১৭ চিকিৎসকের মধ্যে থাকেন তিন-চারজন

72

বাঁশখালী হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক আছেন ১৭ জন। তবে প্রতিদিন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন মাত্র তিন থেকে চারজন। এরমধ্যে আবার অনেকেই নির্ধারিত কর্মসময়ে হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন না। আসলেও দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা অবস্থান করেই হাসপাতাল ছাড়েন। অবৈধ রোস্টারের (কর্মবণ্টন) সুবিধা নিয়ে এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি দিচ্ছেন বাঁশখালীর চিকিৎসকরা। এতে চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন উপকূলীয় এ উপজেলার রোগীরা।
গত বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বাঁশখালী হাসপাতালে সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সরেজমিনে পরিদর্শনকালে চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলা ও রোগীদের চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার চিত্র দেখা যায়। হাসপাতালে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বসানো বায়োমেট্রিক মেশিনেও জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ও উপ-পরিচালক ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী পূর্বদেশকে বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অবশ্যই চিকিৎসকদের হাসপাতালে থাকতে হবে। এখন মন্ত্রণালয় বলছে বায়োমেট্রিক মেশিন থাকায় সাড়ে ৯টার মধ্যে চিকিৎসকদের হাসপাতালে উপস্থিত হতে হবে।’
রোস্টার করা ও বায়েমেট্রিক মেশিন জালিয়াতির বিষয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ‘আগের দিন রাতে ডিউটি করলে পরদিন ছুটি। এজন্য রোস্টার করা হয়। বাকি সময়ে চিকিৎসকদের নিয়মিত হাসপাতালে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন কতজন চিকিৎসক ছিল। বাকিরা কেন উপস্থিত ছিল না বিষয়টি আমি দেখবো। তাছাড়া বায়োমেট্রিক মেশিনে আধঘণ্টা সময় কমিয়ে দিয়ে তাঁদের লাভ কী তাও তদন্ত করবো। হাসপাতালের সময় কমিয়ে দিলেও এখানে কারা উপস্থিত থাকেন সেটি নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ আছে। বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করবো।’
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. জুবুরিয়া শারমীন। আগের দিন রাতে তিনি ডিউটি করলেও পরবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক না আসায় তিনি তখনো দায়িত্বে। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে ডা. জুবরিয়ার পরিবর্তে জরুরি বিভাগের দায়িত্ব নেন চিকিৎসক আয়েশা মুনমুন। সকাল ৯টা ৪২ মিনিটে বর্হিবিভাগের ৫নং কক্ষে প্রবেশ করেন ডা. হীরক কুমার পাল। ডাক্তার আসার আগেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন বেশ কয়েকজন রোগী।
রোগীদের একজন শীলকূপের ছাবের আহমদ বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসা নিতে পারছি না।’ বড়ঘোনার পারেছা বেগম বলেন, ‘নগরীর শেভরনে ডা. হাছান আরিফকে দেখিয়েছি। উনি আসবে জেনে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে হাসপাতালে অপেক্ষা করছি।’ সকাল ১০টায় ছনুয়ার রোগী কবির আহমদ বলেন, ‘হাছান আরিফকে আগে একবার দেখিয়েছি। ভালো লাগার কারণে আবারো আসছি।’ চিকিৎসক কারা আছেন জানতে চাইলে টিকিট বুকিং ক্লার্ক শিলু জানান, ‘হীরক স্যার আছেন। ডা. হাছান আরিফ, আমিনুল হক থাকার কথা আজ।’
১০টা ১০ মিনিটে প্যাথলজি কক্ষের সামনে থাকা বেঞ্চে বসে মা-ছেলে অপেক্ষা করলেও কক্ষটি তালাবদ্ধ ছিল। উত্তর জলদী গ্রামের রোগী উৎপল দেবের মা জানান, ‘সাড়ে ৯টায় এসেছি। কেউ নাই। সবাই ঠিকমতো আসলে কাউকে অপেক্ষা করতে হতো না। উনি আসলে আমার ভালো হতো। এখন বাইর থেকে পরীক্ষা করতে হবে।’ তবে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্যাথলজি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান পরিতোষ বড়ুয়া ছুটিতে আছেন।
বর্হিবিভাগের চিকিৎসক না থাকলেও রোগীর চাপ ছিল বেশি। এরমধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে দেখা যায় তিনিও নাই। হাসপাতালের প্রধান সহকারী প্রভাষ পাল জানান, ‘হাসপাতালের নির্বাহী প্রধান (ইউএইচএফপিও) ডা. কমরুল আযাদ ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. তৌহিদুল আনোয়ার ছুটিতে আছেন। দায়িত্বে আছেন ডা. হীরক কুমার পাল।’
সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নার্সিং কক্ষে সিনিয়র নার্স নাহিদাসহ ছয়জন বসে আছেন। পুরুষ ওয়ার্ডের ৩৮নং বেডে ভর্তি আছেন কালীপুরের রফিক নামে এক রোগী। ওই রোগীর স্বজন জানান, ‘৪৮নং বেডে ভর্তি থাকা এক রোগী রাতে মারা গেলেও কেউ আসেনি। নার্সরা এসে দেখে গেছে। আমি ভর্তি আছি চারদিন। এরমধ্যে মাত্র দুইবার ডাক্তারের দেখা পেয়েছি।’
