হ-য-ব-র-ল অমর একুশে বইমেলা

15

মিয়া জামশেদ উদ্দীন

তা হলে বলতে আপত্তি কোথায়? এমনিতে ডানে-বামে কেউ নেই। কেউ প্রস্তাব দেয়ারও কথা নয়! কেন-বা প্রস্তাব দিবে; দৃষ্টান্তমুলক সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল বলতে কিছুতো নেই… তাছাড়া যাদের মামুর ঠেলা আছে অথবা খুঁটির জোর আছে, তারা সর্বদাই প্রত্যাশী। এটি মনগড়া বা অলৌকিক কাহিনী নয়; এধরনের দৃষ্টান্ত অহরহ আছে। যাদের ওইরকম প্রতিপত্তি বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট-প্রভাবশালী আছে, হয়তো তাদের কপালে তিলক! যাদের কেউ নেই, তারা কখনো এমন আশা করা বা কল্পনা করাটাও উচিত নয়! বাংলার শাশ্বত প্রেমের কবি জীবনানন্দ দাশ ও সাম্যের কবি কাজি নজরুল ইসলাম কি কখনো তা পেয়েছেন, আমৃত্যুও না! জাতির হৃদগৌরব উদ্ধার করা হয়েছে কী না। একেবারেই অনন্তকাল ধরে রুদ্র বলা যায়। এটি আজকের-একবিংশ শতাব্দীতেও না, এমনকি এটি সহজসাধ্য বিষয় ছিল না, এটিই নিরেট সত্য। তবে সব সত্য কখনো-কখনো নিরন্তর অপ্রিয়।
প্রতি বছর ঢাকাসহ দেশব্যাপী অমর একুশে জাতীয় গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কি পরিমাণ সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা অংশ নেয় বা কি পরিমাণ সৃজনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে আসছে, আপাতত তা বলা মুশকিল। তবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে একটি বুক নাম্বার (আইএসবিএন) দেয়া হয়। এটিও সঠিকভাবে নিরূপণ হয় না। এটি সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হলে তাদের সে পরিমাণ জনবল আছে কিনা, থাকলে কোন সংস্থা এ পর্যন্ত সঠিক অনুসন্ধান চালিয়েছে কি-না, তারও শ্বেতপত্র নেই! তবে বরাবরই আজগুবি একটি গোষ্ঠীয়-লেখক ও প্রকাশকের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। কারা তারা বা তাদের পৃষ্ঠপোষক ও ইন্ধনদাতারা কে, তাদেরও শ্বেতপত্র প্রকাশিত হওয়া উচিত। অথচ যাদের তেমন একটা দৃষ্টান্তমুলক অবদান আছে বলে মনে হয় না. তারাই পদপদবিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এটি শুধু আভ্যন্তরীন নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপের দেশেও দেখা যায়। খুবই নগণ্য বা ছোটখাটো একটি বিষয়ে ডাকসাইটের যতসব পদকে ভূষিত হয়ে আসছে বা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এতে হাজারো বিতর্কের জন্ম দেয়- তা হলে সৃজনশীলতার অস্তিত্ব বা কোথায় আছে ?
