১৫ আগস্ট, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অতঃপর বাংলাদেশের রাজনীতি

259

স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোর রাতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে, হত্যা করে পরিবারের অনেক সদস্যকে। সেনাবাহিনীতে কর্মরত এবং সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ৮/১০ জন মেজর দৃশ্যতঃ ইতিহাসের ওই ঘৃণ্য হত্যাকাÐের নেতৃত্ব দেন। মহান নেতার লাশ ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে অবহেলিত অবস্থায় রেখেই বঙ্গবন্ধুর প্রায় ৪০ বছরের সহকর্মী এবং তাঁরই মন্ত্রীসভার বাণিজ্যমন্ত্রী পাষÐ খন্দকার মোস্তাক আহমদ নির্লজ্জের মতো রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করে। শপথ অনুষ্ঠানে সশস্ত্রবাহিনীর প্রধানসহ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা বন্দুক উঁচিয়ে ঢাকার রাজপথে টহল দিচ্ছিল। বেতার, টিভি, বঙ্গবভনসহ কয়েকটি স্থানে ছিল ট্যাংক মোতায়েন। সবকিছুই যেন স্বাভাবিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। সবাই আছেন, শুধুমাত্র নেই একজন। তিনি হাজারো বছরের বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান!
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা কেউ জাতির পিতার লাশ শেষবারের মতো একটিবারের জন্যও দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। ঘাতকদের দ্বারা নিহত বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, তিনপুত্র, ভাই, দুই পুত্রবধূ, ভাগ্নে সস্ত্রীক শেখ ফজলুল হক মনি, ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে ১৫ আগস্ট শুক্রবার দিবাগত শেষ রাতে বনানী গোরস্থানে গণকবর দেয়া হয়। নিহতরা সবাই মুসলমান হওয়া সত্তে¡ও তাঁদের কাউকে গোসল করানো হয়নি, কাফনের কাপড় পড়ানো হয়নিÑ এমনকি জানাজা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। যদ্দুর জানা যায়, তাঁদেরকে মাটিচাপা দেয়া হয়। এতগুলো লাশ দাফন করতে রাত ভোর হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর লাশ ১৬ আগস্ট দুপুরের পর হেলিকপ্টারে জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়।

সৈনিকরা মহান নেতার মরদেহ গোসল ছাড়াই দাফন করার উদ্যোগ নিলে স্থানীয় মৌলভী সাহেব এর প্রতিবাদ করেন।১২/১৪ জন লোকের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে রিলিফের শাড়ি কাফনের কাপড় হিসেবে পরিয়ে বাঙালির দুলাল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অত্যন্ত দ্রæততার সাথে চরম অবহেলাভরে ১৬ আগস্ট বিকেল প্রায় ৪টার দিকে কবর দেয়া হয়। এই যে মৃত্যুর পরেও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যকে তাঁদের প্রাপ্য জানাজা ও গোসল থেকে বঞ্চিত করা হলো, তার প্রতিবাদ কি আমরা কেউ করেছি? করিনি। এই অন্যায়ের জবাব একদিন ইতিহাসের কাছে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই জাতিকে দিতে হবে।
১৫ আগস্টের হত্যা-ষড়যন্ত্রে দেশ-বিদেশের অনেকেই জড়িত ছিল। ’৭১- এ পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি যারা মেনে নিতে পারেননি, স্বাধীনতাবিরোধী সেসব দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রই সুপরিকল্পিতভাবে জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। খন্দকার মোস্তাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ সিভিলিয়ানদের অনেকেই এতে জড়িত ছিল। সামরিক বাহিনীর তৎকালীন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ প্রত্যক্ষ আবার কেউবা পরোক্ষভাবে ১৫ আগস্ট হত্যাকাÐে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম হচ্ছে জে. জিয়াউর রহমান। একাত্তরের ২৭/২৮ মার্চ অন্য আরো কয়েকজনের মতো চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ বা প্রচারকারি ছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। তাছাড়া যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার নিযুক্ত ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের ১ জন ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হবার পর কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানীর পরামর্শে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হয়। এই পদোন্নতিতে সঙ্গত কারণেই ক্ষুব্ধ হন জিয়াউর রহমান। মেজর থেকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউর রহমানকেও উপ প্রধান করা হয়। ১৫ আগস্টের পর জে. জিয়া সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্র্রপতি হন এবং নিজেকে নিজে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি দান করেন।
