপার জন্য হলেও নেন।
নেব না বলছি তো।
একেবারে নাছোরবান্দা একদম ছাড়ার নয়; যাকে একবার ধরেছে বিক্রয় করেই ছেড়েছে। সামনে তীব্র যানজট, গাড়ি ধীর-ধীরে চলায় তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা জন্ম নেয়। তারাও গাড়ির সঙ্গে তালমিলিয়ে সমানে চলে। আবারও বলে, ‘নেন আপা;’
তারা এভাবে আকুতি-মিনতি করেই যাচ্ছে। এবার কিন্তু বেগম সাহেবা স্তিমিত-চুপ হয়ে যান। পাশে বসা সাহেবও মুচকি-মুচকি হাসেন। তিনি শেষতক তরুণদের আকুতি দেখে বেগম সাহেবার উদ্দেশ্য বলেন, ‘ইচ্ছে করলে নিতে পার;’ ‘আমি ফুল দিয়ে কি করবো?’ বেগম সাহেবার এ প্রত্যুত্তরে সাহেব আবারও বলেন, ‘না, তারাবানুর জন্য হলেও নাও।’
তার কি খেলা করার সময় আছে? সকাল থেকেতো এটা-ওটা করে চলে।
আহ্; ওরা এমন করে বলছে যখন…
আমি কি না নিতে বারন করছি?
‘শোন, দু’টো দাও। কত দাম? ড্রাইভার একটু আস্তে চালাও তো।’ সাহেবের এই প্রত্যুত্তরে তারা বলে, ‘স্যার, আপনি যা দেন।’
এ তো মহা ঝামেলা; তিনি ফুলওয়ালীদের এ প্রত্যুত্তরে মনে-মনে এসব ভাবতে লাগলেন। শেষতক সাহেব বিরক্তির সাথে ব্যাগ থেকে একটা একশ’ টাকার নোট বের করে দিয়ে দ্রুত গাড়ির কাঁচ ওঠিয়ে দিলেন। তারাও মেলা খুশি কচকচে নতুন একশ’ টাকার নোট পেয়ে। বার বার নোটটি নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে।
‘পিপিপ-পিপ’ শব্দে হুঁইশেল বেজে ওঠে। তারাও ‘টুপ’ করে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে, গাছের আড়ালে, সোহরায়ার্দী ওদ্যানে লুকিয়ে পড়ে। অনেকটা লুকোচুরির খেলার মতো; এভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ আড়ালে থেকে আবারও উঁকি দেয়। পুলিশ নাগালের বাহিরে অদুরে দেখে আবারও ‘টুপ’ করে বের হয়ে যথাযতভাবে শুরু করে… কোন পথিক বা কপোত-কোপতি দেখা মাত্রই দৌঁড়ে গিয়ে হাজির; তারা যেন এ ক্ষেত্রে বহু অভিজ্ঞ, কারা ফুল নেবে কি নেবে না। তারা এ-ও জানে, মেয়েদের পয়সা-কঁড়ি একটু কম থাকে; থাকলেও বা তারা তেমন একটা বেহুদা খরচপাতি করতে চায় না! কিন্তু ছেলেরা লজ্জায় পড়ে যায় কি-না…
এবার হেঁটে যেতে দু’তরুণ-তরুণকে সামনে দিকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেল। অমনি এক-পা দু’পা দৌঁড়ে গিয়ে হাজির। ‘আপা-ভাইয়া নেন কদম ফুল।’ তারা ফুল বাড়িয়ে দিয়ে এই কথা বলে।
‘এখন গাছ থেকে পেড়েছি, ভাইয়া, আপাকে এক ত্থোকা কিনে দেন-না; আপাকে খুব সুন্দর লাগবে! ভাইয়া, কিনে দেন না।’
‘কি নেবে?’ ছেলেটি সহপাঠী মেয়েটির উদ্দেশ্য বলে। মেয়েটি হেসে বলে, ‘আরে-না।’
‘নাও-নাও। এ শোন কত টাকা দাম?’ সে সহপাঠী কে একথা বলে তাদেরকেও ফুলের দাম জিজ্ঞেস করে।
ফুলওয়ালীরাও দুরন্ত-চালাক; কিন্তু বেশি দাম বলেনি। বুঝতে পেরেছে ওরা এখনো ছাত্র পকেটে তেমন একটা টাকা থাকে না; বলে, ‘পঞ্চাশ টাকা।’
‘দুর, বিশ টাকায় দেবে?’
