৪৮ বছরেও সংরক্ষিত হয়নি কোনো বধ্যভূমি

97

১৯৮৮ সাল থেকে নগরীর বধ্যভূমি সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালেহ উদ্দিন আন্দোলন করে আসছেন। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও সংরক্ষিত হয়নি নগরীর কোনো বধ্যভূমি। তারই প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে পূর্বদেশকে বলেন, দেশে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চেতনা লালনকারী প্রশাসনে কোনো কর্মকর্তা নেই! কতটা তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলে এমন প্রতিক্রিয়া আসে তা অনুভবের বিষয়। শুধু তিনি নন, নগরীর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তারপরও কোনো অজানা রহস্য ঘায়েল করে রেখেছে গণহত্যার সংখ্যা বিবেচনায় দেশের সর্ববৃহৎ ‘পাহাড়তলি বধ্যভূমি’ সংরক্ষণের সবক’টি পদক্ষেপ।
এমনকি প্রতিবাদের ভাষা রূপ নিয়েছে মঞ্চ নাটকে। নাট্যকার প্রদীপ দেওয়ানজী রচনা করেছেন ‘ইউএসটিসি বধ্যভূমি’ মঞ্চ নাটক। নাটকের পরতে পরতে ভেসে উঠেছে নির্বিচারে হত্যা হওয়া বাঙালির অপ্রকাশিত সুর। জানানো হয়েছে কালো হাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এই কালো হাত ভাঙবে কে, রুখবে কে? এমন প্রশ্নে কেটেছে স্বাধীনতার ৪৯ বছর। ক্ষোভ জানিয়ে নাট্যকার প্রদীপ দেওয়ানজী বলেন, এখন আর এসব বলতে ইচ্ছে করে না। লজ্জা লাগে ভাবতে, তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা, তাদের নূন্যতম শ্রদ্ধা জানানোর লোক চট্টগ্রামে নেই। কারো দায়িত্ব নেওয়ার সময় নেই।
অবশ্য বধ্যভূমি সংরক্ষণে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা পূর্বদেশকে জানিয়েছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা চট্টগ্রামের হাজারো নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তাদের স্মৃতিচিহ্ন বধ্যভূমি সংরক্ষণ করে প্রজন্মকে জানাতে হবে। অন্যথায় প্রজন্ম কখনও পাকিস্তানি দোসরদের ভয়াবহ রূপ সম্পর্কে জানতে পারবে না। এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণে সকল ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সিটি কর্পোরেশন। আর যারা বেআইনিভাবে দখল করে আছে, তাদের আহব্বান করবো সময় থাকতে বধ্যভূমিকে বধ্যভূমির মতো ফিরিয়ে দিন।
একাত্তরের ১০ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালেহ’র বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা আলী করিমসহ ওই পরিবারের চারজনকে পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া যুদ্ধচলাকালে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর- এই ৯ মাসে নগরীর পূর্ব পাহাড়তলীর বধ্যভ‚মিতে হত্যা করা হয় অন্তত পাঁচ হাজার বাঙালিকে। ১০ নভেম্বর একদিনেই সেখানে হত্যা করা হয় ১২৪ জন নিরীহ মানুষকে। জল্লাদখানা নামে পরিচিতি পায় স্থানটি। পাশেই টিঅ্যান্ডটির রেস্ট হাউজে পাকিস্তানি বাহিনীর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন শত শত নারী।
মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালেহ উদ্দিন হতাশা প্রকাশ করে পূর্বদেশকে বলেন, ‘স্বাধীনতা লাভের পর ৪৯ বছর পার হতে চলেছে। দীর্ঘ এই সময়ে চট্টগ্রামে একটি বধ্যভূমিও সংরক্ষণ করা হয়নি। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা আবেদন করলে তিনি পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। তিন দফায় নোটিশও দেওয়া হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসে সেই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। আমরা উচ্চ আদালতে রিট করার পর ২০১৪ সালে আদালত এটি সংরক্ষণের পক্ষে রায় দেন। আদালতের রায়ের পর পাঁচ বছর পার হতে চলেছে, এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি’।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার জীবদ্দশায় বধ্যভ‚মি সংরক্ষণের বিষয়টি দেখে যেতে পারবো কিনা আল্লাহই ভালো জানেন। গতকালও ডিসি অফিসে গিয়েছি, তারা এখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দেখিয়ে দিচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালতে রায় দেওয়ার পরও চট্টগ্রামের কোনো সংস্থা যেন দায় নিতে চাচ্ছেন না। সবার যেন দায় এড়িয়ে যাওয়ার ভাব। এখন একটি স্থাপনা করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে মানুষ ফুল দেয়। ওটা তো বধ্যভূমি না। বিএনপি সরকার মূল জায়গা থেকে সরিয়ে রাখতে সেখানে একটি স্থাপনা করে দেয়। এই প্রজন্ম সেখানে ফুল দিচ্ছে, কিছুদিন তাদের সঠিক জানাতে গেলে বিকৃত ইতিহাস মনে করবে। তাহলে তো স্বাধীনতা বিরোধীরাই সার্থক হতে চলেছে!’
