২২ ঘণ্টা পর সিলেটের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক

45

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় বন্ধ থাকার ২২ ঘণ্টা পর সিলেটের সঙ্গে সারদেশের রেল যোগাযোগ চালু হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতে ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ চট্টগ্রামের উদ্দেশে সিলেট ছেড়েছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) আবু রাসেল জানান, উপবনের দুর্ঘটনা কবলিত পাঁচটি বগি উদ্ধার করে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে লাইন মেরামত শেষ হয়। লাইন পরীক্ষা শেষে রাত সাড়ে ৯টায় সিলেট থেকে ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এর পরের নির্ধারিত ট্রেনগুলো সময়মতো ছাড়বে।
এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য বড়ছড়া রেলসেতু নয়, অন্য চারটি কারণকে চিহ্নিত করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে এজন্য গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি। এ চারটি কারণ হচ্ছে লাইনের দুর্বলতা, চাকার কম্বিনেশন, দ্রæত গতিতে ট্রেন চালনা এবং ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেইন জানান, লাইনের দুর্বলতা কিংবা চাকার কম্বিনেশনের কারণে ঘটতে পারে এ দুর্ঘটনা। তিনি জানান, একটি ট্রেনে সচরাচর ১২-১৪টি বগি থাকে। কিন্তু, দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটিতে বগি লাগানো হয়েছিল ১৭টি। প্রতিটি বগিতে সিট ছিল ৬৫টি। এ হিসাবে ট্রেনটিতে প্রায় ১ হাজার ১০৫ জন যাত্রী ছিলেন। এর বাইরে আরও অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রেলওয়ে সচিব জানান, দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনের সর্বশেষ বগি বড়ছড়া রেলসেতুর নিচে পড়ে যায়। পরে দুটি বগি উল্টে যায় এবং এর পরের দুটি বগি রেলে দাঁড়ানো অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে।
সচিব জানান, তদন্তকারীরা দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন এবং ব্রিজের (রেলসেতু) ছবি নিয়ে গেছে। তদন্ত কমিটি সার্বিক বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ৮শ গজ রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বগাছড়া রেলসেতুর কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে যাত্রীসহ অনেকেরই ধারণা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকেই এ বিষয়ে মন্তব্য করছেন। রেলওয়ে কুলাউড়ার ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জুয়েল আহমদের কাছে এ রেলসেতুর কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ কারণে ঘটেছে বলে মনে হয় না।
তিনি বলেন, বড়ছড়া ব্রিজটি (রেলসেতু) অনেক দিন আগে নির্মিত হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনা ব্রিজের কারণে নয়, লাইনে ত্রুটির কারণে ঘটতে পারে তার ধারণা। তিনি জানান, ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী ছিল এবং স্প্রিংগুলো ছিল অনেক পুরাতন। দুর্ঘটনার পেছনে এটাও কারণ হতে পারে। -খবর বাংলা ট্রিবিউনের
কুলাউড়ার ইউএনও মো. আবুল লাইছও ট্রেনটিতে অতিরিক্ত যাত্রী ছিল বলে এ প্রতিবেদককে জানান।
স্থানীয় বরমচাল গ্রামের বাসিন্দা জাকারিয়া আলম জানান, সিলেট-ঢাকা রেল রুটের মোগলাবাজারে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর কালনি এক্সপ্রেসকে পার হওয়ার সুযোগ দিতে (ক্রসিং) উপবন এক্সপ্রেসের প্রায় আধা ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। ফলে সময়ের এ ঘাটতি পোষাতে চালক ট্রেনটি দ্রæতগতিতে চালাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পেছনে এটা অন্যতম কারণ হতে পারে বলে জানান জাকারিয়া।
প্রত্যক্ষদর্শী বরমচাল স্টেশনের চা দোকানি ফারুক মিয়া জানান, ‘খুব স্পিডে ট্রেনটি চালানো হচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময় বিকট শব্দ হয়। এটা শুনে এলাকাবাসী উদ্ধার তৎপরতায় নেমে পড়েন।’
দুর্ঘটনাস্থলে জড়ো হওয়া এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা অভিযোগ করেন, রেল লাইনের ¯িøপারের নাট-বল্টু, হুক-ক্লিপ একেবারে ঢিলা হয়ে গেছে। কাঠের ¯িøপারগুলোও ছিল দুর্বল। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা বিরাজমান থাকলেও এগুলো সংস্কারের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
রবিবার রাতে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রেল সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন ও রেলওয়ের ডিজি কাজী রফিকুল আলমসহ পদস্থ কর্মকর্তারা বিশেষ ট্রেনে করে ঘটনাস্থলে আসেন। সোমবার ভোরে তারা কুলাউড়ায় পৌঁছেন। তারা দিনভর সেখানে অবস্থান করে উদ্ধার তৎপরতা তদারকি করেন।
দুর্ঘটনা কবলিত বগির যাত্রী সুনামগঞ্জ সদরের পইদা গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার আগে ট্রেনটির স্পিড হঠাৎ বেড়ে যায়। এরপর ট্রেন থেকে বগি ছিটকে পড়ে। দুর্ঘটনায় তার মাথা ফেটে যায়।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের বাসিন্দা ফজলুল হক জানান, তিনি ৭ নম্বর বগিতে ছিলেন। হঠাৎ ট্রেনের ৫টি বগি উল্টে গেলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনের যাত্রী সিলেটের বøু বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র ইমরান আহমদ, রবিরবাজারের বাসিন্দা এআইইউ এর ছাত্র আহমদ তোফায়েল, কাদিপুরের পলাশ ও নোয়াখালির ফাতেমা আক্তার আনু জানান, ট্রেনটি একবার দ্রæতগতিতে, একবার ধীর গতিতে চলছিল। বরমচাল স্টেশন প্রবেশের সময় ট্রেনটির গতি ছিল সর্বোচ্চ।
কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ দুর্ঘটনায় আহত ৬৮ জনকে এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল দুটির সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সিলেটের সঙ্গে রেল যোগাযোগ শুরু : সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপন হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় সেতু ধসে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ার পর সোমবার দিনভর চেষ্টা চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন ও ব্রিজটি মেরামত করেন রেল বিভাগের কর্মীরা। মেরামত শেষে সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে ওই রেললাইন ও ব্রিজের ওপর দিয়ে চালানো হয় ট্রায়াল ট্রেন। এ ট্রেন চালাতে গিয়ে কোনও সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রেলওয়ে বিভাগের কুলাউড়ার উপ-সহকারী প্রকৌশলী জুয়েল আহমদ এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ট্রায়াল ট্রেন সমস্যা ছাড়াই চালাচল করেছে। এখন রেল চলাচলে আর সমস্যা নেই। সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস রাত ৯টায় নির্ধারিত সময়েই ছেড়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে রবিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকার অদূরে সেতু ভেঙে ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনের কয়েকটি বগি খালে পড়ে যায়। এই ঘটনায় চার জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। সেতু ভেঙে লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিটের সঙ্গে এলাকাবাসীও কাজ করে।
এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রেলওয়ের প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্ব) মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আরও তিনজন সদস্য হলেন প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, সুজিত কুমার বিশ্বাস ও ময়নুল ইসলাম।