ভাইয়া, হবে না। আচ্ছা, ত্রিরিশ টাকা দেন।
বিশ টাকা হলে দাও।
না ভাইয়া, বিশ টাকা হবে না; ত্রিরিশ টাকা দিতেই হবে।
এভাবে কথোপকথন বলতে বলতে পিচু নেয় ফুলওয়ালীরা। তারা যেন বেচেই ছাড়বে। আবারও বলে, ‘দেখেন, এক সাহেব একশ’ টাকা দিয়েছেন! আপনাকে ত্রিরিশ টাকা দিতেই হবে।’ ‘আমিতো আর সাহেব না।’ সেও তাদের প্রত্যুত্তর বলে।
ফুলওয়ালীদের এমন আকুতি-মিনতি দেখে সহপাঠী মেয়েটি ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে দেয়।
‘আহ্; তুমি কেন দিচ্ছ আবার। রাখো-রাখো আমি দিচ্ছি।’ সে এ বলে পকেট থেকে একটি দশ টাকার নোট বের করে দেয়। ফুলওয়ালীরা হাত বাড়িয়ে নেয় আর মনে মনে হাসে। তাদের একজন মাবিয়া বলে, ‘আপা দেন খোঁপায় পরিয়ে দিই!’ ফুলওয়ালীর এই কথায় মারিয়াও বলে, ‘না, তোমাকে তা করতে হবে না; তোমরা এখন যাও।’
প্রেমিক যোগল একে অপরের চোখে-চোখ রেখে স্থির তাকিয়ে রইল। তারা হাসে;
‘আচ্ছা আমাকে দাও, খোঁপায় পরিয়ে দিই।’ সহপাঠী মেয়েটিও বারণ করেনি।
সে কি রোমাঞ্চকর অনুভ‚তি…যেন প্রেমের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন! ওড়না কামড়ে-কামড়ে পুলকিত মনে হাসে আর এসব ভাবে। অবশ্য এটি এখানকার জনপদের নতুন কিছু নয়; কিন্তু তাদের বেলায় একেবারেই নতুন। ছেলেটিও ফুলের কান্ড থেকে পাতা ঝরাতে-ঝরাতে ভাবে, যাক জীবন আজ সার্থক; সত্যি, এটি একটি দূর্লভ মুহূর্ত, মারিয়াও ফুলে-ফলে একাকার। এই যেন হলদে রঙের পাঁপড়ির মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে দিগন্তজুড়ে। অন্যরকম মায়ার টান, নবান্ন ও বসন্তের ভালোবাসা জাগে ক্ষণে-ক্ষণে…
মাবিয়ার সঙ্গি ইছমত আরা বলে, ‘মাবিয়া ওই দেখ-দেখ কে দৌঁড়ে আসছে।’ মাবিয়াও একথা শোনে বিচলিত হয়ে ওঠে। সে দেখে, ‘সত্যি তো সামনের দিকে এগিয়ে আসছে ওই লোকটি; ‘ঘুম-ঘুম’ বাতাসে ভেসে আসছে একাত্তের দানবদের মতো বুটজুতোর আওয়াজ। তারা দৌঁড়ে পালাতে চেষ্টা করে। মাবিয়ারও যৌবন ও রূপ উপছে পড়ছে ফুলের মতো। মুখে তার ‘খিল-খিল’ মুক্তঝরা হাসি। না, বেশিদুর এগিয়ে যেতে পারেনি। এমনি ঈগলের মতো ছোঁ মারে। মলিন হয় বৃত্তের যতসব কদম ফুল ; শুধু আর্তনাদ আর ক্রন্দনের প্রতিধ্বনি বাতাসে বয়ে বেড়ায়।
ফুল ব্যবসা তো তাবৎ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের একটি, এবং পবিত্রতমও বটে… একবার ভাবুনতো, দেশীয় জাতের একটি ছোট্ট গোলাপের সরু পাঁপড়ি অর্থাৎ মাছির পাখার মতো পাতলা… বাতাসে তার ওড়ে সুগন্ধি মৌ-মৌ ঘ্রাণ।