হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য. হেথায় দ্রাবিড় চীন- শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে লীন

252

লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস সম্মেলনে ১৮৯৩ ইংরেজিতে দাদা ভাই নওরোজী কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘Whether I am a Hindu, a Mohammadan, a Persi, a Christian or of any other creed, I am above all an Indian. Our country is India, our nationality is Indian.’ অর্থাৎ ‘আমি হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, ফার্সি অথবা অন্য যে কোন ধর্মমতের হইনা কেন, সবার উপরে আমি ভারতীয় এবং আমাদের দেশ ভারত।’ এই নীতির উপর ভিত্তি করে ভারতের স্বাধীনতার স্থপতিরা অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর স্বাধীনতার সাথে সাথেই একটি শাসনতন্ত্র রচনা করেন। সে অনুসারে বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং আইন পরিষদ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, এখনও নির্বাচনের পর ভোট কারচুপি নিয়ে উল্লেখযোগ্য সমালোচনা এই পর্যন্ত শোনা যায় নাই।’ কিন্তু বর্তমান বি.জে.পি. সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনৈতিক ইস্যু বা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইস্যুগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু ধর্মীয় ইস্যুর উপর ভিত্তি করে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এই প্রচেষ্টায় তাদের সফলতা আসবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলে দিবে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা ভারতীয় জাতীয় ঐক্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, নাগরিকদের মধ্যে আস্থাহীনতা যে ব্যাপক আকারে সৃষ্টি হবে তাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই, তখন ভারতের স্বাধীনতার মহান স্থপতিরে দীর্ঘদিনের ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ এর লালিত স্বপ্ন ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। এই ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ আদর্শ হিসাবে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীরা যখন আস্থা হারাবে তখন ভারতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা স্ব-স্ব ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করলে তা অনৈতিক দাবি বলে কোন যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করা যাবে?
স¤প্রতি ১৬ শতাব্দীতে মুগল সম্রাট বাবরের নির্মিত অযোধ্যার বাবরী মসজিদের ধ্বংসাবশেষের স্থানে বিরাট হিন্দু বিক্ষুব্ধ জনতা সমবেত হয়েছিল। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো বর্তমান ভারতীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে ঐ স্থানে মন্দির নির্মাণ করা। অবশ্য এটা যে সরকারের ইন্ধনেই আয়োজিত হয়েছিল তাতে দেশি এবং বিদেশি উপস্থিত সাংবাদিকের কোন সন্দেহ হয় নাই। তারা সবাই ইহা বি.জে.পি. সরকারের পাতানো খেলা বলে দেশি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে তা প্রচারও করেছেন। ১৫৫৮ সালে মোগল রাজত্ব্যের স্রষ্টা স্বয়ং সম্রাট বাবরের আদেশেই এই মসজিদ উক্ত স্থানে নির্মিত হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিপুল সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের সহায়তায় এই মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল। তাদের দাবি ছিল ভগবান রাম স্বয়ং এই জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য বিনা বাধায় তখন এই মসজিদ হিন্দুদের পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব হয় নাই। মসজিদ ধ্বংসের সময় সেখানে বিরাট দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল, সেখানে হিন্দু-মুসলমান মিলে ২০০০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তখনকার মিডিয়ার খবর অনুযায়ী প্রায় ৩৫০০ মুসলমান অযোধ্যা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনকার জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল ঘটনাগুলি শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হয়েছে।