’৭৫ সালে ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। আর বঙ্গবন্ধু হত্যা- ষড়যন্ত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে দুই ভায়রা ভাই মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক। এরা দু’জনই ৪৬ ব্রিগেড-এর ২টি ইউনিটের প্রধান ছিলেন। এই দুই ইউনিটের অফিসার- জোয়ানরাই ১৫ আগস্ট হত্যাকাÐে অংশ নেয়। শাফায়েত জামিল তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় ঘাতক রশিদ ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলে- “আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি। কোনো প্রকার প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন না।’ ঐ সময়ই সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সাথে শাফায়েত জামিলের টেলিফোনে কথা হয়। শাফায়েত জামিলের কথা অনুয়ায়ী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেনাপ্রধান তাকে কোন প্রকার নির্দেশ দেননি। কাছেই ছিল সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীপ জিয়াউর রহমানের বাসা। জিয়ার বাসায় গেলেন সাফায়াত। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পর দরজা খুললেন ডেপুটি চীপ স্বয়ং। এক গালে শেভিং ক্রিম লাগানো, আরেক দিক পরিষ্কার। শাফায়াতের কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা শুনে জিয়া বললেন, “ঝড় যিধঃ, চৎবংরফবহঃ রং ফবধফ, ঠরপব চৎবংরফবহঃ রং ঃযবৎব, এবঃ ুড়ঁৎ ঃৎড়ড়ঢ়ং ৎবধফু. টঢ়যড়ষফ ঃযব ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ. অর্থাৎ ‘পেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন, তাতে কি হয়েছে? ভাইস প্রেসিডেন্টতো আছেন। তুমি তোমার সৈন্য প্রস্তুত করো। সংবিবধান সমুন্নত রাখতে হবে।’ জিয়াউর রহমানের এই মন্তব্য শুনে শাফায়াত জামিলও আশ্চার্যাম্বিত হন। ১৫ আগস্ট তিনি এ ব্যাপারে মেজর (পরবর্তিতে ব্রিগেডিয়ার) সাখাওয়াত হোসেনের কাছে প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেন। সাখাওয়াত হোসেন তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “ শাফায়াত জামিল জিয়াউর রহমানের এ মন্তব্য পরে আমাদের কয়েকজনকে বলেছিলেন, ‘ ঐড়ি পড়ঁষফ যব (তরধ) ৎবসধরহবফ ংড় ঁহাবৎাবফ ধভঃবৎ যবধৎরহম ংঁপয ধ ংযড়পশরহম হবংি রিঃযড়ঁঃ ধহু ৎবধপঃরড়হ?
কথাটা সেদিনের প্রেক্ষাপটে সত্যই আশ্চর্য মনে হয়েছিল। কারণ এ রকম একটা অপ্রত্যাশিত খবর শোনামাত্র স্বভাবতই প্রত্যেকের হতচকিত ও আশ্চর্যাম্বিত হওয়া অত্যন্ত স্বভাবিক এবং পরবর্তী রিঅ্যাকশন হওয়াও স্বভাবিক।”
১৫ আগস্ট নানা কারণে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক। জে. সফিউল্লাহর ভাষ্য অনুয়ায়ী, জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেয়ার পক্ষে ছিলেন। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো সামরিক অফিসার খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললে জেনারেল জিয়া এর বিরোধীতা করেন। জে. জিয়া বলেছেন, ‘প্রতিবেশি ভারত বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পারে। এ সময় হত্যাকারী অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে সেনাবাহিনীতে বিভক্তি এসে যাবে। অতএব এখন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যাবে না।
বিশৃঙ্খলজনিত আচরণে অভিযুক্ত সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত মেজর ডালিম সামরিক বাহিনীর পোষাক পড়ে, সামরিক বাহিনীর গাড়ি নিয়ে চাকরিরত জোয়ানদের সাথে নিয়ে ১৫ আগস্ট ভোরে সেনা সদরে যায়। কুলাঙ্গার মেজর ডালিম দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতর গিয়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লারহর দিকে স্টেনগান তাক করে তাকে সেনা ভবনে যেতে বলে। এ সময় উপপ্রধান জে. জিয়াউর রহমান, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ, কর্নেল (পরে জেনারেল) নাসিমসহ আরো অনেকে সেখানে ছিলেন। ডালিমকে সেনা প্রধান অস্ত্র রেখে তার সাথে কথা বলতে বলেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত জিয়াসহ সিনিয়র অফিসাররা কেউ তাকে কিছু বলেননি