৫ দাবি মানলেই মিয়ানমার ফিরতে রাজি রোহিঙ্গারা

58

বাংলাদেশে এখন ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। তার বড় অংশই বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করেছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট। এরপর জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার নানা উদ্যোগের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। বরং রোহিঙ্গারা তখন আট দফা দাবি তুলেছিল প্রত্যাবাসনের শর্ত হিসেবে। এর মধ্যে ছিলো- নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাড়িঘর জমি ফেরত পাবার নিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো। এসব দাবি নিয়ে তখন বিক্ষোভ করেছিল আরাকান রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস সোসাইটি নামের একটি সংগঠন।
এবার আবারও ২২ অগাস্ট প্রত্যাবাসনের একটি সম্ভাব্য তারিখ মিয়ানমারের তরফ থেকে প্রকাশের পর বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, তারাও প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ২২ অগাস্ট ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কাজ করছেন।
এর আগে বাংলাদেশ যে ২২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল, তা থেকে সাড়ে তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গার নাম প্রত্যাবাসনের জন্য নির্বাচন করে বাংলাদেশকে দিয়েছে মিয়ানমার।
তালিকা পাওয়ার পর এসব রোহিঙ্গাদের মতামত যাচাই করার জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে অনুরোধ করে বাংলাদেশ এবং সংস্থার কর্মীরা গতকাল মঙ্গলবার ক্যাম্পগুলোতে সে কাজ শুরু করেছে।
পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের জন্য নির্বাচিতদের যেখানে রাখা হবে ও যেখান থেকে বিদায় দেয়া হবে, সেসব স্থানগুলোতে অবকাঠামোগত প্রস্তুতি আগেই নেয়া শুরু হয়েছে বলে প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রত্যাবাসনের জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট দাবি আছে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন না হলে প্রত্যাবাসনে কেউ রাজী হবেন না।
এক্ষেত্রে এবার পাঁচটি দাবির একটি তালিকা সম্বলিত লিফলেট গত দুদিন ধরে ক্যাম্পগুলোতে প্রচার করছে ‘ভয়েস অফ রোহিঙ্গা’ নামের একটি সংগঠন।
১. রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থানীয় আদিবাসী এবং সে জন্য তাদের ন্যাটিভ স্ট্যাটাস বা স্থানীয় মর্যাদা সংসদে আইন করে পুনর্বহাল করতে হবে যার আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি থাকতে হবে।
২. নাগরিকত্ব : প্রথমত, আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সিটিজেন কার্ড দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে প্রত্যাবাসন করে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে। তৃতীয়ত, একই সাথে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় থাকা রোহিঙ্গাদের সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে স্থানীয় নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে।
৩. প্রত্যাবাসন : রোহিঙ্গাদের তাদের নিজস্ব গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে।
৪. নিরাপত্তা : আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সাথে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
৫. জবাবদিহিতা : বার্মার স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির মতো কোনো ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।
ভয়েস অফ রোহিঙ্গা নামের সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শমসু আলম। তিনি বলছেন, তাদের মধ্যে সক্রিয় আরও অন্য সংগঠনের সাথে আলোচনা করেই তারা এসব দাবি চূড়ান্ত করেছেন। আমরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সভা করেছি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বসেছি। মতামত নিয়েছি। সবাই এসব দাবি আদায়ে একমত হতে রাজি হয়েছে।
তিনি বলেন, এগুলো প্রত্যাবাসনের জন্য তাদের দাবি এবং ৭৫ ভাগ রোহিঙ্গাই এর সাথে একমত। তিনি জানান, সব ধরনের বিদেশী ডেলিগেশন কিংবা বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার কাছেও তারা বারবার এসব দাবি তুলে ধরেছেন, যাতে কার্যকর প্রত্যাবাসন হয় ও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারে।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা বারটার দিকে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের মতামত যাচাইয়ের কাজ করছিলেন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার কর্মীরা।
কুতুপালংয়ে ২৬ নম্বর ক্যাম্পে তাদের সাথে ছিলেন রোহিঙ্গাদের একজন নেতা বদরুল আলম। তিনি বলেন, এখানে ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের দেখভাল করতে আমরা ক্যাম্প ভিত্তিক প্রতিনিধি নিয়ে ৫৫ জনের একটি কমিটি করেছি যে কমিটিতে আমিও আছি। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা, ঘর-বাড়ি ভিটা জমি ফেরত দেয়া ও নিরাপত্তাসহ ৫টি দাবি আমাদেরও।
তিনি বলেন, এসব দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া প্রত্যাবাসনের কাজ সফল হবে না, কারণ নাগরিকত্ব ও স্থানীয় হিসেবে মর্যাদা না পেলে রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরলে সেই আগের মতোই নির্যাতন নিপীড়নের মুখে পড়তে হবে। জাতিসংঘ আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক আর বার্মা সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করুক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে। খবর বিবিসি বাংলার।
পূর্বদেশের উখিয়া প্রতিনিধি জানান, গতকাল মঙ্গলবার টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের ২৬ নম্বর ক্যাম্পে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে রোহিঙ্গাদের মতামত নেওয়ার কার্যক্রম। ১৫ রোহিঙ্গার মতামত নেন ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন ও ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা। এসব প্রতিনিধিকে শর্ত জুড়ে দেয় রোহিঙ্গারা। তাদের দেওয়া শর্ত মানলে মিয়ানমারে ফিরবে বলে জানায় তারা।
মতামত দিয়ে বের হওয়া শালবন ক্যাম্পের ডি-২ এর বাসিন্দা আবু ছিদ্দিক বলেন, আমরা সেই পুরনো দাবিগুলো তুলে ধরেছি। নাগরিকত্ব ও মিয়ানমারের ১৩০ জাতি রয়েছে তাদের মধ্যেও আমরা নেই। সেই দাবিগুলো পূরণ হলে ফিরব।
রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হয়, তাহলে আমরা চ‚ড়ান্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করবো। তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই করবো না। তাই তাদের মতামত নেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, গত বছরের ১৫ নভেম্বর নির্ধারিত সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদে প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারেনি। সে সময় উখিয়ার ঘুমধুম ও টেকনাফের নাফ নদীর তীরে কেরুণতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাট নির্মাণ হয়েছিল।
এর মধ্যে টেকনাফের প্রত্যাবাসন ঘাটে প্যারাবনের ভেতর দিয়ে লম্বা কাঠের জেটি, ৩৩ আধা সেমি-টিনের থাকার ঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। সেখানে ১৬ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।