৫ টাকার ভাড়া ৮ টাকা নিচ্ছে চালক-হেলপার!

84

মুরাদপুর থেকে চকবাজারের উদ্দেশে টেম্পুতে উঠেন শাহেদুল ইসলাম শাহেদ। পাঁচ টাকা ভাড়ার স্থলে টেম্পুচালক নিয়ে নিলো আট টাকা। চালকের কাছে জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠে গ্যাসের দাম বেড়েছে তাই ভাড়া বেশি নিচ্ছি। কিন্তু ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সংশ্লিষ্টরা। এর আগে বৃষ্টিকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন রুটে ভাড়া বেশি নিয়েছিলো গণপরিবহনগুলো। এতে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, এমনকি ছোটখাটো হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
গতকাল রোববার নগরীর আগ্রাবাদ, নিউ মার্কেট, মুরাদপুর, চকবাজার, বহদ্দারহাট, এ.কে খান গেটসহ বিভিন্ন এলাকায় গণপরিবহণে বেশি ভাড়া নেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। সবার একটাই কথা, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি।
সরেজমিনে চকবাজার থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত টেম্পু যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হঠাৎ করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে কোনো নিয়ম না মেনে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন কতিপয় গাড়িচালক। কারণ জানতে চাইলে উল্টো যাত্রীদের উপর ক্ষেপে উঠেন তারা। বৃষ্টি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছেন।
চকবাজার থেকে কোতোয়ালীগামী প্রায় টেম্পু অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। মুরাদপুর থেকে চকবাজার রুটে কিছু কিছু পরিবহন ভাড়া বাড়িয়েছে। তবে কয়েকজন গাড়িচালক আগের নিয়মে ভাড়া নিচ্ছেন। তারা জানান, আমরা কয়েকজন ভাড়া বাড়ালে তো হবে না, সকলে একসাথে পরামর্শ করে ভাড়া বাড়াতে হবে।
বাস হেলপারদের দাবি, গ্যাসের দাম বাড়ায় জ্বালানি খরচ বেড়েছে। এ কারণে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিতে হচ্ছে। মালিকের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে গাড়ি চালানোর কারণে বাড়তি ভাড়া না নিলে এ লোকসান তাদের বহন করতে হবে বলেও জানান।
যাত্রী ফরহাদ উদ্দিনের অভিযোগ, গাড়ি ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। তাই গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এখনই বাড়তি ভাড়া আদায় করতে পারেন না। অথচ প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এ নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। শুরুতে লাগাম দেয়া না গেলে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিতে পারে। এ নিয়ে যাত্রী ও গণপরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটতে পারে।
সিএনজি অটোরিকশা চালক হামিদুর রহমান বলেন, প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনতে হচ্ছে ৪৫ টাকা করে। বেশি দামে গ্যাস কিনে যাত্রীদের কাছ থেকে কেউ কম ভাড়া নেবে না, তাই আমিও নিচ্ছি। কবে সরকার বাড়তি ভাড়ার রেট নির্ধারিত করবে- এজন্যতো আমরা বসে থাকতে পারি না।
কলেজ শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, গণপরিবহনে ব্যবহৃত গ্যাস প্রতি ঘনমিটারে ৩ টাকা করে বাড়িয়ে ভাড়া নৈরাজ্যকে আরেক দফা উস্কে দেয়া হয়েছে। নতুন করে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণার সাথে সাথে বর্ধিত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। এতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। যেকোনো সময় পরিস্থিতি ভিন্নখাতে রূপ নিতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, অতীতেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর বাস-মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক-চালকরা তাদের খেয়াল খুশিমতো ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। ওই সময়ও প্রশাসন নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে তা নথিপত্রেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়নি। এমনকি পরবর্তীতে গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়া বাড়ানো হলেও গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তা মানেননি। বরং তার চেয়ে তারা আরো এক ধাপ বেশি ভাড়া আদায় করেছে, যা পরবর্তীতে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারও আগের মতো একই ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছি।
বিআরটিএ তো এসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন তাহলে নথিপত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিআরটিএ’র ম্যাজিস্ট্রেটদের চোখে ধূলো দিয়ে তারা ভাড়া নৈরাজ্য চালাচ্ছে। কয়েকটি গাড়ি ধরা পড়লেও বেশির ভাগ গাড়িই ধরাছোঁয়ার বাইরে। উনারা একদিকে অভিযান পরিচালনা করলে অন্যদিক দিয়ে ওইসব গাড়ি পালিয়ে যায়।
চট্টগ্রাম বাস ওনার্স এসোসিয়শন সূত্রে জানা যায়, গ্যাসের দাম বাড়ার পর বাস-মিনিবাস ও অটোরিকশার ভাড়া বাড়বে কি না, বাড়লে কত বাড়বে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। অতিরিক্ত ভাড়া না নিতে বাসচালক- মালিকদের নির্দেশ দেয়া আেেছ। এমনকি ভাড়া নির্ধারণের আগে বেশি ভাড়া আদায় করা হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়। সংগঠনের সভাপতি তরুণ দাশ গুপ্ত পূর্বদেশকে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি বাসসহ বিভিন্ন পরিবহনের পাঁচ থেকে ৬টি সংগঠন রয়েছে। যেগুলো একটার সাথে একটার সমন্বয় করে না। এখানে কোন সংগঠন কি করছে সে ব্যাপারে আমরা অবগত নই। তবে আমাদের সংগঠনের কেউ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে পারবে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক অলি আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, নতুন করে ভাড়া নির্ধারণের আগে বর্ধিত ভাড়া নেয়া হবে না। ভাড়া বাড়ানোর মত কোনো রকমের নির্দেশনা আমরা দিইনি। কেউ বেশি নিলে তাদেরকে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করছি। আর কেন্দ্রীয়ভাবে যদি ভাড়া বাড়ানো হয় তবে সবাই জানতে পারবেন।
ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউল হক মীর পূর্বদেশকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত ভাড়া এবং অন্যান্য অসংগতিপূর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো গাড়ির বিরুদ্ধে ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিব। এর আগেও জনসাধারণের বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। জনসাধারণের কাছে অনুরোধ থাকবে- আপনারা আমাদের জানান। আপনারা একটু সচেতন হলে আমরাও আরো আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে পারবো। এ বিষয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টদেরও ভূমিকা আছে। আসলে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।