১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড

23

প্রায় দুই দশক আগে ঢাকার পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিচার শেষে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) ১০ জঙ্গির ফাঁসির রায় এসেছে। ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম গতকাল সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার জীবিত ১২ আসামির মধ্যে দুইজনকে খালাস দেন তিনি।
২০০১ সালে যে দিনটিতে বোমা হামলা চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছিল, ১৯ বছর পর সেই একই তারিখে রায় দিল আদালত। সিপিবিকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করতে জঙ্গিরা ওই হামলা চালিয়েছিল পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য হরকাতুল জিহাদের এই জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ বলে এই আদালত মনে করে’।
হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানও ছিলেন এ মামলায় অভিযুক্ত আসামি। অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ মামলার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত দশ আসামির মধ্যে মুফতি মঈন উদ্দিন শেখ, আরিফ হাসান সুমন, সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। আর জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুত্তাকিন, আমিনুল মুরসালিন, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান ও নুর ইসলাম পলাতক।
এই দশ আসামিকে সর্বোচ্চ সাজার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। এছাড়া পলাতক দুই আসামি মো. মশিউর রহমান ও রফিকুল আলম মিরাজকে খালাস দিয়েছেন বিচারক। রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত চার আসামিকে নিবির্কার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মৃত্যুদন্ডের রায় শুনে তাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি। কোনো কথাও তারা বলেননি।
রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সালাহউদ্দিন হাওলাদার রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই মামলা হিমাগার থেকে আমরা টেনে নিয়ে এসেছি। ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা বদলির পর সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দেন। ওই হামলায় আহত বেশ কয়জন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা এই রায়ে সন্তুষ্ট’।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তেমন বড় কোনো দল নয়। তাদের তেমন কোনো কর্মীও নেই, দুর্বল পার্টি। তাদের সমাবেশে ছিল কিছু পুরনো, নষ্ট সাউন্ড সিস্টেম। নিজেরা আলোচনায় আসতেই নষ্ট ও পুরনো সাউন্ড সিস্টেম বিস্ফোরণের ওই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমাদের পক্ষ থেকে আদালতকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু আসামিদের একজন ভারতে আটক হওয়ায় এবং দেশটির একটি সংবাদপত্রে ওই আসামিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় আদালত তা আমলে নিয়ে এই রায় দিয়েছেন’। খবর বিডিনিউজের
আসামিপক্ষের এই কৌঁসুলি বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি সেনসেটিভ ইস্যু, একটি সংগঠনের বিষয়, তাই বিশেষ কাউকে খুশি করার জন্যই এই রায় দেওয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করছি’।
রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও অভিযোগপত্র দাখিলকারী সিআইডির পরিদর্শক মৃণাল কান্তি সাহা সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে আমি সন্তুষ্ট। হিন্দু পত্রিকায় হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্যের দায় স্বীকার করে দেওয়া বক্তব্যের সূত্র ধরেই এ মামলায় অধিকতর তদন্ত শুরু করি। শেষ পর্যন্ত জড়িত আসামিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ও শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট’।
এ রায়ের জন্য গতকাল সোমবার সকাল থেকেই আদালতপাড়ায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা। সবাইকে তল্লাশি করে তারপর আদালতে ঢুকতে দেওয়া হয়।
১৯ বছরের অপেক্ষা : ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির লাল পতাকা সমাবেশে এই বোমা হামলা হয়েছিল। তাতে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সিপিবি নেতা হিমাংশু মÐল, রূপসা উপজেলার সিপিবি নেতা ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা আব্দুল মজিদ, ঢাকার ডেমরার লতিফ বাওয়ানি জুটমিলের শ্রমিক নেতা আবুল হাসেম ও মাদারীপুরের কর্মী মোক্তার হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ দিন পর মারা যান খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বিপ্রদাস রায়। হামলায় আহত হয় শতাধিক।
ওই ঘটনায় সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মনজুরুল আহসান খান মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে দুই বছর পর ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোমিন হোসেন। তিনি আদালতকে বলেন, তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সিপিবির সমাবেশে হামলার পর ওই বছরের ১৪ এপ্রিল রমনায় বর্ষবরণের উৎসবে একই ধরনের বোমা হামলা হয়। কিন্তু তখন জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও তাদের তৎপরতার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর ছিল কম। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে জঙ্গি হামলার সঙ্গে যোগসূত্র পেয়ে ২০০৫ সালে সিপিবির সমাবেশে হামলার মামলাটির তদন্ত পুনরায় শুরু হয় আদালতের আদেশে।
সাত তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক মৃণাল কান্তি সাহা ১৩ আসামির বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি অভিযোগপত্র দেন। ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বিচার।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সালাউদ্দিন হাওলাদার বলেন, রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১০৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৮ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। তবে আসামিপক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষ্য দেননি।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে এ মামলার রায়ের জন্য ২০ জানুয়ারি দিন ঠিক করে দেন বিচারক। খবর বিডিনিউজের
