হোমিওপ্যাথির হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩)

503

১০ এপ্রিল এইটা কোন এক সংখ্যা চিহ্নিত নিছকই কেবল তারিখ মাত্র নয়, গভীরে বহন করে সমগ্র পৃথিবীর রোগ ব্যাধিতে জর্জরিত মানুষের জন্য মহৎ এক প্রতীকী সত্য। কারণ এই তারিখেই ১৭৫৫ সালে জন্মে ছিলেন প্রগতিশীল, সত্যানুসন্ধানি এবং আদর্শ ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দারিদ্র্য ও প্রতিক‚ল পরিবেশে কঠোর আত্মবিশ্বাস যুক্ত, পরিশ্রমি, পর্যবেক্ষক ও অধ্যাবসায়ময় অবিচল সংগ্রামী ও সফলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রুগ্ন মানুষের সত্যকারের বন্ধু মহামানব হোমিওপ্যাথির জনক ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেড্রিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। মহাত্মা হ্যানিম্যান জার্মানির একজন সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী খ্যাতনামা চিকিৎসক হয়েও ১০ বছর যাবত তিনি চিকিৎসক হিসেবে লক্ষ্য করলেন যে, প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে আদর্শ আরোগ্য সাধিত হয় না। আরোগ্যের নামে রোগ চাপা দেওয়া হয়, স্থানান্তরিত করা হয়, ঔষধের বিষক্রিয়া, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং চিকিৎসা হওয়ার পরও রোগের পুনরাক্রমণ ও নূতন রোগ সৃষ্টি হয়, তখন তিনি চিকিৎসা পদ্ধতিকে আমূল সংস্কার সাধনে ব্রতী হন। সুদীর্ঘকাল গবেষণা দ্বারা “সদৃশ বিধান” বা “ঝরসরষরধ ঝরসরষরনঁং ঈঁৎবহঃঁৎ” প্রবর্তন করেন।
হোমিওপ্যাথি হলো আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার এক আদর্শ চিকিৎসাকলাবিদ্যা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চিরন্তন বিধানসমূহের উপর ইহার প্রতিটি নীতি সুপ্রতিষ্ঠিত। এই চিকিৎসা বিদ্যার নিজস্ব দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আছে। “সদৃশ বিধান” বা “Similia Similibus Curentur” এই শ্বাশত সত্যের স্বপ্নদ্রষ্টা মহামানব ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের বহু আগে হিপোক্রেটিস, প্যারাসেলসাস, গ্যালেন প্রভৃতি মনীষিগণ সদৃশ বিধানের কথা স্বীকার করে গেছেন। সদৃশ তত্ত্বের সন্ধান দেন আলব্রেচ ভন হ্যালার, তাই ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান কখনো নিজেকে সদৃশ বিধানের আবিষ্কারক বলে দাবি করেননি। কিন্তু কেউ সদৃশ বিধান নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেননি। একমাত্র এই তত্তে¡র উপর পরিপূর্ণ গবেষণা করে হোমিওপ্যাথিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী চিকিৎসা বিজ্ঞানী, সার্জন, বহুভাষাবিদ, রসায়নবিদ, উদ্ভিদবিদ্যায় পারদর্শী, আইনবিদ, মনস্তাত্ত্বিক, অনুবাদক ও গবেষক ডা. ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেড্রিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান।
১৭৭৫ সালে বিশ বৎসর বয়সে স্যামুয়েল হ্যানিম্যান লিপজিকে চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে যান। ১৭৭৯ সালের ১০ই আগস্ট ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান আপেক্ষিক রোগের কারণ ও এর চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণা পত্রপেশ করে চিকিৎসা বিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রী ডক্টরেট এম. ডি. লাভ করেন। ১৭৮০ সালে জার্মানির ম্যানস্ ফিল্ড রাজ্যের হেট স্টেড শহরে সর্বপ্রথম চিকিৎসা আরম্ভ করেন। ১৭৮১ সালের শেষ দিকে তিনি ম্যাগডিবার্গের নিকটবর্তী গোমেরনে জেলা মেডিকেল অফিসার নিযুক্ত হন। অসংখ্য রোগী চিকিৎসায় তিনি লক্ষ্য করেন প্রচলিত চিকিৎসায় রোগ ভাল হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কিছুদিন পর ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গে নতুন নামের রোগে রোগী আক্রান্ত হয়। তিনি তখন বুঝতে পারেন প্রচলিত চিকিৎসায় রোগী রোগের আরোগ্য না হয়ে শুধু রূপান্তর হচ্ছে। প্রচলিত চিকিৎসার কুফল ও অসারতা উপলব্ধি করে, গোমেরনের ধর্মমন্দির ত্যাগ করে ড্রেসডেন শহরের হাসপাতালে বৈজ্ঞানিক পুস্তকসমূহের অনুবাদক ও রাসায়নিক পরীক্ষক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।
