41

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভ‚তপূর্ব উন্নতির এ যুগে সভ্যতার ক্রম স¤প্রসারণ ও মানুষের দর্শন-মনন-প্রজ্ঞার অপরিসীম বিস্তৃতি ঘটেছে বিপুলভাবে। পাশাপাশি মানুষে মানুষে হিংসা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অভাবনীয় স্খলন-পতন-বিভেদ-বিদ্বেষ-বিপর্যয়-বীভৎস কার্যকলাপ ইত্যাদি তামসিক উল্লাসে প্রচন্ড ভাবে ব্যাহত করছে শুভচেতনা, নৈতিক মূল্যবোধ। মানুষ আজ দিশেহারা। এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে আমরা শঙ্কায় অতিক্রম করছি জীবনের প্রতিটা ক্ষণ। প্রতিটি দিনকে মনে হয় ভয়ঙ্করতম দিন। এমন আতঙ্ক ও সংকট যেন আগে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। প্রতিদিন মনে হয়, জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা-সভ্যতার অস্তিত্ব বোধ হয় শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রমশঃ নিষ্ঠুরতম অমানবিক কর্মকান্ডে মানবজাতি বেশি পরিমাণে উৎসাহী হয়ে পড়েছে। রক্তলোলুপ জিঘাংসু বাহিনীর বর্বরোচিত সন্ত্রাস প্রতিসন্ত্রাসে সভ্যতার শরীর জুড়ে রক্তের আলপনা। প্রশ্ন জাগে মনে আমরা কোন সভ্যতায় বসবাস করছি। একবিংশ শতকে আমরা কি এ আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সভ্যতার কাছে চরম নৃশংসতা প্রত্যাশা করেছি। এর জবাব কি আছে? সংঘাত সহিংসতায় নিমজ্জিত গোটা পৃথিবীর শান্তি ও নিরাপত্তা বর্তমান সময়ে বিপন্ন। সা¤প্রতিক সময়ে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজের সময় দুটি মসজিদে একযোগে সশস্ত্র আক্রমণে মসজিদে ৫০ জন নিহত হওয়ার ৩৫ দিনের মাথায় ক্ষতচিহ্ন মুছে যাওয়ার আগেই খ্রিস্টানদের পবিত্র ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় ঘটে গেলো উগ্রপন্থিদের একযোগে হামলা। উন্মত্ত হিংস্র থাবায় পৃথিবীজুড়ে আজ রক্তের হোলিখেলা চলছে। মানবিকতা ভ‚লুণ্ঠিত হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কা নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে প্রতিটা দিন, ক্ষণ পার করছে। মানুষই জ্ঞান-বিজ্ঞানে আজ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেলে ও কিছু মানুষের জিঘাংসার হিংস্র থাবায় পৃথিবী আজ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। এমনি এক কঠিন সময়ের আবর্তনে সংঘাতময়, অশান্ত ও অসহিষ্ণু বিশ্বে এলো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এবারের বুদ্ধ পূর্ণিমা। যে বুদ্ধ পূর্ণিমা মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবনের ত্রয়ী ঘটনার সমারোহে অবিস্মরণীয় ও মহিমান্বিত। এ পূর্ণিমা তিথিতেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম , সম্বোধি ও মহাপরিনির্বাণ ঘটেছিল। প্রকৃতি, মানুষ ও জীব স¤পর্কে তাঁর উপলব্ধি, তার শিক্ষা-জীব হত্যা মহা পাপ, অহিংসা পরম ধর্ম সর্বকালে সর্বমানবের জন্যই অনুসরণীয়। রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ও সংসারের ভোগবিলাস ত্যাগ করে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন সাধারণ মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজতে। সুদীর্ঘ ৬ বছর তিনি কঠোর সাধনা করেন, অন্বেষণ করেন মানবমুক্তির প্রকৃত পথ। সংসার চক্রের আবহমান জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণায়মান চক্রব্যূহের আদি-অন্তের সন্ধান ও মুক্তির পথ নির্মাণে তিনি গহীন বনের অভ্যন্তরে ছয় বছর কঠোর সাধনা করেন। অবশেষে নিরঞ্জনা নদী তীরবর্তী অশ্বত্থ তরুতলে ৩৫ বছর বয়সে বৈশাখী পূর্ণিমার জ্যোছনাস্নাত রাতে আত্মউপলব্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে জগত আলোকিত করে মানবমুক্তির পথ আবিষ্কার করেন মহামতি গৌতম। লাভ করলেন বুদ্ধত্ব। অবগত হন জন্ম-মৃত্যুর তত্ত¡, দুঃখরাশির উদয়-বিলয়। অবিদ্যা বা অজ্ঞান ও তৃষ্ণাকে মূল কারণ হিসেবে বর্ণনা করে তার থেকে পরিত্রাণের জন্যে সাধনায় মগ্ন অবস্থায় তিনি উদ্ভাবন করেন চার আর্যসত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। হৃদয়ের গভীর গহন তলদেশ থেকে উঠে এসেছে ঢেউ জাগানিয়া এক