২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস

26

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

আজ ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় দিন। আজ থেকে ৩৩ বছর আগে ১৯৮৮ সালের এই দিনে সকাল থেকে চট্টগ্রামের লাখো জনতা অপেক্ষায় ছিলেন কখন আসবেন বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ১৫ দলীয় জোটের নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিক লাল দিঘির মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল সেদিন। বিমান বন্দর থেকে চট্টগ্রামের লাল দিঘীর মাঠ মাত্র এক ঘন্টার পথ আসতে সময় লাগে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা। লোকে-লোকারণ্য বিমান বন্দর থেকে জনসভার স্থান পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে লাখো জনতা হাত নেড়ে নেত্রীকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। নিউ মার্কেট, কোতোয়ালী মোড়, টিএন্ডটি ভবন, শহীদ মিনার, আন্দরকিল্লা, ব্রীজঘাট কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দুপুর ১ টার সময় নেত্রী এসে পৌঁছলে শুরু হয় পুলিশী এ্যাকশন। নেত্রী পুলিশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন-আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা তোমরা নিরীহ মানুষের উপর গুলি চালানো বন্ধ কর। তৎকালীন সিএমপি কমিশনার খুনি মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পাখি শিকারের মত ২৪টি তাজা প্রাণ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। নিহত হলো সিতাকুন্ড ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দীন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এলবার্ট গোমেজ, কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল সেলিম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুর হোসেন, কামাল হোসেন, টি.কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দীন, চাঁন মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, বখতিয়ার, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, মোহাম্মদ শাহাদাত। মুহূর্তের মাঝেই সবকিছু লÐভÐ হয়ে গেল ঐ সময় নেত্রীর সাথে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামÐলীর সদস্য তোফায়েল আহমদ, আমির হোসেন আমু, অধ্যাপক পুনিল দে, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, আব্দুল জলিল, আশিকুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ট্রাকে আহত হয়েছিলেন। আওয়ামী-যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান (বহিস্কৃত) মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুলতানুল কবির চৌধুরী, নগর যুবলীগ সভাপতি নোমান আল মাহমুদ, কেন্দ্রীয় ও উত্তর-দক্ষিণ মহানগর আওয়ামীলীগের অনেক নেতা ট্রাকে অবস্থান করছিলেন। চট্টলবীর এ,বি,এম মহিউদ্দীন চৌধুরী ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান সভাপতি মোছলেম উদ্দীন আহমদ এম.পি তখন কারান্তরীন ছিলেন। এই গণহত্যা ’৭১ এর গণহত্যাকে হার মানিয়েছিল কারণ রাতের অন্ধকারে পুলিশ সেইদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যারাই শহীদ হয়েছিলেন তাদের অনেকের লাশ বলুয়ারদিঘীপাড়স্থ অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন এবং লাশ গুম করার চেষ্টা করেছিলেন। তৎকালীন জেলা আইনজীবী সমিতির নেতা মহানগর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি এড. ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, এড.ইফতেখার সাইমুন চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এড মুজিবুল হক, আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ ও দলীয় নেতা-কর্মীরা নেত্রীকে মানব প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখে আদালত ভবন এর উপরে নিয়ে যান আমিও সেখানে ছিলাম। সফল আলী ভাই ও আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে একটি মিছিল কোতোয়ালী মোড়ে অবস্থান করছিল। হত্যাকান্ডের দীর্ঘ ৫ বছর পর ১৯৯২ সালের ৫মার্চ এড শহীদুল হুদা বাদী হয়ে খুনি পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামী করে মহানগর মুখ্য হাকীম আদালতে ৪৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ১৯৯৮ সালের ১৪ মে সহকারী পুলিশ কমিশনার হাফিজ উদ্দীন দেওয়ান ৪৭ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগ পত্র প্রদান করেন। ঐ বছর ৩ সেপ্টেম্বর আদালত সিআইডি কে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। ১৯৯৯ সালের ১৪ অক্টোবর সিআইডি সহকারী পুলিশ সুপার ৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। অভিযোগ পত্রে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা ও কোতোয়ালী থানার পুলিশ পরিদর্শক জে.সি. মন্ডল, কনেস্টবল মোস্তাফিজুর রহমান, আবদু সালাম, প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজ উদ্দীন, শাহ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও বশীর উদ্দীন কে আসামী করা হয়।