জানা গেছে, দক্ষিণ কাট্টলির নাথ পাড়া বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ হত্যা করা ৪২ জনকে। পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের পরপরই বিহারীদের সঙ্গে হত্যা করে স্থানীয় বাঙালিদের। মহামায়া ডালিম হোটেলকে কেন্দ্র করেই একাত্তরে চালানো হয়েছে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন আলবদর নেতা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলী। তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে এই ভবনে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। একাত্তরে এই ভবনেই ধর্ষণ করা হয়েছে শত শত নারীকে।
পাহাড়তলী বধ্যভূমি, নাথ পাড়া আর ডালিম হোটেলই নয়, চট্টগ্রাম নগরীতে একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত এরকম প্রায় ৭৭টি স্থান আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের ওপর চালানো নির্যাতন-হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে আছে এই স্থানগুলো। মুক্তিযুদ্ধের পরে এসব স্থানে মিলেছে সেইসব মানুষদের কঙ্কাল, নিপীড়নের দাগ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্বজনদের দাবির পরও ৪৬ বছরেও এসব বধ্যভূমির একটিও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
‘প্রামাণ্য দলিল: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ শিরোনামের বইতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালেহ উদ্দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের ব্যবহৃত বধ্যভূমির সুনির্দিষ্ট তথ্য উপস্থাপন করেছেন। বইটিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম নগরীর ভেতরেই ৭৭টি বধ্যভূমি আছে। যেখানে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরারা মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করেছে। নগরীর বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে মহামায়া ডালিম হোটেল বধ্যভূমি, গুডসহিল বধ্যভূমি, পূর্ব পাহাড়তলী বধ্যভূমি, পশ্চিম পাহাড়তলী বধ্যভূমি, দক্ষিণ বাকলিয়া মোজাহের উলুম মাদ্রাসা বধ্যভূমি, চাক্তাই খালপাড় বধ্যভূমি, চামড়ার গুদাম চাক্তাই খাল পাড় বধ্যভূমি, তুলশী ধাম সেবায়েত মন্দির বধ্যভূমি, হাইওয়ে প্লাজা ভবন বধ্যভ‚মি, বাটালী পাহাড়ের রেলওয়ে বাংলো বধ্যভূমি, পাঁচলাইশ সড়কের আল বদর বাহিনী ক্যাম্প বধ্যভ‚মি, চট্টগ্রাম জেনারেল পোস্ট অফিস বধ্যভূমি, সিআরবি নির্যাতন কেন্দ্র বধ্যভূমি, চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভ‚মি, চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের পাশের সেনাক্যাম্প বধ্যভূমি, সার্কিট হাউজ বধ্যভ‚মি, বন্দর আর্মি ক্যাম্প বধ্যভূমি, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বধ্যভ‚মি, প্রবর্তক সংঘের পাহাড় বধ্যভূমি, সদরঘাট রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভ‚মি, ঝাউতলা বিহারী কলোনী বধ্যভ‚মি ও সিভিল গোডাউন বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য।
প্রসঙ্গত, এসব বধ্যভূমির মধ্যে পাহাড়তলী বধ্যভ‚মিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ১৯৯৮ সালে প্রজন্ম-৭১ নামে একটি সংগঠনের আবেদনের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। এরপর ২১ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও ভূমি অধিগ্রহণ করে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করা হয়নি। ১ দশমিক ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। তবে ২০০৫ সালে চার দলীয় জোট সরকার ওই প্রকল্প বাতিল করে টাকা ফেরতের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন জাফর ইকবাল, মুনতাসির মামুন, মিলি রহমানসহ আট বিশিষ্ট নাগরিক। ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট রিট নিষ্পত্তি করে দিলে আবেদনকারীরা এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আসেন। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ রিট আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের আদেশ দেন। এরপর প্রায় পাঁচ বছর পার হতে চললেও ভ‚মি অধিগ্রহণ করে এখনও বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করা হয়নি।