সৈয়দ মুজতবা আলীর বই কেনা প্রবন্ধে লেখেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা’ বাঙালি জাতির অহংকার জাতীয় গ্রন্থমেলা। ১৯৭২ সাল থেকে এ গ্রন্থমেলার গোড়াপত্তন হয়। শুরুটা হয় একেবারে সাদামাটায়। পুঁথিঘর ও মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা বাবু চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির চত্বরে এ বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। আয়োজন ছিল মাটিতে সাটানো। আজ মেলার কলবর বা ব্যাপ্তি বেড়েছে শতগুণ। সূত্রে জানাগেছে, মেলায় প্রায় ৪ হাজার স্টল বসানো হয়। কিন্তু বইমেলার সেই জুলুস, গুণগতমান বা স্বতন্ত্র ধারা এখনো গড়ে উঠেনি। পুরোটাই বাণিজ্যিক বলা যায়। সৃজনশীলতার লেজমাত্রই নেই। আজকের এ মেলাকে ঘিরে কি-না হয়; নির্দিষ্ট ফি আদায়, অর্থাৎ হাজার টাকা দিয়ে মেলার স্টলের জায়গা বরাদ্দ দেয়া। তার সাথে প্যাভিলিয়নের সাজসজ্জা-ডেকোরেশন ও আলোকসজ্জা। এ ডেকোরেশন করতে গিয়ে ৪০-৫০ হাজার টাকা থেকে লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয় প্রকাশকদের। এসব কারণে প্রতি স্টলের ব্যয়ও অসহনীয় হয়ে ওঠে। যা কি-না বিশাল অংকে গিয়ে দাঁড়ায়। কিভাবে একজন প্রকাশক বইমেলার এ প্রস্তুতি নেয়, তাও ধর্তব্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বই বিক্রয় হোক বা নাই-বা হোক, সাজসজ্জায়-দৃষ্টিনন্দন স্টল থাকতেই হবে! বেশীরভাগ প্রকাশনা সংস্থা মাসব্যাপী মেলায় বেচা-বিক্রি বলতে কিছুই হয় না, মূলত যাঁরা গ্রন্থের লেখক, তারাই ক্রেতা, তারাই পাঠক! তা হলে তো প্রকাশকদের বিশাল অংকের-এ ভর্তুকি কে টানবে। নির্দ্বিধায় বলতে হয় ‘লেখক’কে। লেখক হচ্ছে ‘কলুর বলদ’! এক কথায় বলতে হয় লেখকের টাকা দিয়ে বইমেলার এ জুলুস বা বর্ণাঢ্য আয়োজন। তারপরও বইমেলা হয়, অংশ গ্রহণে কলবর বাড়ে এবং জমকালো প্রস্তুতিও। অবশ্য সেটি অন্য কথা… না হলে কি করেই প্রকাশকরা এত বিশাল অংকের ব্যয় নির্বাহ করছে; তবে তাদের মধ্যে গুটিকয়েক যে ব্যতিক্রম নেই তা বলবো না। যদিওবা আপনারা সবই সম্যক আছেন ; তাহলে প্রকাশকদের দায়বার কে নেবে? প্রতিবছর এ বইমেলা থেকে বাংলা একাডেমির উপার্জিত মুনফা তো সমহারে প্রকাশদের মধ্যে বন্টন হয় না। কিন্তু ঠিকই বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত বেতনের সমপরিমাণ তিনটি বোনাস পেয়ে আসছে শুধু বইমেলা আয়োজনে। অবশ্য এটি কতটুকু সত্য তাতে মতান্তর আছে। এটি যদি সত্যি হয় তা হলে অনেকটা উপরি পাওনার মতো, একধরনের বাদ্যবাদকতার সাথে টাকা হাতিয়ে নেয়া; কেন তাঁরা এ টাকায় ভাগ বসাবেন। অমর গ্রন্থমেলা তো তাদের চাকরিরই একটি অংশ। মেলার আয়োজনে এমন বাধসাধলে বাংলা একাডেমির থাকে বা কি। অথচ একটি বছর ধরে এ আয়োজনে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে বাংলা একাডেমি। অন্যথায় বাংলা একাডেমির শয়ে শয়ে কর্মচারী কিসের বা প্রয়োজন? তাছাড়া আয়োজনে অন্যান্য সংস্থারও অংশগ্রহণ থাকে। তাদের কেন বা ভাগবাটোরায় অংশ নিতে হবে; তারাও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এটিও তাদের দায়িত্বে পড়ে। তারাও এমন দিধাদ্ব›েদ্ব ভুগতে পারে না, আয়োজনের সাথে একাত্মতা না থাকার; সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সুশৃঙ্খলভাবে মেলা সম্পন্ন করতে যা যা করণিয় আছে, সবই করতে হবে।
বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসক, মেডিকেল টিম, বিদ্যুৎবিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। তারাও শ’ শ’ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। শুধু আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমিকে উদ্যোগ নিতে হয় এবং তাঁরা এককভাবে সমন্বয় করে। এটিতো বাংলা একাডেমির কাজ। এসবে অপারগতা হলে মুখথুবড়ে পড়বে বাংলা একাডেমির সকল কার্যাদিও। অথচ মেলার নামে এখনো চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। লেখকদের জন্য ডরটরিয়ম ও কেন্টিন চালু করা হয়নি। অন্তত বাংলা একাডেমির তালিকাভুক্ত বা পদকে ভূষিত লেখকরা হলেও এ সুযোগসুবিধা পেতে পারেন। তাছাড়া অজপাড়া গাঁ থেকে যেসকল লেখক মেলাকে ঘিরে ঢাকায় যায়, তাঁদের থাকা ও খাওয়ার নিশ্চয়তা করা কি নৈতিকতায় পড়ে না। প্রয়োজনে ন্যূনতম ফি নিতে পারে। বাংলা একাডেমি এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে হবে। লেখকদেরও নিরাপত্তা দিতে হবে। এসবে দায়বার এড়ানোর সুযোগ নেই বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের বা চেয়ারম্যানের। না হয় কিসের এতসব দায়দায়িত্ব, জাতির বা কিসের ঠেকা আছে মোটা অংকের মানে দিয়ে হাতি পোষণের। যদিওবা বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এ বইমেলা হয়ে আসছে। বলতে হয় অনেকটা দায়সারা আয়োজন ও অনুষ্ঠান। পদক নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই, নানা ধূ¤্রজালে বাঁধা।
কথা আছে, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সর্বপ্রথম তার কৃষ্টি ও সাংস্কৃতির উপর ঘা বসালেই যথেষ্ট হয়। তা কি হচ্ছে না পদে পদে? চট্টগ্রামে অমর একুশে বইমেলাকে নিয়েও চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সঙ্গে চলছে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা নিয়েও টানাপোড়েন। অথচ বাঙালির প্রাণের অমর একুশে বইমেলা। এসব জাতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। যেভাবে শোনা যাচ্ছে, এবার চট্টগ্রামের জিমনেসিয়ামে বইমেলা হচ্ছে না। ২০১৯ সাল থেকে এ চত্বরে বই মেলা হয়ে আসছে। মেলাও ক্ষাণিকটা জমে ওঠে। কিছু হলেও পাঠক সমাগম দেখাযায়। আশার সঞ্চারিত হয় প্রকাশকদের। এবার নাকি জিমনেসিয়াম বরাদ্দ পাচ্ছে না; কেন পাচ্ছে না- মেলার আয়োজনে নাকি খেলাধুলার বিঘ্নিত হয়; জেলার সিজেকেএস-এর নিয়ন্ত্রণে এ মাঠ। পদাধিকার বলে ডিসি সাহেব এর প্রধান। আর বইমেলা আয়োজনে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। এবার মেলা হবে নাকি সিআরবির সিরিষ তলায়। চট্টগ্রামে বইমেলা নিয়ে এ সমস্যার অন্ত নেই। এখনো থিতু হতে পারেনি মেলার আয়োজনে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও মুসলিম হলের সন্মুখে মেলা হয়ে আসছিল দীর্ঘ বছর ধরে। সেখানে ছিল মরা গাঙের মত অবস্থা। স্থানান্তর হয় ডিসি হিলে। সেখানেও একই দশা। শেষতক একটু নড়ে ওঠে জিমনেসিয়াম চত্বরে। তাতেও বাধা আয়োজনে। অনেকে দাবি করেছেন স্থাপনা উচ্ছেদ হওয়া ওই শিশু পার্কে হোক। সেটিও নাকি একটি সংস্থা দখল করে রেখেছে।
২০০৭ সালে সীতাকুন্ডে প্রথমবারের মতো একবার অমর একুশে বইমেলা আয়োজন করা হয়। ১৫টি স্টল দেয়া হয়। স্টলও ফ্রি দেয়া হয়। এমন কি বইও এনে দেয়া হয় চট্টগ্রাম থেকে মিনি ট্রাকে করে। বরাদ্দকৃতরা বই বিক্রয়ের ৪০ শতাংশ কমিশনও তারা কেটে নেবে। সঙ্গে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পরটা-সন্দেস দিয়ে নাস্তা খাওয়ানো। তিনদিন ব্যাপী চলে সীতাকুন্ডস্থ জেলাপরিষদ অডিটোরিয়াম চত্বরে এ মেলা। প্রতিদিন আলোচনা ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান হয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কবি ও কলামিস্ট