আগামী বৎসরের মে মাসের মধ্যে ভারতীয় শাসনতন্ত্র অনুযায়ী অবশ্যই ভারতে সারা দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি বাবরী মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের আন্দোলন চাঙ্গা করতে যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। সম্প্রতি ভারতের প্রখ্যাত সংবাদপত্র টাইম অব ইন্ডিয়া রিপোর্ট করেছে ভারতের হিমাচল প্রদেশের বিধান সভায় গরুকে রাষ্ট্রমাতা হিসাবে ঘোষণা দিয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি বিল পাশ করেছে। এই বিল শুধু বিজেপি সমর্থন করেছে তা নয়, সর্বদলীয়ভাবে এই বিল পাশ হয়েছে। বর্তমানে এসব উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক, সংকীর্ণতাবাদী এবং সংরক্ষণবাদী, তথাকথিত রাজনীতিবিদরা ভারতের মান-মর্যাদা বিশ্বের দরবারে কোথায় নিয়ে যাবে একমাত্র বিধাতাই বলতে পারেন। অবশ্য ভারতের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ১৩৩ বৎসরের পুরানো রাজনৈতিক দল কংগ্রেস পার্টিকে গত ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মোদীর নেতৃত্বে বি.জে.পি. যে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এমন কি বাইরেরও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসার ক্ষীণতম সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে সে সময় কংগ্রেস সরকারের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে নেহেরু গান্ধী পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের রাহুল গান্ধী নেতৃত্বের উপর কেহ আস্থা রাখতে পারছিলেন না। রাহুল গান্ধীকে নরেন্দ্র মোদী সহ বি.জে.পি র বিশিষ্ট নেতারা এমনভাবে তুচ্ছ করে বক্তৃতা করা শুরু করেছিলেন যা রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজ্য সভার নির্বাচনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে যেভাবে কংগ্রেস বিজেপি থেকে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে তা আগামী বৎসরের অনুষ্টিতব্য ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনের হিসাব সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যাওয়াটা প্রায় সুনিশ্চিত। যে পাঁচটি রাজ্যে বিধান সভায় নির্বাচন হয়েছে তাতে মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থান বিজিপি র শক্ত ঘাঁটি হিসাবেই পরিচিত। বিজেপি প্রায় ২০০৩ সাল থেকে সেসব রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। তবুও এবার সেসব রাজ্যে এমন গো হারা হেরেছে যা অনেকেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এমনকি হিন্দুত্ববাদের প্রতীক হিসাবে নরেন্দ্র মোদী যাঁকে ভারতের প্রথম ‘গরু মন্ত্রী’ হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন যাঁর নাম ওতারাম দেওয়ানী, তিনিও এ নির্বাচনে গো হারা হেরেছেন। এই তিনটি রাজ্যে কংগ্রেস জেতার ফলে রাহুল গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করা হতো, তা একেবারেই মিথ্যা বলে পরিষ্কার হয়ে গেল। বিশেষ করে রাহুল গান্ধী কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরপরই কংগ্রেসের এ বিজয় ঘটেছে।
ভারতের বৈচিত্র্যময় ইতিহাসকে উপেক্ষা করে কেহ যদি ভারত শাসন করতে চায়, তাহলে তারা শুধু যে ব্যর্থ হবে তা নয়, ভারতের কৃতি সন্তানেরা যুগের পর যুগ অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংগ্রাম করে এবং নিজের জীবন বলি দিয়ে যে ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন, যার নাম ‘Unity in Diversity’ বা ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ যে প্রক্রিয়াটা এখনও চলছে, কারণ সে মহান কাজটি এখনও সম্পন্ন করা সম্ভব হয় নাই। বরং বিজেপি ক্ষমতায় এসে মিশনটি কিছুটা পিছিয়েই পড়েছে। একবার যদি ভারতীয় ঐক্য গড়ার এই মিশন থেমে যায়, তাহলে ভারত যে কতভাগে বিভক্ত হবে তা কারও কল্পনায় আসাও কষ্টকর হবে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের শ্রেষ্ঠতম সন্তান মহাত্মা গান্ধীর অন্তরতম জওহরলাল নেহেরু লোকসভায় এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘The main thing we have to keep in mind is the emotional integration of India. We must guard against being swept in away by momentary passion, whether it is religion misapplied to politics or communalism or provincialism or castesim. We have to build up this great country into a mighty nation…. mighty in action, mighty in culture and mighty in its peaceful service of humanity.’ অর্থাৎ ‘মূল যে কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে তা হলো, যে ভাবাবেগের উপর ভারতের ঐক্য. ক্ষণিকের ক্রোধে তা যেন ভেস্তে না যায়, ধর্মকে রাজনীতিতে অপপ্রয়োগ করে হউক, সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি, প্রাদেশিকতা বা জাতিভেদ সৃষ্টি করে হউক। এদেশকে আমরা শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করব। এটি কর্মে, সভ্যতায় এবং মানবতাকে শান্তিপূর্ণ সেবা প্রদানে সবচাইতে অগ্রগামী থাকবে।’
লেখক : কলামিস্ট