বা ডালিমের চরম ঔদ্ধত্যের বিরোধিতা করেননি। খুনি ডালিমের প্রতি জিয়ার এই নমনীয় আচরণের কারণ আজো রহস্যবৃত। সেনাপ্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে খুনি মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে ডালিম একরকম জোরাজুরি করে। এক পর্যায়ে সেনাপ্রধানকে ডালিম হত্যারর হুমকি দেয়। সেদিন সেনা সদরে চাকরিচ্যুত ডালিমকে গ্রেপ্তার করা হলে ইতিহাস অন্যরকম হতো। ডালিম চক্রেম স্টেনগানের মুখেও সেনাপ্রধান বেতার ভবনে না গিয়ে ৪৬ ব্রিগেড কার্যালয়ে যান। কর্নেল হামিদ, ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন, জে. মইনুল হোসেনের গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে।
জেনারেল মইনুল তার গ্রন্থে এমনসব তথ্য দিয়েছেন, যা পড়লে পাঠক স্তম্ভিত হবেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই সময় সবার সামনেই সেনাবাহিনীর উপ প্রধান জিয়াউর রহমান ঘাতক ডালিমকে তার গাড়িতে ঊঠার আমন্ত্রণ জানায়। এ বাপারে স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদ তার লেখা তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এমন সময় দেখি সেনাপ্রধানের অফিসের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন জেনারেল সফিউল্লাহ। তার পেছনে পেছনে স্টেনগান হাতে মেজর ডালিম। সফিউল্লার মুখ কালো, গম্ভীর। স্পষ্ট বুঝা গেল একান্ত অনিচ্ছায় তিনি ডালিমের সাথে বেরিয়ে আসছেন।, ডালিমের পেছনে ডেপুটি চীপ অফ স্টাফ জেনারেল জিয়া, । সফিউল্লাহ নিজের স্টাফ কারেই ঊঠলেন। ডালিম পেছনে। জিয়া তাকে সহাস্যে বললেন, ঈড়স ড়হ উধষরস রহ সু পধৎ,’
.ঘড় ংরৎ, ও ফড়হ’ঃ মড় রহ এবহবৎধষ’ং পধৎ’. । ডালিমের সুস্পষ্ট জবাব। বলেই স্টেনগান ঊঁচিয়ে তার সশস্ত্র জিপে চড়ে বসলো। ডালিমের পেছনে চললেন জে. জিয়া। তার পেছনে ডালিমের দ্বিতীয় সশস্ত্র জিপ। শো শো করে বেরিয়ে গেল চার চারটি জীপ।”
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড : ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস গ্রন্থে লিখেছেন: “… সফিউল্লাহ বেরুল- পেছনে জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান একটু এগিয়ে এসে ডালিমকে বললো কাম, জিয়া আবেগের কণ্ঠে ডাক দিলো: ণড়ঁ যধাব ফড়হব ংঁপয ধ মৎবধঃ লড়ন. করংং সব –শরংং সব. জিয়া ডালিমকে জড়িয়ে ধরল পরম ঊষ্ণতায়। জিয়া বললো: ণড়ঁ পড়সব রহ সু পধৎ. ঘঙ ঝরৎ, ঃযধহশ ুড়ঁ াবৎু সঁপয, ুড়ঁ ধৎব গধলড়ৎ এবহবৎধষ ধহফ ও ধস ধ ংরসঢ়ষব গধলড়ৎ. ঙঃযবৎ রিংব ুড়ঁ ধৎব ঃযব যবৎড় ড়ভ বৎঃরৎব ংযড়.ি ঝড় ঢ়ষবধংব ধষষড়ি সব ঃড় সু লববঢ়. মেজর জেয়াউর রহমান স্টাফ কাওে ঊঠল।”
১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক বক্তব্যে মেজর ফারুক বলে; ‘গত আগস্টে (১৯৭৫) আমি আমার ভায়রা ভাই মেজর রশিদের প্রস্তাবে খন্দকার মোস্তাককে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাবে একমত হই। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সেনাপ্রধান নিয়োগ করার জন্য চাপ দিই।’ একই বছর ২ আগস্ট লন্ডনে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক ১৫ আগস্ট হত্যা ষড়যন্ত্রে তৎকালীন উপ সেনাপ্রধান মেজর জে. জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার কথা তুলে ধরেন। এ্যান্থনী মাসকারেনহাস -এর কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফারুক-রশীদ দু’জনেই বলে, বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের কথা জিয়া আগেভাগেই জানতেন। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ৫ মাস আগে ১৫ মার্চ ৭৫ ফারুক দেখা করে উপপ্রধান জে. জিয়ার সাথে। ফারুক সরাসরি বলে, দেশের অবস্থা ভালো নয়। তারা জুনিয়ররা সরকার পরিবর্তনে জে. জিয়ার সহযোগীতা চান। জে. জিয়া বলেন, ‘একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে তার পক্ষে এসবে জড়িত হওয়া সম্ভব নয়। তবে জুনিয়ররা এ ব্যাপারে আগ্রহী হলে অগ্রসর হতে পারে।’ ফারুক-রশিদের এই সাক্ষাৎকার জে. জিয়ার শাসনামলেই প্রচারিত হয়। জে. জিয়া কোনদিন এর প্রতিবাদ করেননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঘাতক মোস্তাক, বিমানবাহিনীর প্রধান করেন এমজি তোয়াবকে। জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করে তোয়াবকে এক পর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন। তোয়াব এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যুক্তি দিয়ে বিচার করলে এবং মানবিক দিক দিয়ে চিন্তা করলেও মুজিব হত্যার ব্যাপারে জিয়া সবচেয়ে বড় অপরাধী।’ (সাপ্তাহিক জনমত, লন্ডন, ১ এপ্রিল ১৯৭৯)। ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মেজর ফারুক বলে, ‘জে. জিয়া বিভিন্ন সময়ে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার ব্যাপারে তাদেরকে ইনস্টিগেশন (প্ররোচিত) করেছেন।’ ১৫ আগস্ট হত্যা ষড়যন্ত্রে জে. জিয়ার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এই স্বল্প পরিসরে তা তুলে ধরা সম্ভব নয়।