১৭৯০ সালে এডিনবার্গের বিখ্যাত অধ্যাপক, শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ, প্রতিভাবান চিকিৎসা বিজ্ঞান ডা. উইলিয়াম কালেনের “A treatise of the Materia Medica” এর জার্মান ভাষায় অনুবাদকালে “Cortex Perubians or Perubian Bark” অধ্যায়ে “Tonic effects on stomack” মন্তব্যের উপর গবেষণা চালাতে গিয়েই হোমিওপ্যাথির মূলসূত্র আবিষ্কার করেন। হ্যানিম্যান গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন যে, ডা. কালেন সাহেব তার মেটেরিয়া মেডিকায় ঐ অংশে উল্লেখ করলেন “কম্পজ্বরের ঔষধ সিংকোনা পাকস্থলীর উপর বলকারক ক্রিয়া প্রকাশ করে জ্বর ভাল করে থাকে। কিন্তু বলকারক ক্রিয়া কি এবং কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কালেন সাহেব তার ঐ বইতে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করেননি, এতে হ্যানিম্যানের মনে খট্কা লাগে, তাই তিনি অনুসন্ধিৎসু মনে সিংকোনা ছালের রসসেবন করে দেখলেন, তার দেহে কম্পজ্বর সৃষ্টি হয়, বার বার পরীক্ষা করে একই ফল পেলেন এবং আরো লক্ষ্য করলেন প্রতিবারই জ্বর ২/৩ ঘন্টা স্থায়ী হয় এবং জ্বর চলে যাওয়ার পর তিনি আগের মত সুস্থবোধ করেন। সমবিধান বা সমসূত্রের শুভযাত্রার, শুভ সূচনায় এখানেই সূত্রপাত আবিস্কৃত হল “সমবিধান” বা “সমঃ সমং সময়তি” বাSimilia Similibus Curentu” যে পদার্থ সুস্থ শরীর যন্ত্রকে বিকৃত করে যে সব যন্ত্রণাদায়ক কৃত্রিম ল²ণ সৃষ্টি করে, সে পদার্থের সূ²মাত্রা বা শক্তিতে ঔষধ উক্ত লক্ষণাদি বিদূরিত করে শরীরযন্ত্রকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারে, বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলে এটা নির্ভুল প্রমাণিত এবং তাই এই সূত্র শাশ্বত সত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত, অপরাপর সব চিকিৎসা পদ্ধতির ন্যায় জল্পনা, কল্পনা ও অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এই পদ্ধতি। একটানা ৬ বছর এই পদ্ধতিতে তিনি নানা ঔষধ ও বহুবিধ তরল (চড়রংড়হ) সেবন করে নিজ দেহের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেন। এই কাজে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন তার অনেক হিতৈষী বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের আপন অনেকেই। অতঃপর প্রচলিত তাবৎ চিকিৎসা পদ্ধতির নীতিমালার বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, “মানুষের ঔষধ একমাত্র মানবদেহেই পরীক্ষিত হবে এবং তা ইঁদুর, বিড়াল, গিনিপিগ, ঘোড়া, বানর বা এ জাতীয় কোন মানবেতর প্রাণীর উপর নহে।” পৃথিবীর তাবৎ চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠে হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন, “রোগ ক্লিষ্ট মানব সমাজের অমূল্য সম্পদ স্বাস্থ্য নিয়ে যারা এতদিন ছিনিমিনি খেলেছেন, দুর্বোধ্য ভাষা অসাড় বাগড়াম্বরের দ্বারা মানবসমাজকে তাক্ লাগিয়েছেন, তত্ত¡মূলক চিকিৎসা পদ্ধতি বলে যারা এর নামকরণ করেছেন, চিকিৎসক বলে যারা পরিচয় দেন, রোগে জর্জরিত মানবজাতিকে কেবল কথার দ্বারা প্রতারণা করা থেকে এবার থামুন। রোগমুক্তির সত্যিকার আশ্বাস নিয়ে এবার অন্ততঃ এগিয়ে আসুন।” তিনি তার এই বৈপ্লবিক চিকিৎসা পদ্ধতির নাম রাখলেন “হোমিওপ্যাথি”।
১৮১০ সালে ডা. হ্যানিম্যান প্রকাশ করেন তার অমরগ্রন্থ “অর্গানন অব মেডিসিন” যা হোমিওপ্যাথির সংবিধান হিসাবে হোমিওপ্যাথদের কাছে পরিচিত ও পরিগণিত। এই গ্রন্থের মাধ্যমে হ্যানিম্যান “হোমিওপ্যাথি” নামটি প্রকাশ করেন। এতে রয়েছে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসা সম্পর্কিত ২৯১ টি সূত্র। এটি এমন একটি গ্রন্থবিশেষ যার মাধ্যমে দার্শনিক তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারের ‘অর্গানন’ চিকিৎসা জগতে একক, অনন্য ও এক মহাবিপ্লব, চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যবহারিক অধ্যায় ও আরোগ্যকলার যাবতীয় তত্ত¡, নিয়মনীতি এবং গবেষণার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির বিষয়াদি যুক্তিশাস্ত্রের আলোকে এবং যুক্তিযুক্তভাবে দার্শনিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে এই গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। ১৮১১ সালে হ্যানিম্যানের বিখ্যাত গ্রন্থ “মেটেরিয়া মেডিকা পিউয়া” ১ম খন্ড প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি সুস্থ মানবশরীরে পরীক্ষিত প্রত্যেকটি ঔষধের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন, বইটা ছয় খন্ডে সমাপ্ত হয়। ২য় খন্ড (১৮১৬), ৩য় খন্ড (১৮১৭), ৪র্থ খন্ড (১৮১৮), ৫ম খন্ড (১৮১৯) ও ৬ষ্ঠ খন্ড (১৮২১) প্রকাশিত হয়। ১৮১২ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর হতে ১৮২১ সাল পয্যন্ত হ্যানিম্যান লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর ৬ মাস ধরে হোমিওপ্যাথি বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। প্রত্যেক শনি ও বুধবার বিকাল ২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত এ ক্লাস চলত। ১৮১৭ সালে তিনি “রেপাটারিয়াম” নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থ ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়। মোট পৃষ্ঠার সংখ্যা ৪২৩৯, এর প্রত্যেক পাতায় রয়েছে ৫২টা লাইন। বইটা ল্যাটিন ভাষায় লেখা। এই গ্রন্থে তিনি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঔষধের বাছাই ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ১৮১৯ সালে “অর্গানন” এর ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সালে সর্বসাধারণ্যে প্রচারের জন্য “মেডিকেল ইনস্টিটিউট” নামে একট প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ১৮২১ সালে আনহ্যান্টাকিথেনের নগরীর সিউক কর্তৃক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করে সনদ পান। ১৮২৪ সালে “অর্গানন” এর ৩য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮২৮ সালে হ্যানিম্যান “ক্রনিক ডিজিজেস” নামক গ্রন্থটি ৪ খন্ডে প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে ক্রনিক মায়াজমসমূহের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ১৮২৯ সালে “অর্গানন”- এর ৪র্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সালের ১৩ই আগস্ট তার এম. ডি. উপাধি পাওয়ার পঞ্চাশতম বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে এক ভোজের আয়োজন করেন। এসময়ে জার্মান “সেন্ট্রাল হোমিওপ্যাথিক ইউনিয়ন” স্থাপিত হয়। ১৮৩৩ সালের জানুয়ারী মাসে লিপজিকে একটি হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল স্থাপন করেন। ১৮৩৩ সালে “অর্গানন”- এর ৫ম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হ্যানিম্যান প্যারিসে অবস্থানকে ‘অর্গানন’ এর ৬ষ্ঠ সংস্করণের পান্ডুলিপি লেখার কাজ শেষ করেন, ১৯২১ সালে হ্যানিম্যানের মৃত্যুর অনেক পরে ডা. রিচার্ড হেল জার্মানি হতে “অর্গানন” এর ৬ষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। হেলের সম্পাদিত হ্যানিম্যানের এ মূল পান্ডুলিপিটা মুদ্রিত আকারে প্রথমে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালের ৩ রা মার্চ। প্রকাশ করেন লিপজিকের প্রকাশক ডা. উইলমার স্কচ। একই সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার সানফ্রান্সিস্কোর ডা. উইলিয়াম বোরিক মূল পান্ডুলিপিটার ইংরেজি অনুবাদ করেন।
বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সত্ত্বেও তিনি হোমিওপ্যাথিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। পৃথিবীতে যতদিন রোগযন্ত্রণা থাকবে, ততদিন চিকিৎসাশাস্ত্রও থাকবে এবং মহাত্মা হ্যানিম্যানের নাম আর্তপীড়িত মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত কর্মময় জীবনের অবসানে ইহলোক থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে গভীর আত্মতৃপ্তির সাথে হ্যানিম্যান তাই বলেন, “ইহজগতে আমি বৃথা জীবনধারণ করি নাই।”১৮৪৩ সালের ২রা জুলাই রোববার ভোর ৫টায় প্যারিসে নিজের ঘরে “রুই দ্য মিলান নং-১” স্থানে এই মহামানব শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্রান্সের প্রফেসর জ্যাকুই বেনভেনেস্তের তার নেতৃত্বে তিনটি উন্নত দেশে ১৪ জন বিজ্ঞানীর একটি প্রতিনিধিদল দীর্ঘ ৩ বছর গবেষণা চালিয়ে রিপোর্ট দেন- “হোমিওপ্যাথি ঔষধের কার্যকারিতা নিঃসন্দেহ এবং এর শক্তিকরণ পদ্ধতি বিজ্ঞানভিত্তিক।”
লেখক : প্রাবন্ধিক