৫৩ বছর পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় আলোর বাতিঘর

62

শিক্ষা ও গবেষণায় গুণগত মান নিশ্চিত করার মাধ্যমে এতদঞ্চলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে এবং বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বহু অনুষদভিত্তিক কোন গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় এ অঞ্চলের মানুষজন স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যা পরবর্তীতে বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিশিষ্টজন ও স্থানীয় দৈনিক আজাদী’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে প্রায় ১৭৫০ একর ভূমি নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে রয়েছে আঁকাবাঁকা পথ, পাহাড়ী পথ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এবং বন্য প্রাণী। এছাড়াও কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের পেছনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি ঝরনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শহর হতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে শাটল ও ডেমু ট্রেন। ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একমাত্র বাহন হিসেবে শাটল ট্রেনের প্রথম যাত্রা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর কর্তৃক ২০১৯ সালে প্রকাশিত চবি তথ্য নির্দেশিকা হতে জানা যায়, শুরুতে অল্প কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার (ছাত্রী প্রায় ৩৬ শতাংশ), শিক্ষক প্রায় ৯০০ জন (নারী শিক্ষক প্রায় ২১ শতাংশ), ৯টি অনুষদ, ৪৮টি বিভাগ, ১২টি হল (ছাত্র-৮টি, ছাত্রী ৪টি) ও হোস্টেল ১টি। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট ও ৫টি গবেষণা কেন্দ্র।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অকাতরে বিলিয়ে দেন নিজেদের জীবন। তাঁদের এই আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথেই নির্মিত হয়েছে স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়াও চবিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধু’র ম্যুরাল সংবলিত বঙ্গবন্ধু চত্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য ‘জয় বাংলা’। আর এগুলোই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও অহংকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে থাকবে বছরের পর বছর।
যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যই শুধু পঠন-পাঠন নয়। একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান অর্জন, সৃষ্টি ও তা বিতরনের পাশাপাশি গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রয়াত অধ্যাপক বিশ্বখ্যাত ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের গবেষণাকর্ম তারই প্রমাণ বহন করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর হতে এ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ও শিক্ষক হিসেবে যাঁদের পেয়েছে তাঁদের মধ্যে অনেকেই দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ। এই বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য হিসেবে পেয়েছেন এ.আর মল্লিক, সাহিত্যিক আবুল ফজল, অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক মোহাম্মদ ফজলী হোসেনসহ এমন আরও অনেককে।
বর্তমান অষ্টাদশ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এর আগে প্রথম নারী উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার। যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে একজন প্রথম নারী উপাচার্যও।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক ছিলেন। এছাড়াও দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাবেক জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ, একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক আহমদ শরীফ এবং ড. মাহবুবুল হক সহ এমন আরও অনেকে শিক্ষক হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় গবেষণার প্রজনন ক্ষেত্র। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবনী চিন্তা চেতনার বিকাশ প্রধানতঃ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য আধুনিক বিশ্বের জন্য সময়োপযোগি জ্ঞান ও গবেষণাধর্মী শিক্ষার বাতাবরন তৈরি করা। কিন্তু শিক্ষার এই বাতাবরন তৈরি করতে হলে দরকার আধুনিক ও অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরন নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, তথ্য আদান-প্রদান আরও বাড়াতে হবে। বিদেশি ছাত্রদের আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষাকে আরও বহুমুখী করতে হবে। নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের জন্য এবং ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় যোগ্য নেতা সৃষ্টির লক্ষ্যে হল ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে নিয়মিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাÐকে সবার জন্য অবারিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে সম্পূর্ণ সেশনজটমুক্ত।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় যখন জ্ঞান ও গবেষণায় এগিয়ে যায়, তখন মূলত এগিয়ে যায় দেশ ও সভ্যতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যাশা দেশের সার্বিক উন্নয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয় বিগত দিনের মত ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : প্রাক্তন শিক্ষার্থী (৩৩ ব্যাচ),চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়