২৬ মিনিট লড়াইয়ে কুমিল্লার শাহজালাল বলী চ্যাম্পিয়ন

99

হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে টান টান উত্তেজনা ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ২৬ মিনিটের জমজমাট লড়াইয়ে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার ১১০তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কুমিল্লার শাহজালাল বলী। গতকাল ফাইনাল খেলায় চকরিয়ার তারিকুল আলম জীবন বলীকে পরাজিত করেন তিনি। এ লড়াই চলাকালে দর্শকরা প্রচন্ড উল্লাসে ফেটে পড়েন এবং তারা দুই বলীর পক্ষে স্লোগান দেন।
এর আগে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে বিকাল সোয়া ৪ টায় বেলুন উড়িয়ে নগরের লালদিঘী মাঠে বলীখেলার উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মাহবুবুর রহমান। উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই বলীখেলার পরিচিতি এখন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে বলীখেলা ও বৈশাখী মেলাকে বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করব।
এসময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আমেনা খাতুন, প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ ও মেলা কমিটির সভাপতি জহর লাল হাজারী প্রমুখ। খেলা পরিচালনা করেন ৩০ বছরের অভিজ্ঞ রেফারি সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মালেক। তাকে সহযোগিতা করেন নূর মোহাম্মদ লেদু ও জাহাঙ্গীর আলম।
বলীখেলার প্রথম রাউন্ডে ৬২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে জয়ী হন বাঁশখালীর সরোয়ার, শহীদুল আলম, পশ্চিম মাদারবাড়ির মো. সবুজ, স্টেশন রোডের আল আমিন, নালাপাড়ার দশম শ্রেণির ছাত্র মো. ইব্রাহিম, বাঁশখালীর খোরশেদুল আলম, সাব এরিয়ার মো. রাজিব, রাঙামাটির রুবেল হোসেন, পটিয়ার রাজু শীল, মহেশখালীর নেছার, ফিরিঙ্গিবাজারের নান্টু দাশ, রাঙ্গুনিয়ার সিএনজি অটোরিকশাচালক মো. ইলিয়াস, এনায়েত বাজারের মো. ফয়সাল, রাউজানের মৃদুল দে, ফটিকছড়ির রিয়াজ উদ্দিন, শিবু শীল, মহেশখালীর সিরাজুল মোস্তফা, পতেঙ্গার খাজা আহমদ বলী, হাটহাজারীর মো. মফিজ, কুতুবদিয়ার মো. জিসান, বোয়ালখালীর মো. কাউসার, ফিরিঙ্গিবাজারের মো. যুবরাজ, পাঁচলাইশের মো. ইব্রাহিম, ফটিকছড়ির মো. নূর উদ্দিন, বঙ্গবাড়ি টেকপাড়ার রাজন দাশ, মহেশখালীর সৈয়দ নূর, চাক্তাইয়ের আবু হানিফ বাপ্পি, নিমতলার কামরান মুর্শেদ খান, কুমিল্লার মো. আলম, পটিয়ার মিনহাজুল আবেদন, ফিরিঙ্গিবাজারের ছোটন দাশ।
এরপর শুরু হয় চ্যালেঞ্জিং রাউন্ডের খেলা। চ্যালেঞ্জিং রাউন্ডে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে গেছেন জীবন, কাঞ্চন, বজল, মো. হোসেন, কালাম, সাহাবউদ্দিন, কালু এবং শাহজালাল। প্রথম রাউন্ড শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে ১৬ জনের মধ্যে থেকে সেমি ফাইনালের টিকিট পান কুমিল্লার শাহজালাল, মহেশখালীর সাহাবউদ্দিন, মো. হোসেন, চকরিয়ার জীবন।
এবার বলীখেলায় চ্যাম্পিয়নকে নগদ ২০ হাজার টাকা ও ট্রফি এবং রানারআপকে নগদ ১৫ হাজার টাকা ও ট্রফি দেওয়া হয়। অন্য বলীদের নগদ ১ হাজার টাকা ও একটি করে ট্রফি দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধণাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে এ প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এ প্রতিযোগিতা জব্বারের বলীখেলা নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। প্রতি বছর ১২ বৈশাখ নগরের লালদীঘি মাঠে এ বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় ‘বলী’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘কুস্তি’ বলীখেলা নামে পরিচিতি।

