৪ হাজার কর্মচারীর স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যাবে

726

মো. তারেক সুলতান। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অস্থায়ীভাবে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ২৬ বছর আগে। দীর্ঘদিন ধরে করপোরেশনের নিয়োগ-পদোন্নতিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় স্থায়ী হতে পারেননি। সেসব জটিলতার অবসান হলেও ভাগ্য বদল হয়নি। চাকরির প্রায় শেষ সময়ে এসে জানতে পারলেন তিনি আর সিটি করপোরেশনের কর্মচারী থাকবেন না। আউটসোর্সিং নীতিমালা অনুসারে ঠিকাদারের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনে চাকরি করতে হবে। অর্থাৎ অস্থায়ী থেকে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এত দিনের পথচলা নিমিষেই শেষ হতে চলছে।
একইভাবে প্রহরি হারুনুর রশিদ চাকরি করছেন ১৮ বছর ধরে। তারই সাথে কাজ করা হাবিবুর রহমানের চাকরির বয়স ১২ বছর। শুধু এই তিনজন নন, এরকম আরও ৪ হাজার কর্মচারীর দীর্ঘদিনের স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে চলেছে। তাদের প্রত্যেকের চাকরির বয়স ১২ থেকে ২৫ বছরের বেশি। তাই তারা গতকাল মঙ্গলবার বিক্ষোভ করেছে মেয়র কার্যালয়ের সামনের। মেয়রের আশ্বাসে আপাতত সরে দাঁড়ালেও আউটসোর্সিং নীতিমালা না মানার দৃঢ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বঞ্চিতরা।
তবে আন্দোলনরত কর্মচারীদের বিষয়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কিছু করার নেই বলে জানিয়েছেন চসিকের প্রধান নির্বাহী মো. সামসুদ্দোহা। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি সিটি করপোরেশনের কোনো সিদ্ধান্ত না। সরকার নির্ধারিত কিছু পদ আউটসোসির্ং নীতিমালা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেক্ষেত্রে এসব কর্মচারীরা যদি সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয়, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।
জানা গেছে, সিটি করপোরেশনে অনুমোদিত ১৯৭৭ সালের সাংগঠনিক কাঠামো ও পরে নতুন সৃষ্ট ১০৪৬টি পদ অনুসারে মোট শূন্যপদ রয়েছে ১ হাজার ১৪৮টি। তিনদশক ধরে সবধরনের নিয়োগ বন্ধ থাকার পর জটিলতার অবসান হলে গত ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় পদোন্নতি ও নিয়োগ। এই সময়ে শূন্যপদগুলো পূরণের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমোদন চেয়ে চিঠি দেয় করপোরেশন। কিন্তু অনুমোদন দেয় মাত্র ৬১২টি পদের। তাও সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে। বাকিপদগুলোর বিপরীতে থাকা কর্মচারীদের আউটসোর্সিং নীতিমালা ২০১৮ অনুসারে নিয়োগ দিতে বলা হয়। ফলে এসব পদের বিপরীতে রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কর্মচারী। যাদের চাকরির বয়স হয়েছে ১২ থেকে ২৫ বছর। তারা চাকরি করেছেন স্থায়ী হওয়ার আশায়। আর এতদিন পর এসে সিদ্ধান্ত হচ্ছে সিটি করপোরেশন নয় ঠিকাদারের মাধ্যমে চাকরি করতে হবে তাদের।
সরাসরি নিয়োগের জন্য অনুমোদিত ৬১২টি পদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির রয়েছে ৩২টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ২৮টি, তৃতীয় শ্রেণির ৪৮০টি এবং চতুর্থ শ্রেণির রয়েছে ৭২টি পদ। অন্যদিকে চসিকের অনুমোদিত প্রবিধান মালায় পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজার এবং বাতি পরিদর্শক পদ দুইটিতে সরাসরি নিয়োগের কথা থাকলেও পত্রে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পূরণের কথা বলা হয়েছে। তবে এই দুইটি পদের বিষয়ে সংশোধনী চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাহী মো. সামসুদ্দোহা।
