৫জি টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্পকে গিলে ফেলবে?

25

অবধারিতভাবেই টেলিভিশন শিল্পের জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত স্পেকট্রামের যে অংশ হাতছাড়া হবে, তা গিয়ে জমা হবে মোবাইল অপারেটরদের ঝুলিতে। স্পেকট্রাম না থাকার অর্থ হচ্ছে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি। মোবাইল ইন্টারনেট যুগের পঞ্চম প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থা ফাইভ-জি (৫জি) নিয়ে এখন প্রযুক্তি বাজার থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি পর্যন্ত সর্বত্রই নানান আলোচনা এবং অস্থিরতা চলমান। অন্য কোন মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এমন বিতর্ক সৃষ্টির নজির নেই।
এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় মাস ছয়েকের কিছু আগে সীমিত পরিসরে ৫জি চালু হয়েছে এবং পৃথিবীর আরও বেশ কিছু দেশে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রযুক্তি বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে হুমকির মুখে পড়েছে প্রচলিত ব্যবস্থার টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্প। সম্প্রচার জগতে আগামী দিনে টেলিভিশনের আধিপত্য কতটা টিকে থাকবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
প্রচন্ড শক্তিশালী ৫জি একটি ব্যাপক-ভিত্তিক তারবিহীন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রযুক্তি, যার গতি এতটাই বেশি যে এটা প্রায় একই সময়ে তথ্য পাঠানো এবং এর প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতে সক্ষম। ফোর-জি (৪জি) যদি হয় এক লেনের একটি ভিড়ে ঠাসা সরু সড়ক, তাহলে ৫জি হচ্ছে দশ লেনের এক বিশাল চওড়া হাইওয়ে যেখানে যানবাহন ছুটে চলে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এমনকি এই হাইওয়ে এমন ভাবে প্রস্তুত করা যে যানবাহনের সংখ্যা যত কম বা বেশিই হোক না কেন, কারো গতি কখনও কমবে না।
অনন্য এই বৈশিষ্ট্যের কারণে ৫জি মানুষের আগামী দিনের জীবনযাপনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। এই প্রযুক্তিতে এমন কিছু নতুন সেবা গ্রহণের অভিজ্ঞতা মানুষ অর্জন করবে যা বর্তমানে পাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানের অনেক কিছুকেই ৫জি সম্পূর্ণভাবে রূপান্তর ঘটিয়ে মানুষকে অভিনব অভিজ্ঞতার স্বাদ দিবে। এর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, রিমোট রবোটিক্স, এআর-ভিআর, গেমিং এবং আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংসের মত সেবা – যেগুলোতে তাৎক্ষণিক এবং সার্বক্ষণিক তথ্যের আদান-প্রদান প্রয়োজন হয়।কন্টেন্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের জন্য এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে ৫জি। প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুটি সীমাবদ্ধতা – গতি এবং সীমিত ধারণ ক্ষমতা – দূর করতে পেরেছে ৫জি। এর ফলে আগামী দিনে টেলিভিশন স্টেশনগুলো তাদের আলট্রা-হাই-ডেফিনিশন বা ইউএইচডি টিভি সেট ব্যবহারকারী দর্শকদের জন্য এইচডিআর (হাই-ডাইনামিক রেঞ্জ), এইচএফআর (হাই ফ্রেম রেটস) এবং বিস্তৃত রং-এর সন্নিবেশ ঘটিয়ে উচ্চমান সম্পন্ন কন্টেন্ট পরিবেশন করতে পারবে।
এছাড়াও টিভিগুলো ৫জি-র মাধ্যমে তাদের খবর, খেলাধুলা, মিউজিক ফেস্টিভ্যালের মত অনুষ্ঠান যেকোনো স্থান থেকে অত্যন্ত সস্তায় সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
প্রচলিত টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্পের অস্তিত্বকে দুইভাবে হুমকিতে ফেলেছে ৫জি। প্রথমত, বৈচিত্র্যময় কন্টেন্টের ব্যাপক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে ৫জি। ভিজুয়াল কন্টেন্টের বিকল্প মাধ্যমগুলো ৫জি প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে টেলিভিশনের চেয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যেমন, ভার্চুয়াল, অগমেন্টেড এবং মিক্সড রিয়েলিটি কন্টেন্ট। এছাড়াও ৩৬০ ডিগ্রি ভিজ্যুয়াল মিডিয়া এবং পরবর্তী প্রজন্মের অডিও যা কিনা ‘এনজিএ’ বা ‘এ্যাডভান্সড সাউন্ড সিস্টেম’ নামে পরিচিত, ৫জি-র যুগে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয়ত, ৫জি-র কারণে বহুদিন থেকে নিজেদের জন্য ব্যবহার করে আসা স্পেকট্রাম হারাতে বসেছে টেলিভিশন শিল্প। যেহেতু ৫জি একটি ব্যাপকভিত্তিক প্রযুক্তি, তাই এটি পরিচালনার জন্য অনেক বেশি পরিমাণে স্পেকট্রামের প্রয়োজন হয়। আর এই প্রযুক্তি বিস্তারের কাজটি বিশ্বব্যাপী মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা পরিচালনা করছে এবং করবে। কাজেই, অবধারিতভাবেই টেলিভিশন শিল্পের জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত স্পেকট্রামের যে অংশ হাতছাড়া হবে, তা গিয়ে জমা হবে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের ঝুলিতে। আর টেলি-যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্পেকট্রাম হচ্ছে সবকিছুর ভিত্তি। সে কারণে কোন শিল্পের জন্য স্পেকট্রামের ঘাটতি বা না থাকার অর্থ হচ্ছে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি।