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন : সেই জঙ্গি হামলার দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছিলেন তখনকার শিক্ষানবীশ আইনজীবী কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হীরক পাশা। রায়ের পর আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি সেদিনের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘ওইদিন বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। আতঙ্কিত মানুষ তখন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছিল। এর মধ্যে পুলিশ পল্টন ময়দানের দুই পাশের পথ বন্ধ করে দেয়। পুলিশের সঙ্গে তখন সিপিবিকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে’।
এই আইনজীবী বলেন, সেদিন সমাবেশের মধ্যে যে লোক বোমা রেখে গিয়েছিল, সে ছিল ‘পাতলা গড়নের, লম্বা, দাঁড়িওয়ালা’। বয়স ত্রিশের নিচে। সে কালো একটা পলিথিনে মোড়ানো ব্যাগ রেখে চলে গিয়েছিল। আমি পাশেই ছিলাম। তবে নেতাদের ছবি তোলার কথা খুলনার পুলককে বলতে ওখান থেকে উঠে যাই। এরপর ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে খুলনার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল মজিদ ব্যাগটি কার জিজ্ঞাসা করে সেটা হাতে নেন। তখনই বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। হিমাংশু খুলনা থেকে নিজের ক্ষেতের কলাই শাক নিয়ে এসেছিল। সমাবেশে শেষে এক আত্মীয়র বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। বিস্ফোরণে সেই কলাই শাক পর্যন্ত উপরে উঠে ছড়িয়ে যায়। হিমাংশুর পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। দুটো হাত উড়ে যায়, শরীরের মাংস বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়ে। হাশেম, মোক্তার ও হিমাংশুও নিহত হন’।
সেদিন সমাবেশে ছিলেন আইনজীবী জিয়াদ আল মালুম, যিনি এখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা চাই বিস্ফোরকের যে মামলাটি বিচারে রয়েছে, সেটির বিচার যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়। সেই মামলার রায়ের জন্য আমাদের যেন দেড় যুগ অপেক্ষা করতে না হয়’।
পল্টনের সেই সমাবেশে উপস্থিত থাকা বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির সভাপতি একেএম সোহেল আহমেদ এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। রায়ের পর তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১৯ বছর পর হলেও বিচার যে শেষ হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট’।
১০৪ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, আসামিরা হুজির সদস্য এবং তাদের ধারণা, সিপিবির লোকেরা ‘কাফের, বিধর্মী, নাস্তিক, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয়’। সে কারণে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে’ তারা ওই বোমা হামলা ঘটায়। বিচারক বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। কোনো জঙ্গি সংগঠনকে বা কোনো দলকে ধর্মের নামে নিরীহ ও নির্দোষ মানুষকে হত্যা করার অধিকার আল্লাহ দেননি’।
কোরআনের সুরা আল মায়েদাহর ৩২ নম্বর আয়াত থেকে উদ্ধৃত করে বিচারক বলেন, ‘নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল, সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করল’।
যে কারণে দু’জন খালাস : বিচারক তার রায়ে বলেন, আসামি আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক ও মো. নূর ইসলাম সিপিবির সমাবেশে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটালে ঘটনাস্থলেই ২৩ জন ব্যক্তি গুরুতর আহত হন, যাদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। আহত সবারই সেদিন নিহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ওই দুই আসামির বিরুদ্ধে দÐবিধির ৩০৭/৩২৪/৩২৬/৩৪ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনায় আসামি মো. নূর ইসলাম ও আরিফ হোসেন সুমনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩০৭/৩২৪/৩২৬/৩৪ ধারার এবং মুফতি হান্নান, মাওলানা সাব্বির আহম্মেদ, মাওলানা শওকত ওসমান, আরিফ হাসান সুমন, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, নূর ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন এর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ও ১২০ বি ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে দÐবিধির ৩০২/১২০বি ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হলেও সিলেটের এক মামলায় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদÐ কার্যকর হয়েছে। তাই ২০১৭ সালের ১৩ জুন তাকে এ মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিচারক বলেন, পলাতক আসামি মশিউর রহমান ও রফিকুল আলম মিরাজের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০বি/৩৪ ধারার অভিযোগ আনা হলেও তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। আসামি মুফতি মঈন উদ্দিন ১৬৪ ধারায় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানেও মশিউর বা রফিকুলের নাম আসেনি। প্রসিকিউশনের পক্ষ উপস্থাপিত কোনো সাক্ষীও এই আসামিদের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। তদন্ত কর্মকর্তারাও তাদের সম্পৃক্ত করে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে পারেননি। যেহেতু আসামিদ্বয়ের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, সেহেতু তাদের খালাস দেওয়া হলো’।
বাকি দশ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিচারক বলেন, ‘হাই কোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা সাপেক্ষে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের প্রত্যেককে গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হোক। সেই মর্মে আসামিদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হোক’।