২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি

86

ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোই অবলোপন করেছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা খেলাপি ঋণকে অবলোপন বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ‘খেলাপি হয়ে যাওয়া যেসব ঋণ দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও আদায় হয় না, তখন ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে আদায় অযোগ্য ঋণের একটি অংশ আলাদা করা হয়। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখানোর লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম মেনে আদায় অযোগ্য ঋণের একটি অংশ অবলোপন করে থাকে। এটি ব্যাংকিং নিয়ম-নীতি মেনেই করা হয়।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক অবলোপন করেছে ৮ হাজার ৪২৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। অগ্রণী ব্যাংক অবলোপন করেছে ৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক করেছে ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা এবং রূপালী অবলোপন করেছে ১ হাজার ১৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পেরে ১৯ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। এর বাইরে অন্যান্য ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ২৯ হাজার ৮৭২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক থেকে যারা টাকা নেন, তারা সময় মতো ফেরত দিলে ব্যাংকগুলোকে অবলোপন করতে হতো না। যেহেতু এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আছেন যারা অনিয়ম-দুনীর্তির মাধ্যমে টাকা নেন ফেরত না-দেওয়ার জন্য, ফলে ব্যাংক সেই ঋণগুলোকে শ্রেণীকরণ করতে বাধ্য হয়। একটা সময় ওই ঋণ মন্দ ঋণে রূপ নেয়। বছরের পর বছর সেই ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলো হয়তো অবলোপন করে। তিনি আরও বলেন, ‘মন্দ ঋণ ব্যাংকের জন্য দুঃসংবাদ। এটা গলার কাটা। কারণ, এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।’ টাকা ফেরত না দেওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা থেকে বেরিয়ে না আসলে এর কোনও সমাধান হবে না বলেও জানিয়েছেন সাবেক এই গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত ৫ বছরে জনতা ব্যাংকের ঋণ অবলোপন বেড়েছে ১২০ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বেড়েছে ২ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ছিল ২ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। গত ৫ বছরে অগ্রণী ব্যাংক ঋণ অবলোপন করেছে ৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল শেষে এই ব্যাংকটির জমানো ঋণ অবলোপন ছিল ৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সোনালী ব্যাংক ঋণ অবলোপন করেছে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ১৫৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে০ এই ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ছিল ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা মেনে তারা ২০০৩ সাল থেকে ঋণ অবলোপন করে আসছেন। ঋণ অবলোপন করতে হলে মামলা থাকতে হয় এবং শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। তবে মামলা ছাড়াই ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের সুযোগ রয়েছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। ৫ বছর পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণই রয়েছে ৮২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৪ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা মন্দ ঋণ অবলোপন আছে আরও প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। পুনঃতফসিল হওয়ায় ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর ঋণের অর্থ আদায় করতে পারছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থ সংকটের কারণে খেলাপির বিপরীতে মান অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না সরকারি-বেসরকারি ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এই তালিকায় সরকারি খাতের চারটি ও বেসরকারি খাতের আটটি ব্যাংকের নাম রয়েছে।