৪৯ নং বেডে ভর্তি রোগী মোহাম্মদ উল্লাহর স্বজন আরেফা বেগম বলেন, বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় একজন মহিলা ডাক্তার আসেন। পরে নার্সরা আসলেও আর কোনো ডাক্তার আসেননি।
৫০ নং বেডে ভর্তি রোগী মনির আহমদের স্বজন মো. আলমগীর বলেন, কাল (বুধবার) সন্ধ্যা ৬টায় ভর্তি হওয়ার সময় জরুরি বিভাগে একজন ডাক্তার দেখেছেন। এরপর ওয়ার্ডে আর কোনো ডাক্তার আসেননি।
মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা শিশু রোগীর স্বজন রিপু আক্তার বলেন, কাল সকাল ১০টায় ডাক্তার আসেন। আর কোনো ডাক্তার আসেননি। নার্সরা সন্ধ্যা ৬টায় এসে ইনজেকশন পুশ করে গেছেন। ২১ নং ওয়ার্ডে রাত ৩টায় ভর্তি হয়েছেন এক রোগী। তার স্বজন রোশনারা ইয়াসমিন বলেন, জরুরি বিভাগের মহিলা ডাক্তারকে দেখিয়ে ভর্তি করিয়েছি। এরমধ্যে একবার সমস্যা দেখা দেয়ায় আমি নিজেই নিচে নেমে আবারো ডাক্তারের কাছে গেছি। ডাক্তার একবারও আসেননি।
চিকিৎসক না থাকলেও রোগীর চাপ ছিল বর্হিবিভাগে। এরমধ্যে সকাল ১১টার দিকে হাসপাতালে আসেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আরিফ হাছান। তিনি বর্হিবিভাগের পরিবর্তে দ্বিতীয় তলায় কনসালটেন্ট কক্ষে বসেন। বর্হিবিভাগে ৫ নং কক্ষে ডা. হীরক পাল ও ২ নং কক্ষে রোগী দেখছিলেন সিনিয়র নার্স পারুল নাথ। দুপুর ১টা পর্যন্ত এ দুইজন মিলে বর্হিবিভাগে ২২৩ জন রোগী দেখেন। এরমধ্যে প্রায় ১২৪ জন রোগী একাই দেখেন ডা. হীরক পাল। ১টা পর্যন্ত ডা. আয়েশা মুনমুন জরুরি বিভাগে, ডা. জুবুরিয়া শারমিন স্বাস্থ্য সহকারীদের সভায় থাকলেও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আরিফ হাছান হাসপাতাল ত্যাগ করে শহরের উদ্দেশে রওনা দেন।
৫ নং কক্ষে রোগী দেখতে ব্যস্ত ডা. হীরক কুমার পাল পূর্বদেশকে বলেন, ইউএইচএফপিও, আরএমওসহ আরো কয়েকজন ছুটিতে। যে কারণে আমিসহ কয়েকজন উপস্থিত আছি। চিকিৎসা সেবা তো প্রদান করতে হবে।
বায়োমেট্রিকে জালিয়াতি : হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কমরুল আযাদের কক্ষের সামনেই বসানো হয়েছে বায়োমেট্রিক মেশিন। বেলা ১১টার দিকে এ মেশিনের সামনে গেলে দেখা যায়, মেশিনে ভেসে থাকা সময় ১০টা ২৩ মিনিট। প্রায় ৩৭ মিনিট সময় পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে প্রধান সহকারী প্রভাষ পাল বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না।’
সেখানে উপস্থিত একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকার চিকিৎসক-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। চিকিৎসক-কর্মচারীরা দেরিতে আসলেও যেন নির্ধারিত সময় উল্লেখ থাকে সেজন্য ইচ্ছে করেই বায়োমেট্রিক মেশিনের সময় কমিয়ে দেয়া হয়েছে।’
রোস্টারের গ্যাঁড়াকলে রোগী : চিকিৎসকরা নিজেরাই বোঝাপড়া করে ডিউটি বণ্টন করে নিয়েছেন। সরকারি চাকরিতে তাঁদের প্রতিদিন উপস্থিত থাকার নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ চিকিৎসক ডিউটি রোস্টার করে সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন উপস্থিত থাকেন। রোস্টারের হিসাব মতে, শনিবার ডা. রেশমি বিশ^াস, ডা. মো. আমিনুল ইসলাম, ডা. হীরক কুমার পাল, রবিবার ডা. হীরক কুমার পাল, ডা. মনিরা ইয়াসমিন, ডা. শারমিন আক্তার, ডা. মো. আমিনুল ইসলাম, সোমবার ডা. আয়েশা মুনমুন, ডা. হীরক কুমার পাল, ডা. মো. আমিনুল ইসলাম, ডা. আমিনুল হক, মঙ্গলবার ডা. হীরক কুমার পাল, ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি, ডা. মো. আমিনুল ইসলাম, বুধবার ডা. শারমিন আক্তার, ডা. মনিরা ইয়াসমিন, ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি, বৃহস্পতিবার ডা. হীরক কুমার পাল, ডা. জুবুরিয়া শারমিন ও ডা. আমিনুল হক দায়িত্ব পালন করার কথা। এভাবে রোস্টার করে রাখার কারণে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বাঁশখালীর রোগীরা।
জানা যায়, অনেক চিকিৎসক পুরো সপ্তাহ ছাড়াও রোস্টারে উল্লেখ থাকা সময়েও হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন না। কেউ কেউ আউটডোরে রোগী না দেখে অফিস প্রধানের কক্ষে সময় কাটিয়ে শহরে ফিরেন। অফিস চলাকালীন সময়ে উপজেলা সদরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবে রোগী দেখতেও ব্যস্ত থাকেন কয়েকজন চিকিৎসক।
হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কমরুল আযাদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘অনেকেই প্রশিক্ষণে ছিল। যে কারণে সাময়িক সমস্যা হয়েছে। এখন ঠিক হয়ে যাবে। হাসপাতালের সবকিছু এখন সিরিয়াসলি মনিটরিং করা হচ্ছে। বায়োমেট্রিক মেশিন আছে। কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না। আমি নিজেও ছুটিতে ছিলাম। যারা ইচ্ছে করে ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’