১৫০ রেলক্রসিং ‘মৃত্যুফাঁদ’

113

চট্টগ্রামে অন্তত ১৫০টি রেল ক্রসিং ‘মৃত্যুফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। এরমধ্যে অর্ধেকই অবৈধ। লোকবল সংকট, ট্রেন চলকালেও খোলা থাকা, গাড়ি ও পথচারী পার হওয়াসহ নানা কারণে অহরহই ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় গত এক বছরে মারা গেছেন ১৫ জন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো স্থানে ক্রসিং নির্মাণ করলে সেখানে গেটকিপার নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বা অনুমোদন না নিয়ে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও রেললাইনের উপর রেল ক্রসিং নির্মাণ করে থাকে। যা রেলওয়ের আইনে নিষিদ্ধ।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু ট্রেনের গতি বাড়ানো হয়েছে। তাতে করে অবৈধ ও অরক্ষিত রেল ক্রসিংগুলো আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অরক্ষিত ক্রসিংগুলোর আগে ট্রেনের গতি কমানো ছাড়া চালকদের উপায় থাকে না। সাবধানতার পরেও যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালানোর জন্য চালকদের ক্রমাগত চাপের মধ্যে রাখা হয়। বলা হয়- ডিপার্টমেন্ট যে গতি নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই গতিতে চালাতে হবে।
জানা যায়, চট্টগ্রামে তিনটি রুটের অন্তত ১৫০টি রেল ক্রসিং মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। রুটগুলো হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনের মিরসরাই পর্যন্ত, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম-দোহাজারী। এ তিন রুটের কয়েকটিতে মাত্র গেট কিপার রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে তিনটি রেল রুটের অধিকাংশ ক্রসিংই অবৈধ। তিন রুটে হাতেগোনা কয়েকটি ক্রসিংয়ে গেটম্যান থাকলেও তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে কাজে গাফেলতির অভিযোগ। ফলে রেল দুর্ঘটনা কপাল লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, মিরসরাই উপজেলা এলাকার ডাবললাইনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে ট্রেন। এখানকার অরক্ষিত ৩০ কিলোমিটারজুড়ে ৭০ থেকে ৮০টি লেভেলক্রসিংই যেন মৃত্যুফাঁদ।
মিরসরাইয়ের ধুমঘাট রেলসেতু থেকে দক্ষিণের বারৈয়াঢালা পর্যন্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে অন্তত ৫০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং। চোরাই কাঠ ও পণ্য পরিবহনের স্বার্থে চোরাকারবারীরা এসব ক্রসিং তৈরি করেছে বলে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় লোকজন। এসব ক্রসিং বন্ধে বিভিন্ন সময় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হালকা পদক্ষেপ নিলেও তা কার্যকর হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে বারইয়াহাট, বিএসআরএম গেট, মহামায়া ব্যতীত বাকি চারটিতে কখনো গেটম্যান নিয়োজিত থাকে না। অবৈধ ক্রসিংগুলো দিব্যি ব্যবহার করছে চোরাকারবারী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ।
জানা যায়, সীতাকুন্ডে বড়দারোগারহাট থেকে সলিমপুর পর্যন্ত সমগ্র উপজেলার মধ্যেই রেলপথ রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে নিয়মিত বেশ কয়েকটি এক্সপ্রেস ট্রেন, লোকাল ট্রেন ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। এদিকে উপজেলার মধ্য দিয়ে যাওয়া রেলপথের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে রয়েছে অসংখ্য বসতবাড়ি, শিল্প প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, সরকারি ইকোপার্কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ফলে সাধারণ মানুষসহ অসংখ্য যানবাহন রেললাইনের উভয় পাশে আসা-যাওয়া করতে গিয়ে বহু রেল ক্রসিংয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথের ১০টি পয়েন্টে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এ রেল ক্রসিংএ প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। এ রেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে রয়েছে গোমদন্ডী রেলস্টেশনের পরে উপজেলা সড়ক, বেঙ্গুরা রেলস্টেশনের পরে সারোয়াতলী সড়ক, পটিয়া ধলঘাট রেলস্টেশনের পরে ধলঘাট ক্যাম্প ও চরকানাই সড়ক।খানমোহনা স্টেশনের আগে পটিয়া-বোয়ালখালী সড়ক, আমির ভান্ডার রেলগেট, খরনা রেলস্টেশনের নিকট ইউপি সড়ক, খরনা লালারখীল ও ভায়ারদিঘি সড়ক, কাঞ্চননগর রেলস্টেশনের আগে শাহছুপি সড়ক, খানহাট স্টেশনের পরে ছৈয়দাবাদ সড়ক, হাসিমপুর স্টেশনের পরে বাগিচাহাট সড়ক। উল্লেখিত সড়কগুলোতে লেভেল ক্রসিং-এ কোনো গেটম্যান নেই।
হাটহাজারী হতে নাজিরহাট পর্যন্ত ১৬ কি.মি রেলপথে ১৫ থেকে ২০টি বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২টিতে জনবল রয়েছে। তাও গত কয়েক মাস আগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলি হলো, হাটহাজারী সদরের হাসপাতাল গেট, মীরের হাট, কাটিরহাট স্টেশন সংলগ্ন ও জাব্বার হাট। হাসপাতাল গেট ও কাটিরহাট ছাড়া বাকি গেটগুলোতে কোনো জনবল নেই। হাটহাজারী হতে নাজিরহাট লাইনে দৈনিক ৮টি ট্রেন আসা-যাওয়া করে। স্থানীয়দের মতে, লাইনের বেশিরভাগ লেভেল ক্রসিংয়ের আশপাশে রয়েছে অবৈধ স্থাপনা। ফলে, ট্রেন আসছে কিনা তা দেখা বা টের পাওয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে চট্টগ্রাম স্টেশনের দূরত্ব সাড়ে ২০ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই রেললাইনে ২১টি পয়েন্টে লেভল ক্রসিং থাকলেও সবগুলোতে নেই গেটম্যান। ফলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। লেভেল ক্রসিংগুলো হল, বটতলী, দেওয়ানহাট ঝাউতলা বাজার, বিজিএমইএ’র সামনে (জিইসি টু একে খান রুট), ষোলশহর ২ নং গেট, ষোলশহর, হামজারবাগ, আতুরার ডিপু, আমিন জুটমিল, অক্সিজেন, ওয়াপদা গেট, বালুছড়া, নতুনপাড়া, বড়দিঘির পাড়, চৌধুরীহাট, ফতেয়াবাদ, ছড়ারকুল, নন্দীরহাট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক, দুই এবং তিন নং রুট। এই সব লেভেল ক্রসিং-এর মধ্যে বড়দিঘির পাড়, ছড়ারকুল, নন্দীরহাট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের এক, দুই এবং তিন নং রুটে অবস্থিত লেভেল ক্রসিং-এ কোনো গেটম্যান নেই।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক সৈয়ম ফারুক আহমেদ বলেন, বৈধ ক্রসিংগুলোতে লোকজন রয়েছে। কিছু গেটম্যান নিয়োগ হয়েছে। আরো কিছরু নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কর্মী সংকট সমাধান হলে সমস্যা লাঘব হবে। কোনো কোনো স্থানে অবৈধভাবে রেল ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, রেল ক্রসিংগুলোতে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। গত এক বছরে মারা গেছেন ১৫ জন। এর অধিকাংশই পথ পার হতে গিয়ে। গাড়িও দুর্ঘটনায় পড়েছে। হতাহতও হয়েছে।