জমজমাট বিকিকিনি
বৈশাখী মেলায়
এম এ হোসাইন
ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে লালদীঘির মাঠে জমে ওঠেছে বৈশাখী মেলা। লালদীঘি মাঠ ও আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে লোকজপণ্যের হাট। তিন দিনব্যাপী এ মেলা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে। তবে মেলায় অন্যান্যবারের তুলনায় লোকসমাগম কম বলে দাবি করেছেন বিক্রেতারা। অন্যদিকে ক্রেতাদের দাবি, এবার পণ্যের দাম বেশি।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ নগরীর লালদীঘি মাঠে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলী খেলা। বলী খেলাকে কেন্দ্র করে মাঠের আশপাশের জায়গাজুড়ে বসে বৈশাখী মেলা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেলায় আসেন দোকানিরা। পুরো চট্টগ্রামবাসী সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এ মেলার। অনেকে পুরো বছরের গৃহস্থালি সামগ্রী ও ঘর সাজানোর জিনিস কেনেন এ মেলা থেকেই। মেলায় সবচেয়ে বেশি চাহিদার মধ্যে থাকে ফুলঝাড়ু। পুরো বছরের চাহিদা অনুযায়ী মেলা থেকে ফুলঝাড়ু কিনেন নগরবাসী। এসব ঝাড়ু আসে মূলত বান্দরবান, বাঁশখালী, মহেশখালী ও কক্সবাজার থেকে।
মেলায় আসা ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর ধরে মেলায় ঝাড়ু নিয়ে আসি। বেতের বাঁধা ঝাড়ুর চাহিদা বেশি। তাই বেতের ঝাড়ু বেশি আনা হয়। মেলার জন্য কয়েক মাস আগে থেকেই এসব ঝাড়ু তৈরি করা হয়।
রিয়াজুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা বলেন, ঝাড়ু পুরো বছর লাগে। কিন্তু বছরের অন্যান্য সময়ে ঝাড়ু পাওয়া বা কেনা হয় না। তাই বলী খেলা আসলে সারা বছরের জন্য ঝাড়ু কিনে নিয়ে যাই। তবে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার জিনিসপত্রের দাম বেশি রাখা হচ্ছে।
জব্বরের বলী খেলা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এ বৈশাখী মেলা। কথিত আছে, সবকিছুই পাওয়া সম্ভব এ মেলায়। বলী খেলাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা নিয়ে হাজির হন লালদীঘি মাঠে। বিক্রি হয় হাতপাখা, শীতল পাটি, মাটির কলস, চুড়ি, ফিতা, রঙিন সুতা, হাতের কাঁকন, নাকের নোলক, মাটির ব্যাংক, ফুলঝাড়ু, খেলনা, ঢোল, বাঁশি, বাঁশ ও বেতের নানা তৈজসপত্র, কাঠের পুতুল, নকশি কাঁথা, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ লোকজ ও গ্রামীণ হাজারো পণ্য।
নানা ধরনের খেলনা নিয়ে মেলায় আসা রাঙামাটির আজিজুল হক বলেন, জব্বরের বলী খেলা দেখতে অনেক লোকজন আসেন। অনেক বছর ধরেই মেলায় আসি। মেলায় সব ধরনের পণ্যের কদর আছে। তবে এবার প্রচুর গরমের কারণে লোক সমাগম কম। আশা করছি, রাতে লোকসমাগম হবে এবং বিক্রিও ভালো হবে।
আন্দরকিল্লা থেকে কোতোয়ালী থানার মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশেই দুই সারিতে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। প্রচুর লোকসমাগমও হয়েছে মেলায়। স্বয়ংসম্পূর্ণ এ লোকজমেলার আবেদন চট্টগ্রামবাসীর অনেক পুরনো। পুরো বছর এ মেলা থেকে কেনাকাটার জন্য অনেক দূর থেকেও ছুটে আসেন অনেকে।
আনোয়ারা থেকে মেলায় আসা গৃহিনী রোজিনা আকতার বলেন, প্রচুর জিনিস থাকায় পছন্দ করে কেনার জন্য মেলায় আসা হয়। কিন্তু এবার মেলায় প্রচুর দাম চাচ্ছেন বিক্রেতারা। এরপরও কিছু জিনিস কিনেছি। কারণ এ মেলায় এমন কিছু পাওয়া যায় যা অন্য কোনও মেলাতে পাওয়া যায় না।
এ বলী খেলার প্রবর্তক ছিলেন আব্দুল জব্বার নামের এক সওদাগর। তার নামানুসারে একে জব্বারের বলী খেলা বলা হয়। আবদুল জব্বার ছিলেন নগরীর বদরপাতি এলাকার তৎকালীন প্রভাবশালী সমাজসেবক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের যুব সমাজকে সংগঠিত, প্রেরণা দেওয়া এবং সংগ্রামী করার লক্ষ্যে এটি চালু করেন তিনি। বাংলা ১৩১৫ সনের ১২ বৈশাখ আবদুল জব্বারের বলী খেলার প্রথম আসর বসে। বর্তমানে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয়। বলী খেলার আগে ঢোল বাজিয়ে প্রচার চালানো হয়। সঙ্গী-সমর্থকদের নিয়ে ঢোল বাজিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন বলীরা।