৯ ভাগে ৭৫ দফা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ডা. শাহাদাতের

41

নিরাপদ, সাম্য-সম্প্রীতির নান্দনিক চট্টগ্রাম শহর উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে (চসিক) বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। ইশতেহারে ৯ ভাগে মোট ৭৫ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। গতকাল শনিবার দুপুরে নগরীর জামালখানে একটি রেস্টুরেন্টে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন ধানের শীষের প্রার্থী। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ঘোষণা করা ইশতেহারে জলাবদ্ধতা নিরসনকে প্রধান প্রতিশ্রুতি হিসেবে রাখা হয়েছে।
ডা. শাহাদাতের প্রতিশ্রুতিতে রয়েছে, জলাবদ্ধতামুক্ত চট্টগ্রাম, স্বাস্থ্যকর চট্টগ্রাম, শিক্ষাবান্ধব চট্টগ্রাম, গৃহকর ও আবাসন সুবিধা, পরিচ্ছন্ন চট্টগ্রাম, নিরাপদ চট্টগ্রাম, সাম্য-সম্প্রীতির চট্টগ্রাম, নান্দনিক পর্যটন নগর এবং তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম গড়া।
নির্বাচনী ইশতেহারের দফার রাজনীতিতে এগিয়ে গেলেন ডা. শাহাদাত হোসেন। অতীতের সকল মেয়র প্রার্থীর ইশতেহারকে ছাড়িয়ে ৭৫ দফা প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসলেন। এর আগে গত সিটি নির্বাচনে ৫৪ দফা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র পদে লড়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম। তিনিও জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করাকেই প্রধান অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। তবে ডা. শাহাদাত হোসেন জলাবদ্ধতা সমস্যার পাশাপাশি নিরাপদ, সাম্য-সম্প্রীতি, পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষাবান্ধব, তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ, নান্দনিক পর্যটন নগরী গড়ার অঙ্গীকার যোগ করেছেন।
‘চলো সবাই বাঁধো জোট এবার দেব আমার ভোট’ স্লোগানে দেওয়া ইশতেহারের শুরুতে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, মানবসেবার অন্যতম মাধ্যম চিকিৎসা সেবাকে নিয়েছি পেশা হিসেবে। রাজনীতি করছি অসহায় আর নিপীড়িত জনতার পাশে থাকতে। কতটুকু পেরেছি, তার বিচারের ভার আপনাদের হাতে। রাজনীতিতে নিজেকে নেতা নয় কর্মী মনে করি। নগরপিতা নয়, নগর সেবক হতে চাই।
‘অবাস্তব প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি নয়, প্রয়োজন ত্রূটিহীন পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে অভিজ্ঞতা, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর যৌক্তিক আকাক্সক্ষা এবং সততা ও দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতা।’ যোগ করেন ডা. শাহাদাত।
নির্বাচিত হলে সাবেক সকল মেয়রসহ এক্সপার্টদের সঙ্গে নিয়ে সুপারিশক্রমে জলাবদ্ধতা, যানজটমুক্ত, আধুনিক নগরী গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, একটি পরিচ্ছন্ন নগর এবং নগরবাসীর উন্নত জীবন গড়তে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা, নগরের সৌন্দর্য্যবৃদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ, নাগরিক বিনোদন, কর্মসংস্থান, পরিবেশ দূষণ ও ভেজালমুক্তকরণ, টেন্ডারবাজী ও চাঁদাবাজমুক্তকরণ, সর্বপ্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ, সর্বোপরি কর্পোরেশনের সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সুষম বন্টন এবং নগরবাসীকে অন্যায্য কর আরোপ হতে ভারমুক্ত রাখাসহ প্রভূত উদ্যোগ জরুরি। অবৈধ দখল উচ্ছেদ, স্বজনপ্রীতিমুক্তকরণ এবং জলাবদ্ধতা নিরসন চ্যালেঞ্জ-উত্তরণে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ইশতেহারের প্রথম অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন ‘জলাবদ্ধতামুক্ত চট্টগ্রাম’। এই অধ্যায়ে সাত দফা প্রতিশ্রæতি দেন ডা. শাহাদাত। জলাবদ্ধতা নিরসনে সব খাল উদ্ধার করে খনন করা, পানি চলাচলের ব্যবস্থা করা, বর্ষার আগে প্রতিবছর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাল, নালা-নর্দমা সংস্কারসহ পানি চলাচলের উপযুক্ত করা, ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, কর্ণফুলীতে যাবার আগে পানি রিসাইক্লিং করা, কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা ও পাহাড় কাটা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি উঠে আসে।
‘স্বাস্থ্যকর চট্টগ্রাম’ অধ্যায়ে ১৫ দফা প্রতিশ্রুতি উস্থাপন করা হয়। বিশেষায়িত ট্রপ্রিক্যাল হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ করা, সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত হাসপাতালগুলোর সেবা বাড়ানোর সঙ্গে শয্যাসংখ্যা বাড়ানো, কোভিড-১৯-সহ সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা, মশক নিধনে আধুনিক বায়োলজিক্যাল মেথড বাস্তবায়ন করা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড ভ্যাকসিন প্রদান, স্বল্পখরচে হৃদরোগ চিকিৎসার উদ্যোগ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গরিব ও অসহায়দের বিনামূল্যে সেবা, পর্যাপ্ত ব্যায়ামাগার ও জগিং ট্রাক স্থাপন, মোবাইল মেডিকেল ইউনিট স্থাপন, রিমোট ও ভার্চুয়াল সেবা দেয়া, পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট তৈরি, নিরাপদ সুপেয় পানির প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দেন।