১৯৯৬ সালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাদের খাঁন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০০১ সালে বি.এনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। আসামি বশির উদ্দীন বাদী এড শহীদুল হুদা এবং শেষ তদন্ত কর্মকর্তা সি.আই.ডি’র সহকারী পুলিশ কমিশনার কাদের খাঁন মামলা চলাকালীন সময় মৃত্যুবরণ করেন। অন্য আসামী জে.সি মন্ডল দীর্ঘদিন ভারতে পালিয়ে থেকে সেখানে মারাযান। ২০০৩ সালে রকিবুল হুদা জামিনের শর্ত ভঙ্গ করে সপরিবারে আমেরিকা পালিয়ে যান। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসকালে কিছুদিন পরে তিনিও মারা যান। ১৬৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪১ জনের সাক্ষি গ্রহণ করা হয়। এদিকে গণহত্যায় নিহতদের স্বরণে কোর্টবিল্ডিং পাদদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি এলেই নেতারা সেখানে জড় হয়ে স্মরণসভাসহ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি চট্টগ্রাম বাসির। যা এখনো পূরণ হয়নি। সেই দিন স্বৈরশাসকের উদ্দেশ্যে ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা কিন্তু তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও আমরা হারিয়েছি ২৪ জন নেতাকর্মীকে। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে নাপারলে হয়ত এই মামলার কবর রচনা হয়ে যেত। ’৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি সি.আই.ডি কর্মকর্তা এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন ’৯৮ সালের ৩ নভেম্বর পুলিশের ৮ সদস্যকে আসামি করে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট এ মামলার হাফিজ উদ্দীন দেওয়ান নামের এক পুলিশের সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এর আগে ২০১৪ সালে পাঁচ কর্ম দিবসে এবং ২০১৩ সালে ৮ কার্যদিবসে.মামলার কোন সাক্ষীকে হাজির করা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি সাক্ষী ধার্য দিন থাকলেও সাক্ষী হাজির না হওয়ায় ৯ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়। এভাবে দীর্ঘ ৫ বছর একজন সাক্ষিও হাজির করতে পারেনি পুলিশ। ২৩ বছরে ১৬৮ সাক্ষির মধ্যে মাত্র ৩৫ জন সাক্ষির সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। চট্টগ্রাম মহানগর অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলে আসে। এরপর সাক্ষি হাজির না হওয়ায় ২০১৪ সালে এ মামলার বিচারক এক আদেশে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধি ১৭১ (২) এর ধারা অনুযায়ী আসামিদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশকেই নিতে হবে বলে জানান। এই মামলার সাক্ষি প্রখ্যাত সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী আদালতের সমন না পাওয়ায় সাক্ষি দিতে পারেননি। মামলার বিচারের শেষ দেখতে পারেনি বাদী এড. শহিদুল হুদাও তিনি ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনরা। শহীদ স্বপনের বউ রেবা চৌধুরী তার একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে চাকুরির জন্য নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। কিন্তু কোন প্রতিকার পাননি। এনজেল গোমেজের কন্যা পাপড়ি গোমেজ জন্মের ২দিন পর তার পিতাকে হারিয়েছিলেন। তার মাতা রুচিয়া গোমেজও বিচারের শেষ দেখতে পারেনি। তিনিও কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছিল খুনিদের বিচারের দাবিতে। নিহতদের স্মরণে ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি স্মৃতি স্তম্ভটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করারপর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালত পুলিশের অপরাধ বিভাগের ওসি সিআইডিকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ প্রদান করেন। ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এতে রাষ্ট্রপক্ষ নারাজি দেন। ২০০০ সালের ৯ মে ৮জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালতে বিচার শুরু হয়। ৮জন সকলেই ছিলেন পুলিশ সদস্য। এ মামলায় সাক্ষিদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু রয়েছেন। তাঁদের সাক্ষি আদলতে নেওয়া হয়নি। বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে সাক্ষি হাজির না হওয়ায় মামলাটি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের পর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁশলীরা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে সাক্ষিদের হাজির করে বিচার কার্য সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে ৫জন আসামিকে ফাঁসির আদেশ প্রদান করে মামলার ইতি টানেন। এতে করে দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ’৭১ এ গণহত্যার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কন্যা বিশ্বনেত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ’৮৮ গণ-হত্যার খুনিদের বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির রায় দিয়ে এদেশ থেকে চিরতরে হত্যা কু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বন্ধ করেন। এই বিচারের রায়ে শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে । পরিশেষে ’৮৮র ২৪ জানুয়ারি নিহত সকল শহিদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক: শ্রম সম্পাদক
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