১৯৭১ সালে তখন আমি বি.এ ১ম বর্ষের ছাত্র। ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ৭১ এর মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলোতে আমি আমার গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়া থানার আমিলাইশে ছিলাম। আমরা ছাত্র, যুবক, শ্রমিক সকলে মিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন ছাত্রনেতা মাষ্টার শওকত আলী সহ এক শক্তিশালী স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা মাঠে সবাইকে সমবেত করি প্রাথমিক শরীর চর্চা ও অন্যান্য ট্রেনিং সংক্রান্ত বিভিন্ন রকম মহড়াদি সম্পন্ন করেন আমাদের গ্রামের একজন ড্রিল ইন্সট্রাক্টার অধর চন্দ্র নন্দী। নন্দী বাবু এক সাথে প্রায় ১০০/১৫০ জনকে ট্রেনিং দিতে শুরু করলেন। এরই মধ্যে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহবান (তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম)। ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিটি শব্দ আমার মনের গভীরে এক সংগ্রামী শিহরণে এক আলাদা অনুভ‚তিতে আমাকে সদা চঞ্চল ও অস্থির করে তোলে। অবশেষে আমাকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে তোলে। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিব। সেই লক্ষে একদিন গ্রাম ছেড়ে অজানার পথে যাত্রা শুরু করলাম। গ্রাম ছেড়ে যাবার মুহ‚র্তে এখনও চোখে ভাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিশিষ্ট নেতা মোহাম্মদ ভাই, আবু তাহের, মকবুল তাদের অশ্রুসিক্ত ‘খোদা হাফেজ’ বলে বিদায় জানাতে তারা শংখ নদীর পাড় পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিলেন। টিপ টিপ বৃষ্টিতে আমি সন্ধ্যায় নদী পার হয়ে ওপারে বৈলতলী বশরতনগর গ্রামে রাত কাটাই। পরদিন আমাকে নিয়ে ঝরণার বাপ নামে এক ভদ্রলোক চট্টগ্রাম শহরে এসে পৌঁছে। চট্টগ্রাম শহরে এসে বহু খোঁজ করেছি, স্থানীয় কোন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হয়নি। অবশেষে শুভপুর বাসে করে মীরসরাই থানার মিঠাছড়া বাজার নেমে আবুর হাটে গিয়ে পৌঁছলাম ঠিক সন্ধ্যা বেলায়। গোলাবারুদ এর জন্য আবু হাটের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রওনা হবেন ভারতে। তাদের সাথে আমিও যাত্রা শুরু করি। জোরারগঞ্জ তখন পাক সেনার ক্যাম্প। রাত ১২ টার দিকে আমরা জোরারগঞ্জ রাস্তা অতিক্রম করলাম খুব সাবধানে চার্জলাইটের আওতার বাইরে। এভাবে সারা রাত দুর্গম পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে ভোর বেলায় বর্ডার ক্রস করি। সকাল প্রায় ১০-১১ টায় মনুবাজার, ত্রিপুরা মনু থানায় আমাদের নাম এন্ট্রি করলাম।
মুক্তিযোদ্ধা যাদের সাথে আমি ওপারে এসেছি তারা ক্যাম্পে চলে গেলেন। ১ দিন পর এক খোলা ট্রাকে আমি হরিনা ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছি। ট্রাক থেকে নামার সাথে সাথে একটু এগিয়ে এসে প্রথম দেখা পেলাম তৎকালীন সাতকানিয়ার ছাত্র নেতা পরিমল দত্তের। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা জানলেন। এর পর উভয়ে পায়ে হেঁটে ইয়থ ক্যাম্পে চলে আসি। ক্যাম্পে এসে দেখলাম একটা বাঁশের মাচার উপর বসে আছেন তৎকালীন ছাত্রনেতা হাসেম ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোখতার ভাই, কালাম ভাই, রুশ্নি ভাই, সমসু ভাই, ওসমান ভাই, মন্টু দা, ছালাম মাস্টার ও কাজী মন্টু ভাই। তাদের অনুপ্রেরণা ও আমার প্রতি ভালবাসা, আদর স্নেহ আমি কখনও ভুলবো না। পরের দিন আমি আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে আমাদের পরিচিত জনের সাথে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব। পার্শ্বে এমপি হোস্টেল, ঐখানে গিয়ে দেখা হলো আমাদের এলাকার এমপি ডা. বি.এম. ফয়েজ সাহেবের সাথে। দেখি তিনি একটা বাঁশের চাটায় শুয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি উঠে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা।