গতকাল মঙ্গলবার চসিকের কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হন এসব কর্মচারীরা। তাদের প্রতিনিধি হয়ে মেয়রের সাথে দেখা করেন সিটি করপোরেশন কর্মচারী শ্রমিক লীগ সভাপতি ফরিদ উদ্দিন। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, সিটি করপোরেশনে প্রায় ৪ হাজার কর্মচারী অস্থায়ীভাবে ২০০৭ সালের আগে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পান। তাদের চাকরির বয়স ১২ থেকে ২৫ বছর। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ-পদোন্নতি বন্ধ থাকায় তারা সবাই অস্থায়ী ছিলেন। মেয়র মহোদয়ের অক্লান্ত চেষ্টায় সেই জটিলতার অবসান হয়েছে। কিন্তু এখন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রায় ৪ হাজার কর্মচারীকে সিটি করপোরেশন নয় ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। এটা অমানবিক। কারণ চাকরিতে প্রবেশের সময় তাদের আউটসোর্সিংয়ের কথা বলা হয়নি। বরঞ্চ নিয়োগ বন্ধকালীন তারা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেবা দিয়ে গেছেন। এখন তাদের স্থায়ী হওয়ার বদলে চাকরি হারানো মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মেয়রের সাথে কথা বলেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। আশানুরূপ কিছু না হলে আন্দোলন ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই।
২০১৪ সালের এক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এক কর্মচারী বলেন, তখন সাবেক মেয়র প্রায় ১ হাজার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে অস্থায়ী থেকে স্থায়ী করেছেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে করে গেছেন। তখনও নিয়োগ-স্থায়ীকরণ বন্ধ ছিল। তাহলে এখন বর্তমান মেয়র কেন আমাদের দায়িত্ব নিবেন না। এখন সরসরি নিয়োগের কথা বলছেন। আমাদেরও পরীক্ষা ও অন্যান্য ফরমালিটি মেইনটেইন করে নিয়োগ পেতে হবে। তাহলে সিটি করপোরেশনের জন্য আমাদের এতদিনের ত্যাগ কি জলে যাবে ? শেষ বয়সে এসে নিয়োগ পরীক্ষায় আমরা কতুটু উত্তীর্ণ হতে পারবো। তাছাড়া যাদের আউটসোর্সিং নীতিমালায় ফেলে ঠিকাদারের অধীনের কাজ করতে বলা হচ্ছে তারা তো স্থায়ী হবার আশায় এতদিন চাকরি করেছেন। তাহলে তাদের পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে ? এধরনের হঠকারিতা কিছু মেনে নেওয়ার চেয়ে আত্মহত্যা করাটা অনেক উত্তম হবে।
আউটসোর্সিংয়ে যারা থাকছেন: ৫ ক্যাটাগরিতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেবা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। যেখানে প্রথম ক্যাটাগরিতে রয়েছেন, চালক (হেভী), সুপারভাইজার, কেয়ারটেকার, ওয়ার্ড মাস্টার, ইলেকট্রিশিয়ান, লিফট মেকানিক, এসি মেকানিক, পাম্প মেকানিক, জেনারেটর মেকানিক, অন্যান্য কারিগরি কাজ সংক্রান্ত টেকনিশিয়ান এবং অনুরূপ কাজের সেবাকে বুঝাবে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে চালক (হালক), স্যানিটারি মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, পাম্প অপারেটর, এয়ারকন্ডিশন অপারেটর, জেনারেটর অপারেটর, ওয়ারম্যান, ওয়েল্ডার, মিটার রিড়ার এবং অনুরূপ কাজের সেবাকে বুঝাবে। তৃতীয় ক্যাটাগরিতে সহকারী ইঞ্জিন মেকানিক, টেন্ডল, গ্রিজার, টেইলর, ডুবুরি এবং অনুরূপ কাজের সেবাকে বুঝাবে। চতুর্থ ক্যাটাগরিতে লন্ড্রি অপারেটর, ফরাশ জমাদার, সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান, শুকানি, বাবুর্চি, গার্ডেনার, দক্ষ শ্রমিক এবং অনুরূপ কাজের সেবাকে বুঝাবে। সর্বশেষ পঞ্চম ক্যাটাগরিতে সিকিউরিটি গার্ড, পরিচ্ছন্নকর্মী, সহকারী বাগানকর্মী, ইলেকট্রিক্যাল হেলফার, কার্পেন্টার, হেলপার, স্যানিটারি হেলপার, পাম্প হেলপার, গাড়ির হেলপার, এসি মেকানিক হেলপার, চৌকিদার, ল্যাব এটেনডেন্ট, ওটি এটেনডেন্ট, ইমার্জেন্সি এটেনডেন্ট, স্ট্রেচার বেয়ারার, ওয়ার্ড বয়, আয়া, সহকারী বাবুর্চি, লিফটম্যান, লাইনম্যান, ফরাশ, লস্কর, ম্যাসন হেলপার, ম্যাসেঞ্জার, মশালচি, এনিম্যাল এটেনডেন্ট, গেস্ট হাউস এটেনডেন্ট, হোস্টেল এটেনডেন্ট, ডোম, বাইন্ডার, অদক্ষ শ্রমিক এবং অনুরূপ কাজের সেবাকে বুঝাবে।