৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল সিদ্ধান্ত : কিছু কথা

397

আগামী বছর থেকে অর্থাৎ ২০২০ সালের শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরের ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত কোন প্রকার পরীক্ষা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যা ইতো মধ্যে বেশ আলোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই বিষয়ে দেশের বেশ কিছু বিশিষ্ট জন সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আবার খুব কম সংখ্যক মানুষ এর বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। এই সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর পূর্বে, সরকার কর্তৃক ঘোষিত পরীক্ষা না রাখার কারণসমূহ উল্লেখ করতে হয়। পরীক্ষা বন্ধ বা বাতিল করার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, কিন্ডার গার্টেন থেকে শিশু, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মুখী করা; শিশুদেরকে পরীক্ষার ভীতি থেকে মুক্ত করা; শিক্ষার চাপ কমিয়ে আনা ইত্যাদি। সেইসব বিষয় সামনে রেখে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করার এই সিদ্ধান্ত।
এটাও ঠিক, শিক্ষাক্রম ও পরীক্ষার অতিরিক্ত চাপে, শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষা সম্পর্কে ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে বা হচ্ছে। শিক্ষা দার্শনিক ও শিশু মনোবিজ্ঞানী বা শিশু বিশেষজ্ঞ মতে শিশুরা খেলাধুলা ও আনন্দের মাধ্যমে শিখবে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে ১ম শ্রেণি হতে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত এক বছরে ১ম সাময়িক, ২য় সাময়িক ও বার্ষিক এই তিন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আর ৫ম শ্রেণির ক্ষেত্রে ১ম এবং ২য় সাময়িক পরীক্ষার পর, স্কুল ভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নামে কেন্দ্রীয় ভাবে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আবার সমাপনী পরীক্ষার আগে সমাপনীর আদলে উপজেলা ভিত্তিক কমপক্ষে দুয়েকটা মডেল টেস্ট নেয়া হয়। এছাড়া সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক পরীক্ষা তো আছেই।
আবার মাধ্যমিক পর্যায়ে (৬ষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত) আগে প্রাথমিক স্তরের মত একই রকম তিনটি পরীক্ষা থাকলেও, গত কয়েক বছর থেকে বছরে দুটি পরীক্ষা নেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সেই অনুযায়ী ৬ মাস পর অর্ধবার্ষিক এবং বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এবার সরকারি সিদ্ধান্তের বিপরীতে সরাসরি বলতে চাই, ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করা কোন ক্রমেই সমীচীন হবেনা। কারণ ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করা মানে হচ্ছে প্রাকশ্রেণি সহ একটানা মোট চার বছর পরীক্ষা মুক্ত রাখা। বর্তমানে পরীক্ষা তিনটির পরিবর্তে দুটি বা একটি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা যেতে পারে। কারণ শিক্ষা ও পরীক্ষা একটি অপরটির পরিপূরক। এখানে শিক্ষা ভিতি কমাতে পরীক্ষা বাদ বা বাতিল কোনক্রমেই উচিত হবেনা। শিক্ষার ভীতি কমাতে শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত করতে হবে। ১ম শ্রেণি হতে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১:৩০ মিনিট পর্যন্ত (এক শিফটের ক্ষেত্রে) শ্রেনি কার্যক্রম না রেখে ১২ টা পর্যন্ত রাখা। কারণ এত বেশী সময় কচিকাঁচা শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুল নামক কারাগারে বন্দি করে রাখা মানে ক্ষীণ মানসিক প্রতিবন্ধী করে ফেলা। শুধু ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত নয়, পুরো প্রাথমিক স্তরে সব ক্লাসের স্কুল সময় কমিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রত্যেক শিশু জন্মগত ভাবে কিছু প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহন করে। তারা স্রষ্টা হতে প্রাপ্ত প্রতিভা যাতে মুক্তমনে বিকশিত করতে পারে, সেই সুযোগ ও পরিবেশ তৈরী করে দিতে হবে।
এখানে পরীক্ষার বাতিল করে পরীক্ষার পরিবর্তে ডায়েরীতে লিখে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এই ভাবে মূল্যায়ন বিশেষ কোন সুফল পাবে কিনা, শিক্ষা মানসম্মত হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। কারণ গ্রামের ৯৫ শতাংশ অভিভাবক হয়ত অশিক্ষিত না হয় অসেচতন। যারা অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন তারাও খোঁচ খবর রাখেনা সন্তানদের। রাখার প্রয়োজনও মনে করে না। যে সব অভিভাবক সন্তানদের স্কুলড্রেস, স্কুলব্যাগ কেনার মত আর্থিক ক্ষমতা বা সামর্থ্য অর্জন করতে পারে, তারা পার্শ্ববর্তী কিন্ডার গার্টেনে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। কিন্ডারগার্টেনে বেতন বা টাকা দিয়ে পড়তে হয় বলে, অভিভাবকগণ নিয়মিত স্কুলে নিজ দায়িত্বে উপস্থিতি নিশ্চিত করে। তাছাড়া কিন্ডারগার্টেনে সময় কম হওয়ায়, শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাবার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। পক্ষান্তরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে অভিভাবকের কোন খবর থাকেনা। প্রাইমারি শিক্ষকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের টেনে এনে পড়াতে হয় বিদ্যালয়মুখী করাতে হয়। দীর্ঘক্ষণ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয় বলে বিরক্ত বোধ করে শিশু ছাত্রছাত্রীরা। তাদের মনে একজাতীয় ক্ষীণমানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া অনেক বিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামোর অভাব ও শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করার আগে মাঠ পর্যায়ের অবস্থা, বাস্তব প্রেক্ষাপট, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই। গত ৬/৭ বছর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, দেশে একটাকা দুইটাকার মুদ্রা প্রচলন আছে নাকি! সর্বনিম্ন মুদ্রামান হবে ৫ টাকা। কথায় কথায় সবাইকে রাবিশ বলা এই মন্ত্রীর এই কথায় মাঠপর্যায়ে হাস্যকর পরিস্থিতি ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কারণ মাঠ পর্যায়ে ১ বা ২ টাকার দিয়ে অনেক কিছু পাওয়া যায়। আবার অনেক ঝগড়াঝাটিও হয়। তাছাড়া ৭, ৮ বা ৯ টাকার দ্রব্যের জন্যেও ২/৩ টাকার মুদ্রা প্রয়োজন রয়েছে। তাই ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল বিষয়ে. তৃণপর্যায়ে বা মাঠ পর্যায়ে সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।