53

রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিলো ডাক সুনীল ভোরে/ শপথের মশাল হাতে/ ছুটে চল নতুন প্রাতে/ বাজা রে অগ্নিবীণা প্রাণে প্রাণে প্রান্তরে/ একুশের অমোঘ বাণী/ দিয়াছে সূর্য আনি/ জীবনের অর্ঘ্য ধোয়া ওই যে ওই রুদ্র আকাশ/ ঝরাবোই স্নিগ্ধ আলো আজি অঝোরে/ অলখের বিড়ম্বনা সাবধান সাবধান/ কোটি কোটি মোরা আজ দীপ্ত প্রাণ দীপ্ত প্রাণ দীপ্ত প্রাণ/ স্বাধীন এই বাংলা আমার/ কোটি প্রাণ শহীদ মিনার/ নেবই নেব, নেবই নেব, নেবই নেব/ আমরা মনের মতো এই দেশ গড়ে…
মায়ের ভাষা বা মাতৃভাষা হচ্ছে সেই ভাষা, যা চেষ্টা করে শিখতে হয় না। মাতৃভাষাকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিঃশেষে প্রাণদান এবং এই আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাতিসত্তার উপলব্ধি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের তাজা রক্তে রাজপথ যখন রঞ্জিত হয়, তখন এ দেশের মানুষ মাতৃভাষাকে নতুনভাবে অর্জন করে। এই অর্জন বাঙালিকে দিয়েছিল অদম্য সাহস; জুগিয়েছিল সীমাহীন প্রেরণা। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘অমর একুশ’ নামে পরিচিত হল। তখন থেকেই একুশের অবিনাশী চেতনা পূর্ব-বাংলার রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়। একুশ থেকেই সৃষ্টি হয় ২১ দফা। এই ২১ দফা একটি ঐতিহাসিক দলিল। ২১ দফা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে জনমনে এতই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে।
বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম- যে চেতনা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ এবং জাতির মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার পথকে বিস্তৃত করেছে। ভাষা-আন্দোলনের প্রভাবে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলাসহ সৃষ্টিশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমাদের জাতীয় চেতনা বিকাশেও ভাষা-আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। ভাষা-আন্দোলন তার বহুমাত্রিক চরিত্র নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ কারণে বাংলা একাডেমি ভাষা-আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০১০ সালের পয়লা ফেব্রæয়ারি বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জাদুঘর উদ্বোধন করেন। ভাষা-আন্দোলন জাদুঘর পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। সেদিক থেকে এই জাদুঘরটি এক অনন্য নিদর্শন।
ভাষা-আন্দোলন জাদুঘরে বাংলা ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস, আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, স্মারকপত্র, ব্যঙ্গচিত্র, চিঠি, প্রচারপত্র, পান্ডুলিপি পুস্তক ও পুস্তিকার প্রচ্ছদ এবং ভাষা শহীদদের স্মারকবস্তু দ্বারা উপস্থাপিত হয়েছে। এছাড়া, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকার প্রচ্ছদ, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র-জনতার বিভিন্ন মিছিলের আলোকচিত্র, অগ্রসরমান মিছিলকে বাধা প্রদানের জন্য সারিবদ্ধ পুলিশ বাহিনী, ধর্মঘট চলাকালে পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত ছাত্রনেতা শওকত আলীকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক হাসপাতালে নিয়ে যাবার ছবি, ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে বক্তৃতারত পাকিস্তানের স্থপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের রাষ্টভাষা আন্দোলনের সম্পর্কে প্রেস বিজ্ঞপ্তি, দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, ভাষা শহীদদের আলোকচিত্র ও পরিচিতি, ভাষা শহীদদের বিভিন্ন স্মারকবস্তু, প্রথম শহীদ মিনারের আলোকচিত্র, প্রভাতফেরির আলোকচিত্র, উল্লেখযোগ্য ভাষা সংগ্রামীদের ছবি ও বক্তব্য, ভাষা-আন্দোলনের প্রথম কবিতা ও প্রথম সঙ্গীতসহ নানা উপকরণ সংরক্ষিত রয়েছে।
স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর যখন দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপ্রেমীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে; ঠিক তখনই স্বাধীন ভূ-খন্ডে বসবাসকারী কোনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অযাচিত মায়াকান্না এবং ভীমরতিও প্রত্যক্ষ করছে নতুন প্রজন্ম। স্বাধীন বাংলায় আর যাদেরই অবস্থান থাকুক না কেন, গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের দোসরদের আমরা কীসের বশবর্তী হয়ে মেনে নিতে পারি? বাংলার ইতিহাসের ক্রান্তিকালে জাতির মুক্তির জন্য কালে কালে যেমন মহানায়কের আবির্ভাব ঘটেছে, তার পাশাপাশি মীরজাফরের অভাব হয়নি শোষকদের কাছে। তবে, ইতিহাসের অমোঘ সত্য ও শিক্ষা এই যে; মীরজাফর আর স্বাধীনতাবিরোধীদের চিরকালই ঠাঁই হয়েছে আস্তাকুঁড়ে।