অবশেষে আমাকে পরদিন ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠালেন। ডা. জাফর সাহেব ও ডা. ফয়েজ সাহেব একই ঘরে ছিলেন। তাদের ঐ দিনের আদর আপ্যায়নকে আমি কখনও ভুলবনা। আমি ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে দেখি বাঁশখালী থানার ৩০ জনের একটি গ্রুপ ভেতরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত। শুধুমাত্র এলএমজি’র অভাবে ঢুকতে পারছে না। অবশেষে গ্রুপ কমান্ডার মোখতার ভাই, পরিমল দার কথা মত আমি ঐ বাঁশখালীর গ্রুপে অর্ন্তভুক্ত হলূম। একই সাথে সহযোদ্ধা হিসাবে যাদেরকে পেয়েছি অসিত সেন, জাফর, সোলয়মান, সনজিত কারণ, জয় হরি সিকদার প্রমুখ। আমি ক্যাম্পে একটি ট্রেন্স এর ভিতরে গিয়ে দেখি সবাইকে টেবিলের উপরে রক্ষিত তালিকায় দস্তখত করে টাকা সহ নিজেদের অস্ত্র গোলাবারুদ বুঝে নিতে। সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ ভাই এর কাছ থেকে ঐ সকল অস্ত্র শস্ত্র, গোলাবারুদ বুঝে নিয়ে আমরা সকলে উপরে অপেক্ষমান লরীতে উঠি। তার আগে শপথ বাক্য পাঠ করান জালাল ভাই। শুনেছি সেই দিন হান্নান ভাই আগরতলা ছিলেন। তাই আমাদের শপথ পড়ালেন জালাল ভাই, শপথ পাঠের পর আমরা লরীতে উঠে সন্ধ্যা বেলায় পাহাড়ী পথ ধরে যাত্রা শুরু করি ২দিন ২ রাত দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে আমরা রামগড় হয়ে ভিতরে ঢুকলাম।
নারায়ন হাটের অদূরে ঝুগ্যার ছালা বাজারের কাছে রাত কাটালাম। ঐ দিন কাছাকাছি একটি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন এ আমরা অংশ নিই। ৮ জন রাজাকারকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হল। পরে তারা তাদের ভাগ্যকে বরণ করে নিল। পরদিন আমরা নারায়ণহাটে এসে দেখি দোকান পাট ২-১ টা খোলা আছে জনমানব শূন্য অবস্থায়। ২-১ জনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়ে কাটিরহাট, নাজিরহাটের দিকে চলে গেছে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক-সেনাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। আমরা প্রায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা পায়ে হেঁটে নারায়ণহাট থেকে বিকাল ৪টায় নানুপুর হাই স্কুলের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এ গিয়ে উঠলাম। তখন নানুপুর স্কুলে প্রায় ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। ঐ রাতে আমরা সবাই একত্রে বিভিন্ন দিকে অপারেশনের প্রস্তুতি নিই। লেফট্যানেন্ট শওকত ছিলেন আমাদের সাথে। পরদিন সকালে ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পার্শ্ববর্তী ধর্মপুর এর পর পানিছাড়া খালের ঐ পারে আবদুল্লাহ পুর পাক সেনারা সকালে এসে নির্বিচারে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করছে এবং ঘরবাড়ি জ্বালাচ্ছে। তাৎক্ষণিক সবাইকে প্রসিড করার নির্দেশ দিলেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজি: লেফট্যানেন্ট শওকত ও গ্রুপ কমান্ডার মোখতার ভাই। তাদের নির্দেশে আমরা সবাই মুহূর্তে হাতিয়ার নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় অগ্রসর হলাম। ধর্মপুর হয়ে একটি পানি বিহীন খাল আছে ‘কংখাইয়া খাল’ বলে ঐ খালের মধ্যেই আমরা সবাই পজিসন নিলাম। এলাকাটা দক্ষিণ ফটিকছড়ি ও উত্তর রাউজানের শেষ ভাগে। পেছনে মটার নিয়ে আমাদের সহযোদ্ধারা প্রস্তুত। প্রায় ৮টার দিকে ফায়ার ওপেন করি। শুরু হল প্রচণ্ড সম্মুখ যুদ্ধ, সামনে একটি ছোট ধান ক্ষেত্র ঐ পারে আব্দুল্লাহ পুর জ্বলছে। এদিকে, পানি বিহীন ‘কংখাইয়া খালে’ আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পজিসান, একটানা গোলা বৃষ্টি চলল প্রায় ১২টা নাগাদ, এরি মধ্যে কোমড়ে রাখা ১৫০ রাউন্ড গুলি শেষ। পেছন থেকে সাদা প্যাকেট ভর্তি গুলি আসতে শুরু করল। আর যায় কোথায় আবার গোলাবৃষ্টি শুরু হল পাকসেনাদের গাড়ী ও পজিসান লক্ষ করে। এভাবে প্রায় ৪টা নাগাদ উভয়ের সরাসরি পাল্টা জবাব। অবশেষে প্রায় ৫টার দিকে পাক সেনাদের পিছু হটার আভাস আসল। সম্ভবত আমাদের মটার আক্রমণ তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
পাকসেনারা পিছু হটার সময় এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে শতাধিক শিশু, বৃদ্ধা, যুবক, নারী, পুরুষ কেউ রক্ষা পায়নি। এমনকি ধানক্ষেতের মাঝেও এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছে। কারণ তাদের ১০-১১ জন পাক সেনা খতম হয়েছে। ৪টি জীপের প্রায় ২০ জনই আহত অবস্থায় হটে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে সন্ধ্যায় প্রায় ৬টায় আমরা বিরামহীন যুদ্ধ শেষে নানুপুর স্কুল ক্যাম্পে ফিরে আসি। আজ মনে পড়ছে জনগণ স্বত্বঃস্ফ‚র্তভাবে ঐ মুহ‚র্তে রুটি, বিস্কুট ও অন্যান্য খাবার দিয়ে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল। আমরা হারিয়েছি আমাদের ৩ জন সহযোদ্ধাকে। এখনও আমার স্মৃতির মনিকোঠায় ঐ দিনের মুহ‚র্ত টুকু স্মৃতিতে অম্লান। ফটিকছড়ির নানুপুর, ধর্মপুর এর জনগণকে আমি আজো ভুলিনি, সেদিন সেই ক্ষণ, সেই চরম মুহ‚র্তটুকু।
লেখক : কমান্ডার
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও অডিট কমান্ড, চট্টগ্রাম