৮৭ হাজার কোটি টাকার তহবিলের প্রস্তাব বিএনপির

37

জিডিপির তিন শতাংশ, অর্থাৎ ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল ঘোষণা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। করোনা ভাইরাসের সময় অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য এই তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
গতকাল শনিবার (৪ এপ্রিল) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই বিশেষ তহবিল ঘোষণার আহ্বান জানান। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের জন্য কতগুলো পদক্ষেপের প্রস্তাব রাখছি। কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে স্বল্পমেয়াদি, অনতিবিলম্বে, আর সময়ক্ষেপণ না করে। কিছু মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। আমাদের দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য জিডিপির তিন শতাংশ অর্থ সমন্বয়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল ঘোষণা করতে হবে। শাটডাউন প্রত্যাহার হলে নতুন করে একটি সংশোধিত আর্থিক প্যাকেজ দিতে হবে। যেন সব সেক্টরের অর্থনৈতিক কর্মকাÐ সাধারণ ছুটির আগের স্তরে ফিরে আসতে পারে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদি খাতে ৬১ হাজার কোটি টাকা, মধ্যমেয়াদি খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অতিরিক্ত আরও আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে।’ একইসঙ্গে তিনি ২৭ দফা প্যাকেজ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দ্রুত সাহায্য পৌঁছাতে হবে। এর মধ্যে থাকবে দৈনিক মজুরিভিত্তিক গ্রূপ, অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টর, আত্মকর্মসংস্থানকারী, গ্রামীণ ভূমিহীন কৃষক, কৃষি শ্রমিক, মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স, গণপরিবহন শ্রমিক, রোড সাইড ভেন্ডর, সকাল-বিকাল বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে উপার্জনকারী গ্রূপ ইত্যাদি।’
‘দিন এনে দিন খায়’ শ্রমিকদের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, হকার, ভাসমান শ্রমিক, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সিএনজি ড্রাইভার, ভাড়াভিত্তিক গাড়িচালক, পরিবহন শ্রমিক, বস্তিবাসী এরা মহামারীর কারণে ঘোষিত লকডাউনে কর্মহীন হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে অনতিবিলম্বে এদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া অপরিহার্য। প্রাথমিকভাবে এপ্রিল-মে-জুন এই তিন মাসের জন্য জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করে অনতিবিলম্বে ঘরে ঘরে গিয়ে অর্থ নগদ পরিশোধ করতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য আশ্রয়হীনদের অস্থায়ী আবাসন ও তাদের দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ন্যূনতম আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ৮০ লাখের বেশি শ্রমিক বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছে। তাদের নগদ সাহায্য দিতে হবে। ছয় মাসের জন্য দুই কিস্তিতে প্রথম তিন মাসের এবং পরবর্তী কিস্তিতে অবশিষ্ট টাকা নগদ দেওয়া যেতে পারে। এ খাতে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে শ্রমিকদের স্ব স্ব অ্যাকাউন্টে কিস্তির নগদ টাকা পরিশোধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নিয়োগপত্র দেখে এদের চিহ্নিত করতে হবে।
সম্প্রতি দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, অনেকেই শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এদের চিহ্নিত করে প্রত্যেক প্রবাসীকে তিন মাসের জন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা আপদকালীন আর্থিক সাপোর্ট দিতে হবে। এ জন্য এ খাতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশি প্রবাসীদের চাকরি সুনিশ্চিত ও তাদের যেন ছাঁটাই না করে তা নিশ্চিত করতে সরকারকে আহ্বান জানান।
স্বাস্থ্য খাত এবং যারা করোনা মোকাবিলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সেসব হাসপাতাল এবং সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন ফখরুল। স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করে আগামী তিন মাসের জন্য প্রতি চিকিৎসকের জন্য এক কোটি, নার্সদের জন্য ৭৫ লাখ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লাখ টাকার বিমার বিপরীতে প্রিমিয়াম সরকার বহন করবে।
জরুরিভিত্তিতে দ্রুতগতিতে পিপিই, করোনা পরীক্ষার কিট ও আনুষঙ্গিক ওষুধ ও দ্রব্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফখরুল বলেন, রাজধানী, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল স্থাপন, চিহ্নিতকরণ, পৃথক কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক/নার্সদের করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন আইসিইউ স্থাপনের জন্য ভেন্টিলেটরসহ উন্নত চিকিৎসা সামগ্রী শুল্কমুক্ত আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।
বয়স্ক নারী, বিধবা, প্রতিবন্ধী, ষাটোর্ধ্ব বয়স্কদের প্রতি মাসে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে আগামী তিন মাস নগদ অর্থ বিতরণ করার প্রস্তাবনা দিয়ে ফখরুল আরও বলেন, এ খাতে আপাতত দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। এ ছাড়া দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারকে আগামী তিন মাসের জন্য বিনা মূল্যে রান্নার গ্যাস, গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার সরবরাহ করতে হবে।
ফখরুল বলেন, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোনও ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ খেলাপি ধরা হবে না। বিএনপি সুপারিশ করেছে, এই সময়কালীন ঋণের সুদ মওকুফ করতে হবে। ইএমআই (ঋণের নিয়মিত কিস্তি) পরিশোধ তিন মাসের জন্য স্থগিত করতে হবে।
সরকারের ব্যয় সংযত করার দাবি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, অপচয় বন্ধ করে সেই অর্থ দিয়ে রফতানিমুখী শিল্প, ওষুধ শিল্প এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিল্পকে আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। বিশেষ করে করনীতির আওতায় করপোরেট করের হার কমানো, আপদকালীন সময়ের জন্য কর মওকুফ করা এবং ব্যক্তিগত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ধফাধহপব রহপড়সব ঃধী আদায় করা বন্ধ করতে হবে। মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থ ব্যয় কিছুটা মন্থর করা যেতে পারে।
আগামী মৌসুমে স্থানীয় বাজারে কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্য কিনে মজুদ করার প্রস্তাবনা দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এ খাতে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার ও দালাল শ্রেণির লোকদের নজরদারিতে রেখে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা এবং উৎপাদন ও সরবরাহ-চেইন নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। অবিলম্বে সরকারকে বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও আইএমএফসহ দ্বি-পাক্ষিক আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের মৌলিক ভূমিকায় ফিরে এসে বিধ্বস্ত ও বিশৃঙ্খল অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যথাযথ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
২৭ দফার সুপারিশ তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের সুপারিশগুলো জরুরিভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, গণমাধ্যমের সাংবাদিক, সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজ্ঞানী, রোগতত্ত¡ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিরলস ভূমিকার প্রশংসা করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বিএনপি মহাসচিব।