বর্তমানে টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য যে স্পেকট্রাম ব্যবহৃত হয়, মোটা দাগে সেটা মূলত দুইভাগে বিভক্ত। সি-ব্যান্ড এবং কেইউ -ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সিতে চলে টেলিভিশনের বর্তমান সম্প্রচার।
এরমধ্যে সি-ব্যান্ডে সম্প্রচার বেশি সুবিধাজনক, কেননা এতে একটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনেক বেশি এলাকায় সেবা পৌঁছানো যায়। এই ব্যান্ডেই মূলত টিভি চ্যানেলগুলো তাদের আপলিঙ্ক এবং কেবল অপারেটররা ডাউন লিংক করে থাকে।
সি-ব্যান্ডের ডিশগুলো হয় বেশ বড় আকারের এবং বৃষ্টি বা আবহাওয়াজনিত কারণে এতে ছবির মানের হেরফের হয় না। অন্যদিকে কেইউ-ব্যান্ড মূলত ব্যবহৃত হয় ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) সেবার ক্ষেত্রে। এই প্রযুক্তিতে কোন একটি এলাকায় কাভারেজের জন্য সি-ব্যান্ডের চেয়ে বেশি সংখ্যায় স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হয়। তবে এই ডিশগুলো আকারে ছোট, সহজে পরিবহনযোগ্য এবং সস্তা। কিন্তু বৃষ্টি বা আবহাওয়াজনিত কারণে এতে ছবির মানের হ্রাস ঘটে।
সি-ব্যান্ডে যে ফ্রিকোয়েন্সিগুলো ব্যবহৃত হয় তা মূলত ৩.৪ থেকে ৮.০ গিগাহার্টস পর্যন্ত বিস্তৃত। আর ইউএইচএফ টেরিস্ট্রিয়াল টিভি (আলট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ব্যবহার করে ৪৭০ থেকে ৮৬২ মেগাহার্টস পর্যন্ত ফ্রিকোয়েন্সিগুলো। মূলত এই ফ্রিকোয়েন্সি গুলোই টেলিভিশনের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ৫জি-র কারণে, বিশেষ করে সি-ব্যান্ড।
অন্যদিকে ৫জি’র জন্য যে স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিয়ে এর মান নির্ধারণ হতে যাচ্ছে, সেগুলো হল, ৭০০ মেগাহার্টস, ৩.৪ থেকে ৩.৮ গিগাহার্টস, ৪ গিগাহার্টসের পরবর্তী সমস্ত ফ্রিকোয়েন্সি এবং ২৪.২৫ থেকে ২৭.৫ গিগাহার্টস।
সুতরাং পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, সি-ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সিগুলোকে নিজের দখলে নিয়ে নিচ্ছে ৫জি। এরফলে টেলিভিশনগুলোর হাতে সি-ব্যান্ড বলতে প্রায় আর কোন ফ্রিকোয়েন্সিই অবশিষ্ট থাকছে না।
এছাড়া ৭০০ এবং ৮৫০ মেগাহার্টস ফ্রিকোয়েন্সিগুলো ৩জি, ৪জি ইতিমধ্যেই ব্যবহার করছে এবং ৫জি ও ৭০০ মেগাহার্টস ব্যবহার করবে।
টেলিভিশনের জন্য একটা সহজ বিকল্প হচ্ছে সি-ব্যান্ড ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি কেইউ-ব্যান্ড ব্যবহার করা। কেইউ-ব্যান্ডের স্পেকট্রাম ১২ থেকে ১৮ গিগাহার্টস পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে এতে এই প্রযুক্তিতে কোন একটি এলাকায় কাভারেজের জন্য সি- ব্যান্ডের চেয়ে বেশি সংখ্যায় স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হওয়ায় খরচ বেশি হবে।
আরেকটি বিকল্প হল, ৫জি’র নতুন প্লাটফর্মে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে টিভি। এতে করে প্রচলিত লিনিয়ার টিভি এবং অনলাইন ভিডিও সেবা (ওভার দ্যা টপ বা ওটিটি) একীভূত হয়ে একটি একক প্লাটফর্মে পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক পরিসেবার ব্যবহার বাড়বে।
প্রচলিত লিনিয়ার টিভি যদিও মোবাইল ডাটা ব্যবহার করবে না, কিন্তু এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে নির্ভরযোগ্যতা কমবে এবং খরচ বাড়বে। কেননা, টেলিভিশনকে তাদের কন্টেন্ট পরিবহনের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের ফী দিতে হবে।
এখনো ৫জি’র জন্য মান নির্ধারণ করা হয়নি তবে কাজ চলছে। আর আইটিইউ এর সাথে এই মান নির্ধারণের আলোচনায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের পাশাপাশি টেলিভিশনগুলোও যুক্ত আছে।
বিবিসির মত বড় বড় টেলিভিশন সম্প্রচারক এই আলোচনায় সম্প্রচার শিল্পের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেখানে টেলিভিশনের জন্য ৫জি’র স্পেকট্রামের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে করে টিভি সম্প্রচারক মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের ওপর নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম চালাতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে যদি ৬জি, ৭জি ইত্যাদির জন্য আরও অনেক বেশি স্পেকট্রামের দরকার হয়, তখন কী হবে?