১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রে শুধু জে. জিয়া নন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ আরো অনেকেই এতে জড়িত ছিলেন।ঢাকায় অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কথা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়া হোসেনের গ্রন্থে উল্লেখ আছে। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন তাঁর লেখা ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১ গ্রন্থে ১৮ আগস্ট ’৭৫ মেজর ডালিমের সাথে তার কথোপকথনের বর্ণনা দিয়েছেন। সাখাওয়াত জিজ্ঞাসা করলেন ডালিমকে ; ‘তারা গুটিকয়েক জুনিয়র অফিসার মাত্র ২টা ইউনিট নিয়ে এতো বড় ঘটনা কিখাবে ঘটালো? আর ব্যর্থ হলে তাদের পরিণতির কথা কি তারা চিন্তা করেছিল? হাসতে হাসতে ডালিম বললো, ‘এ অভ্যুত্থান বহুদিনের ফসল। সমস্ত সিনিয়র অফিসারদের এতে সমর্থন ছিল।’ আর ওদের কথিত অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে কি হতো- এই প্রসঙ্গে ডালিম জানায়, ‘ব্যর্থ হলে তারা ফলাফল দেখার মতো সময় পেতো না। এ চিন্তা করেই তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছিল। ব্যর্থ হলে শুধু তারাই নয়, ঢাকায় কর্তব্যরত প্রায় সব সিনিয়র সেনা অফিসারদেরকেই জড়িয়ে বিচারে বা নির্বিচারে ফায়ারিং স্কোয়াডের সম্মুখিন হতে হতো।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিনের মাথায় উপপ্রধান জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। হত্যাকারী ফারুক-রশিদ এই ব্যাপাওে বিশেষ ভুমিকা নেয়। এরপর উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাপ্রধান, সশস্ত্র বাহিনীসমূহের প্রধান ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে জে. জিয়া সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে ১৯৮১ সালের ৩০ মে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেশ শাসন করেন।
মুজিব হত্যার বিচার বন্ধ রাখতে খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। রাষ্ট্র্রপতি জিয়া তা আইনে পরিণত করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জে. জিয়াই রাষ্ট্র্রীয় চাকরি পুরস্কার করেন। জিয়াই স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য কয়জন দাললকে মন্ত্রী বানান।স্বাধীনতা বিরোধী গোলাম আজমকে তিনিই দেশে আনেন, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতকে জে. জিয়াই রাজনীতি করার সুযোগ দেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার বন্ধ করে তিনিই জেলে আটক হাজার হাজার দালালকে মুক্ত করে দেন। ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণিত যে কাজটি তিনি করেছেন তা হলো ’৭৭-এ ব্যর্থ অভুত্থানে সংশ্লিষ্ট থাকার দায়ে ২১শ’র বেশি সেনা সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন জে. জিয়া। জে. জিয়ার শাসনামলে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতারা উপেক্ষিত ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত হয়। একজন সেক্টরও কমান্ডার ও বীর উত্তম খেতাবধারী জে. জিয়া কেন এসব অপকর্ম করলেন, তার বিচার ইতিহাস একদিন অবশ্যই করবে। প্রবাসী লেখক মিনা ফারাহ ‘হিটলাম থেকে জিয়া’ গ্রন্থে ১৭৮টি কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না।’ মিনা ফারা’র বক্তব্যে কিছুটা বাড়াবাড়ি থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের একজন সেনানী জে. জিয়া সম্পর্কে এসব অভিযোগ খুবই কলঙ্কজনক। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জে. জিয়া কেন বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, কেনইবা স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ডে নিজে জড়িত হয়ে পড়লেন? ক্ষমতার লিপ্সায়?

লেখক: প্রকাশক ও গবেষক