‘শিক্ষাবান্ধব চট্টগ্রাম’ অধ্যায়ে মোট ১১ দফা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অটোমেশনের আওতায় আনা, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস স্থাপন, শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ, কারিগারি ও ভোকেশনাল সেন্টারে আলাদা ভর্তির সুযোগ, ভোকেশনাল শিক্ষা চালু, চসিক পরিচালিত স্কুলে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রাপ্ত সুবিধা স্বল্প সময়ে নিশ্চিত করার মতো বিষয় আসে।
‘গৃহকর ও আবাসন’ অধ্যায়ে নিম্নআয়ের নগরবাসী, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের আবাসন গৃহকরমুক্ত করা, হিজরা, ভবঘুরে ও ভিক্ষকুদের পুনর্বাসন করা, হকারদের সুবিধামতো স্থানে পুনর্বাসন, শ্রমজীবীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে আবাসন সুবিধা প্রদানের মোট ৪ দফা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
‘পরিচ্ছন্ন চট্টগ্রাম’ অধ্যায়ে চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের লোকবল বৃদ্ধি, উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সংযোজন, ডাস্টবিন আধুনিকায়ন, বর্জ্যকে রিসাইক্লিন করে কৃষি কাজের ব্যবহার উপযোগী করা, এলাকার প্রত্যেক ঘর থেকে আবর্জনা সংগ্রহ নিশ্চিত করা, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের মোট ৫ দফা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
‘নিরাপদ চট্টগ্রাম’ অধ্যায়ে মোট ৬ দফা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এরমধ্যে অন্যতম সর্বাক্ষণিক আইটি কমান্ড সেন্টার তৈরি, ওয়ার্ড ভিত্তিক কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবস্থা করা, সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের জন্য উপযুক্ত বিকল্প বসবাসের উদ্যোগ নেয়া।
‘সাম্য-সম্প্রীতির চট্টগ্রাম’ অধ্যায়ে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির মেলবন্ধননে আবদ্ধ করার প্রয়াস এবং মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জা, কবরস্থান, শ্মশান ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার ২ দফা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
‘নান্দনিক পর্যটন নগরী’ অধ্যায়ে মোট ১৭ দফা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে অন্যতম হলো, পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে প্রকল্প গ্রহণ, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন, উন্নত বিশ্বের অনুকরণে বাইপাস সড়ক স্থাপন, স্মার্ট বাস স্টপ নির্মাণ, সৌন্দর্য রক্ষা করে আয়বর্ধক প্রকল্প, ইলেকট্রিক বাস সার্ভিস চালু, দিঘী ও লেকসমুূহকে পর্যটন স্পটে পরিণত করা, সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন ও পার্কি তৈরি, এলাকাভিত্তিক পর্যাপ্ত মাঠ তৈরি, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে বিশেষ ট্রেনিং গ্রহণ, বহুতল পার্কি স্থাপনআধুনিক বাস টার্মিনাল নির্মাণ।
‘তথ্য প্রযুক্তি’ অধ্যায়ে মোট ৮ দফা প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়। এরমধ্যে আইটি পার্ক স্থাপন, কারিগারি ও কম্পিউটার শিক্ষার উদ্যোগ নেয়া, স্কুল-কলেজে ওয়াইফাই চালু করা, অনলাইনে হোল্ডিং টেক্স, জন্ম-মৃত্যু বিনবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ফি ও সাইন টেক্স সরলীকরণ ও সর্বপ্রকার কর ও সেবা অনলাইনে প্রদানের ব্যবস্থা, মেয়রের সাথে নাগরিকের সরাসরি যোগাযোগ, মাদরাসা শিক্ষকদের কমিউটার শিক্ষার অধীনে আনা এবং বাণিজ্যিক রাজধানীর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা অন্যতম।
ইশতেহারে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন নিরাপদ চট্টগ্রাম, সাম্য-সম্প্রীতির চট্টগ্রাম, জলাবদ্ধতামুক্ত, পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষাবন্ধব, তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ, নান্দনিক পর্যটন নগরী গড়তে ধানের শীষে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার আহবান জানান।
ইশতেহার ঘোষণার সময় শাহাদাতের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হাবীবুন নবী খান সোহেল, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশিদ, চট্টগ্রাম নগর কমিটির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহব্বায়ক আবু সুফিয়ান, সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ খানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সুষ্ঠূ ভোটের জন্য সাংবাদিকদের ভূমিকা প্রত্যাশা করে অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে সাংবাদিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের ভোট কেড়ে নেওয়া মানে আপনার ভোট কেড়ে নেওয়া। আপনার আত্মীয়স্বজনদের ভোট কেড়ে নেওয়া। অন্তত চট্টগ্রামবাসী যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে সে ব্যাপারে আপনাদের সজাগ থাকতে হবে।