অকৃত্রিম আবেশ- একটি স্নিগ্ধ আলোর উষ্ণতা এবং তাঁর উৎসারিত চেতনা- দুঃখ মুক্তির মহাসত্যের সন্ধান। বিশ্বমানবতার বিজয় কেতন ওড়ানোই ছিল তাঁর অভিলাষ। জীবের কল্যাণে স্বোপার্জিত সম্বোধির স্ফ‚রিত বাণী ছড়িয়েছেন বিশ্বময়। তিনি ৪৫ বছর ধর্মপ্রচার করেন। বুদ্ধের কল্যাণের অমিয়বাণীর বহমান স্রোতধারায় মানুষ দুঃখ মুক্তির পথের দিশা খুঁজে পায়। তাঁর বাণী মানুষকে প্রলুব্ধ করেছিল পরিশুদ্ধ এবং শান্তিময় জীবন প্রতিষ্ঠায়। তাঁর মৈত্রী, করুণা আর অহিংসা মন্ত্রের প্রতীতিতে মানুষের চেতনার স¤প্রসারণ ঘটে। পশুত্ব থেকে দেবত্বে উত্তরণ, মনন ও প্রজ্ঞায় উত্তরণ ঘটে। উদ্বেলিত ভাবনার সমৃদ্ধিতে, চিন্তার ঐশ্বর্যে, উদ্দীপনায় মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাসের জাগরণ ঘটে।
বুদ্ধ ছিলেন জীবের মঙ্গল কামনায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পৃথিবীকে সুখী ও শান্তিপূর্ণ করে গড়ে তোলার জন্য তিনি নিরন্তর প্রয়াস চালান। তাঁর চেতনায় ছিল দুঃখ জয়ের মাধ্যমে জীবের মুক্তি কামনা। তিনি চতুরার্য সত্য তত্তে¡ জীবনে দুঃখ, দুঃখের উৎপত্তি, দুঃখ ভোগের কারণ এবং তা থেকে মুক্তির পথ দেখান। বুদ্ধ মানবের মাঝে সঞ্চারিত করেছেন তাঁর অমিয়বাণী- যে বাণী মৈত্রীর, যে বাণী অহিংসার, যে বাণী সর্বজনের কল্যাণের। তাঁরই বাণীর করুণা ধারায় শান্তির সুবিশাল ছায়াতলে আশ্রয়ের জন্য বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আজ আকুতির সীমা নাই। কিন্তু কোথা ও নেই শান্তির সুবাতাস। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইরাক, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশে অশান্তির দাবানলে মানুষের শান্তির স্বপ্ন অঙ্গার হয়ে ছাইভস্মে পরিনত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চমৎকার ভাবে উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন-নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস! বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে হানাহানি-মারামারি, অহিংসার বিপরীতে সহিংসতা, সন্ত্রাস, বর্বরতা। দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে চরম অসহিষ্ণুতা-সংঘাত বিরাজ করছে। মানুষের সমাজ জীবন, ব্যক্তি জীবন থেকে শান্তি তিরোহিত হচ্ছে। আমাদের জাতীয় জীবনেও অস্থিরতার বিরাজ করছে ।
বুদ্ধের মানস যেভাবে জগতের মঙ্গলসাধন করতে চেয়েছিলো, সকল প্রাণীর কল্যাণ চেয়েছিলো তা আড়াই হাজার বছর পূর্বের মতো আজো প্রাসঙ্গিক। এ বিপন্ন সময়ে বুদ্ধের অহিংস বাণীই দিতে পারে শুদ্ধ চেতনার পরশ। বুদ্ধের বাণীসমগ্র কোন বিশেষ স¤প্রদায় বা গোষ্টীর জন্য নয়। পৃথিবীর সমগ্র প্রাণিকুলের জন্য এ ধর্ম। বুদ্ধ মানবতার মুক্তি সাধনে অজেয় এবং একজন শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদি। বিশ্বের এ ক্রান্তিলগ্নে বুদ্ধের আদর্শ অনুসরণের কোন বিকল্প নাই। বর্তমান সময়ে বুদ্ধের প্রতিটি বাণীই হবে একমাত্র শান্তির । শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহামতি বুদ্ধের দর্শন ও জীবনাদর্শ অনুকরণীয়। অহিংস চেতনার বুদ্ধের এ বাণী, চিরকালীন শুভ্র মানস-ভাবনা হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়–ক সর্বজীবের কল্যাণে। মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে প্রত্যাখ্যান করে মানবিক পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে বুদ্ধের মৈত্রী, কল্যাণ এর প্রকৃত চর্চায় আবার জেগে উঠবে মানবকুল অহিংসার মন্ত্রে এবং উজ্জীবিত হবে প্রজ্ঞার মঙ্গলালোকে এ প্রত্যাশা। গৌতম বুদ্ধ নিজের জীবন গড়ে তুলেছিলেন কঠোর তপস্যায়, কৃচ্ছ্রসাধন এবং মধ্যমপন্থায় এক মহৎ জীবনবীক্ষণের আত্মশক্তিতে। তাঁর কর্মযজ্ঞ সবাইকে শুদ্ধ চেতনায় জাগ্রত করবে অনাদিকাল। মৈত্রীর মেলবন্ধনে হিংসা নয় প্রেম, যুদ্ধ নয় শান্তির মঙ্গলধ্বনি অনুরণিত হবে পৃথিবীময়। বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীপূর্ণ অভিবাদন সবাইকে। জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক। শান্তি নেমে আসুক সবার জীবনে।
লেখক : প্রাবন্ধিক