১২ বছর ধরে হালদা দূষণ করছে এশিয়ান পেপার মিল

59

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাহাড়তলী এলাকার নন্দীরহাটে অবস্থিত এশিয়ান পেপার মিলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একুতি ছড়া (মরা খাল)। তা আবার হাটহাজারীর বিভিন্ন ইউনিয়নের কাটাখালি, খন্দকিয়া, বাথুয়া, মাদারি ও কৃষ্ণখালী খাল ধরে হালদা নদীতে গিয়ে মিশেছে। কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য এসব খালগুলোর মাধ্যমে হালদা নদীতে গিয়ে পড়ে। এতে নদীর জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে বেশ হুমকির মুখে ফেলছে।
বিগত ১২ বছর ধরে নীরবে এভাবে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী। অবশ্য এক্ষেত্রে জনশ্রুতি রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের একজন কর্মকর্তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের ১০ জুন পরিবেশ অধিদপ্তর হালদা দূষণের কারণে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল এ প্রতিষ্ঠানটিকে।
ওই সময় প্রতিষ্ঠানটিকে ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছিল অধিদপ্তর। ওই ঘটনার দুই মাসের মাথায় এশিয়ান পেপার মিলের বিরুদ্ধে ফের হালদা নদী দূষণের অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে গত ১০ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় ওই কারখানা থেকে পাশের মরা ছড়ায় ছুটির সুযোগে অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ছাড়ার প্রমাণ পেয়েছে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন। ওই রাতে ও পরের দিন রবিবার ইউএনও’র সাথে হালদা গবেষক দলের সদস্যরা উক্ত পেপার মিল তথা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
ওইদিন রাতে এশিয়ান পেপার মিল যে রাতের আঁধারে অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ছেড়ে দেয় হালদায় এর প্রমাণ মিলেছে ইউএনও’র সরেজমিন পরিদর্শনে।
জানা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে মানুষের ব্যস্ততার সুযোগে পানি ছেড়ে দিয়েছে এশিয়ান পেপার মিল। সংগ্রহ করা হয় দুই বোতল নমুনা। যা পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ইউএনও রুহুল আমিন বলেন, এশিয়ান পেপার মিলের বায়োলজিক্যাল প্ল্যান্টের ট্যাংকটি ছিল প্রায় ভরপুর। একটু বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বর্জ্য গড়িয়ে বাইরে পড়বে। পাশে আরেকটি ছোট্ট সংযুক্ত ট্যাংক আছে যেটা দিয়ে বর্জ্য বাইরের ছড়ায় চলে যাওয়ার সুযোগ রাখা আছে। তবে বর্জ্য ছাড়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম। তার দাবি, সেখানে কোনো তরল পদার্থ ফেলা হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, রবিবার দুপুরে কারখানায় গেলে কর্মকর্তারা ইটিপি কার্যকর আছে বলে দাবি করেন। তবে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তাদের একটি বায়োলজিক্যাল প্লান্ট চালু থাকার কথা বলা হলেও সেটিও চালু না। ওই প্লান্টের সাথে তিনটি পাইপ লাগানো, যা খালের সাথে যুক্ত। মিল কর্তৃপক্ষ প্রচুর বৃষ্টি হলে এবং দুই ঈদের ছুটিতে তারা জমিয়ে রাখা বর্জ্য ছেড়ে দেয়, যা অত্যন্ত অনৈতিক। পরবর্তীতে এসব বর্জ্য বিভিন্ন খালের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে হালদায় গিয়ে পড়ে। এতে হালদা দূষিত হয়। হালদা নদীকে বাঁচাতে হলে এশিয়ান পেপার মিলকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এটাই আমাদের দাবি।
তিনি আরও জানান, প্রতিষ্ঠানটির এ ধরনের অনৈতিক কাজ প্রায় ১ যুগ ধরে চলছে। অথচ চলতি বছরের ১৭ জুলাই বৃষ্টির আড়ালে তরল বর্জ্য ফেলে হালদা নদীর পানি দূষণের অপরাধে ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টকে তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) ও অয়েল ওয়াটার সেপারেটর স্থাপন না করা পর্যন্ত তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।
এই প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্জ্য ছাড়ার বিষয়ে আমরা শুনেছি। গত বুধবার আগস্ট এ বিষয়ে মিল কর্তৃপক্ষকে আমরা নোটিশ করেছি। তাছাড়া খালে ছেড়ে দেওয়া অপরিশোধিত তরল বর্জ্যরে নমুনা আমরা সংগ্রহ করেছি। আজ রবিবার (১৮ আগস্ট) সকাল ১১টায় এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিকের কার্যালয়ে শুনানী অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের ডিজি আমাদের ফোনে নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও আগের করা ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিষয়টি এখনো আপিলে আছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৩০ মে সত্তার ঘাট এলাকায় হালদা নদীর পাড়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে এশিয়ান পেপার মিলের বিরুদ্ধে মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।