৫ বছরেও অনিশ্চয়তার দোলাচলে বারইপাড়া খাল খনন

115

নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগ নেয় বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খননের। তবে প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের ৫ বছরেরও খালটির খনন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি।
কারণ ডিপিপিতে ‘এলাইনমেন্ট’ ঠিক না করায় শুরুতেই ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতায় পড়তে হয় জেলা প্রশাসনকে। পরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ভূমি অধিগ্রহণের এলাইনমেন্ট ঠিক করে সিটি কর্পোরশেন। তবে ততদিনে শেষ হয়ে যায় প্রকল্পের মেয়াদ এবং তিনগুণ বেড়ে যায় ভূমি অধিগ্রহণের দাম। ফলে তিনগুণ ব্যয় বাড়িয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় প্রকল্প সংশোধন করার জন্য।
দ্বিতীয়বারও প্রকল্প অনুমোদন হয় এবং মেয়াদ ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত। বর্তমানে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা সমাধানের পথে হলেও ভৌত অগ্রগতি শূন্য শর্তাংশ। প্রকল্পের অধীনে ৯ লক্ষ টাকার মোটরসাইকেল কেনার খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো মোটরসাইকেল কেনা হয়নি। এ নিয়ে ৯ বার বিভাগীয় তাগাদা প্রদান করা হয়েছে প্রকল্পটির পরিচালক চসিকের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে। তবুও কোনো অগ্রগতির দেখা মেলেনি।
এদিকে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র মেগাপ্রকল্পের পর খাল খননের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
জানা গেছে, ডিপিপিতে না থাকা তিনটি ব্রিজ নির্মাণ নিয়ে প্রকল্পটি আবার সংশোধন করতে চান প্রকল্প পরিচালক। ফলে আবারও বাড়তে যাচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। ঠিক কবে শুরু হবে প্রকল্পের কাজ সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে না পারলেও চার বছর পর যে প্রকল্প পরিচালক অবসরে যাচ্ছেন তা জানা গেছে।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে তিনটি নতুন খাল খননের প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে একটি বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত। অপর দুটি নয়াখাল থেকে শীতলঝর্ণা এবং মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও আলোর মুখ দেখেনি সেই প্রকল্প।
২০১৪ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে চসিক বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্ষন্ত একটি নতুন খাল খননের উদ্যোগ নেয়। এজন্য সরকার (ভ‚মি অধিগ্রহণের ২২৪ কোটি টাকাসহ) ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রকল্পে ২৪৫ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা সরকার এবং ৮১ কোটি টাকা চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা। ২০১৪ সালের ২৪ জুন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। তবে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নতুন খালটি নগরীর বারইপাড়াস্থ চাক্তাই খাল থেকে শুরু করে শাহ্ আমানত রোড হয়ে নুর নগর হাউজিং সোসাইটির মাইজপাড়া দিয়ে পূর্ব বাকলিয়া হয়ে বলির হাটের পার্শ্বে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়বে। খালটির দৈর্ঘ্য হবে আনুমানিক ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৬৫ ফুট। খালটির মাটি উত্তোলন, সংস্কার ও নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে উভয় পাশে ২০ ফুট করে ২টি রাস্তা ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার কথা রয়েছে।
প্রকল্পের ভ‚মি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর। ওইদিন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বরাবর ভ‚মি অধিগ্রহণের অনাপত্তি ছাড়পত্রের আবেদন করে চসিক। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি জেলা প্রশাসনের কাছে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমের জন্য পত্র দেয় চসিক। সে সময় জেলা প্রশাসন ভ‚মি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করলে দেখা দেয় ‘এলাইনমেন্ট’ জটিলতা। কারণ ডিপিপিতে যেসব জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়, সেখানে অধিগ্রহণ অযোগ্য স্থাপনা থাকায় (মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান ইত্যাদি) গৃহায়ণ লিমিটেড নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ‘এলাইনমেন্ট’ ঠিক করা হয়। যে কাজটি প্রকল্প অনুমোদের আগে করার কথা প্রকল্প পরিচালকের গাফেলতি ও অদূরদর্শীতার কারণে সে কাজ করতে হয় প্রকল্প অনুমোদনের পর। আর এ কারণেই ভূমি অধিগ্রহণের পুরো অর্থ ছাড় হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ওই সময় প্রকল্পের বিপরীতে সর্বমোট ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ছাড় দেয়া হয়। যার পুরোটাই জেলা প্রশাসনকে দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। পুরো অর্থ দিতে না পারায় পরে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম আর এগোয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের ব্যয় চারগুণ বাড়িয়ে সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেকে সে প্রকল্প অনুমোদন হয়। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লক্ষ্য ৫৬ হাজার টাকা। যা প্রথমবারের তুলনায় চারগুণেরও বেশি। দ্বিতীয় দফা প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত। আর মাত্র ৯ মাস বাকি থাকলেও প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি শূন্য শতাংশ।
অন্যদিকে ভূমি অধিগ্রহণের অগ্রগতি ২৫ শতাংশ এগিয়েছে বালে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ভূমি অধিগ্রহণে পাঁচটি এলএ মামলা থেকে দুইটি জেলা প্রশাসন থেকে চূড়ান্ত করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। এর মধ্যে একটি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি তিনটা এলএ মামলাও ভূমি মন্ত্রণালয়ে শীঘ্রই প্রেরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন চসিকের এস্টেস অফিসার এখলাছ উদ্দিন আহমদ।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তৃতীয়বারের মত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে প্রকল্পের বিপরীতে পুরো অর্থ ছাড় হয়েছে চলতি বছরের জুন মাসে। ফলে অর্থ ছাড়ের অজুহাতে প্রকল্প পরিচালকের গাফিলতি ঢাকা দেওয়ার সুযোগ আর নেই। তবে গত বছরের জুন মাসে প্রকল্পের অধীনে ৯ লক্ষ টাকার মোটরসাইকেল কেনার খরচ দেখান প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। কিন্তুএক বছর পেরিয়ে গেলেও মোটরসাইকেলগুলো সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দিতে পারেননি তিনি। এ নিয়ে ৯ বার বিভাগীয় তাগাদা দেওয়া হয়েছে তাকে।
জানা যায়, ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়াও রয়েছে আরও কয়েকধাপের কাজ। যেগুলো বাস্তবায়নেও নেই প্রকল্প পরিচালকের কার্যকর ভূমিকা। আবার মধ্যমেয়াদী মূল্যায়নের নামে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ লক্ষ টাকা। এগুলোরও কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব উপস্থাপন করতে পারেননি প্রকৌশল বিভাগের মাসিক সমন্বয় সভায়। অন্যদিকে ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে স্টেশনারি, ৫৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ডাবল কেবিন পিক আপ, ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে লংবুম এস্কেভেটর এবং ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ড্রাম ট্রাকও কেনার কথা থাকলেও কেনা হয়নি।
এদিকে আবার প্রকল্প পরিচালক অনুভব করছেন ১৮ নং পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে তিনটি ব্রিজ করা প্রয়োজন। যা ডিপিপিতে বরাদ্দ নেই।