হিজড়াদের স্বীকৃতি, কর্মসংস্থান, পুনর্বাসন

256

২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি, বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা সরকারি ইশতেহারে তৃতীয় লিঙ্গকে এই বলে স্বীকৃতি প্রদান ও তালিকাভুক্ত করে যে: ‘বাংলাদেশ সরকার হিজড়া সম্প্রদায়কে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।’ এই ঘোষণা বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়ের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি সম্প্রদায়, যাদের জন্মের সময় পুরুষ এবং জীবনের পরবর্তী সময়ে মহিলা পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়, তারা নিজেদের হিজড়া অথবা একটি তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
হিজড়ারা মূলধারার সমাজে অংশগ্রহণের সুযোগের অভাবে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি ও বেঁচে থাকার পদ্ধতি তৈরি করেছে: তারা নিপীড়িত ও সমাজ থেকে বঞ্চিত এবং বিশ্বাস করে যে, সমাজ আমাকে মানুষ হিসেবে ভাবে না। তাই আমি কেন সামাজিক রীতিনীতি অথবা সমাজ আমার সম্পর্কে কীভাবে তার পরোয়া করব?
বেশিরভাগ হিজড়ারা তাদের পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং একটি কিশোর বয়সে তারা আলাদা হয়ে যায়। সমাজে বিরূপ ধারণার কারণে, তাদের কর্মসংস্থান ভিক্ষাবৃত্তি অথবা যৌন কর্মের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ। কিছু হিজড়া গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অথবা রেস্টুরেন্টে কাজ করে, কিন্তু তারা বেশির ভাগ সময় চাকরি ধরে রাখতে পারে না ব্যাঙ্গ-বিদ্রæপ, যৌন নির্যাতন অথবা তাদের ‘মেয়েলি আচরণের’ জন্য হয়রানির কারণে। এ ধরনের বৈষম্য নিম্ন বর্ণের দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়। তাছাড়াও তা দেখা যায় বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেতনের, কাজের লোক এবং নির্দিষ্ট পেশার কিছু লোকের মধ্যে যেমন- জেলে, মুচি এবং মেথর।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে হিজড়াদের উপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, “হিজড়া জীবনের সবচেয়ে বঞ্চনাকর বিষয় হছে তাদের পুরুষ-মহিলার ঊর্ধ্বে একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দান করা যা তাদের বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে সম্ভাবনাময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনে বাধা দেয়। তাই যখন ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভা হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করে, এ সম্প্রদায় নতুন করে আশার আলো খুঁজে পায় এবং এক বছর পর, যখন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে তাদের কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। এতে ১২ জন হিজড়ার সরকারি চাকরির ব্যবস্থা হয়, যা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের একটি অন্যতম পথ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।
এমনকি ২০১৪ সালে মন্ত্রিসভার নির্দেশের আগে, সরকার এবং বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন সময়ে হিজড়াদের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১২ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি ছোট কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল যেখানে হিজড়া ছাত্রদের উপবৃত্তি এবং কর্মস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ধীরে ধীরে এ কর্মসূচির প্রসার এবং বাজেট বাড়ে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে, এ পরীক্ষামূলক কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি জেলায় শিক্ষামূলক বৃত্তি, কারিগরি প্রশিক্ষণ, এবং বয়স্কভাতা প্রদান করা হয়।
সরকারি প্রকল্পের অধীনে হিজড়াদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যোগ্যতা অনুসারে নানা বিষয়ে। কিন্তু সরকারিভাবে তাদের কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ নেই। প্রশিক্ষণের সময়ে দেওয়া হয় প্রতিদিন এক হাজার টাকা। উপবৃত্তি দেওয়া হয় শিক্ষার্থী হিজড়াদের মাসে ৩০০ টাকা। বয়স্কভাতা দেওয়া হয় মাসে ৭০০ টাকা। মাসে ৭০০ টাকা দিয়ে কিভাবে চলা যায়?’ সরকার যা দেয়, দিনে তারা তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করতে পারেন। তাহলে সরকারের কাছে গিয়ে তারা সময় নষ্ট করবেন কেন?
বর্তমানে হিজড়ারা তাদের পৈতৃক সম্পদের উত্তরাধিকার নয়। তারা যাতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে সে জন্য সরকার একটি আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আইনটির খসড়া তৈরি হচ্ছে বলে জানা যায়। অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মেডিক্যাল চেক আপের মাধ্যমে হিজড়া পরিসংখ্যানের কাজও দ্রুত শুরু হচ্ছে। জরিপের পর দেওয়া হবে আইডি কার্ড। ব্যক্তি উদ্যোগেও কেউ কেউ হিজড়াদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে।
২০১৫ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক দেওয়ার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, তাতে বলা হয় এনজিওর মাধ্যমে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিজড়ারা এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা) ঋণ সুবিধা পাবে। কিন্তু এ ঋণ তারা পাচ্ছে না। ‘আসল ও নকল হিজড়া সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ কর্মসূচি স্থগিত করেছে।’ বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, কী কারণে হিজড়ারা ঋণ সুবিধা নিতে পারেনি।’
হিজড়াদের জন্য সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন আর তারা পরিচয়হীন নয়, তারা ভোট দিতে পারবে। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্পত্তিতে হিজড়াদের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার আইন তৈরির পথে। বয়স্কভাতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। প্রশিক্ষণের পর তারা যাতে কাজ পায় তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত ২০১৫ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তাদের এসএমই খাতের ঋণ গ্রহণের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে এসএমইএসপিডি একটি সার্কুলার জারি করায় কৃষিভিত্তিক ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, নকশীকাঁথা ও তাঁত, নার্সারি, নির্মাণ শিল্প ও গৃহায়ণ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন, সেলুন ও বিউটি পার্লার প্রভৃতির জন্য ঋণ গ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৃতীয় লিঙ্গের বা হিজড়াদের অবস্থান ধীরে ধীরে আরোও দৃঢ় হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ২০১১-১২ সালে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি সর্বপ্রথম হিজড়া জনগোষ্ঠীকে অনির্ধারিত লিঙ্গ হিসেবে জন্ম সনদ নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়। ভারত ২০১৪ সালের এপ্রিলে তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেয় এবং পাকিস্তান সরকারও ২০০৯ সালে হিজড়াদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন করে। যদিও মালদ্বীপসহ আরো ৫৪ টি দেশ জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত লিঙ্গ পরিচিতির বিরোধিতা করে আসছে।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন একটি প্রকল্প আছে সরকারের। তিনটি সেবা দেওয়া হয় অধিদপ্তর থেকে। এগুলো হলো উপবৃত্তি, প্রশিক্ষণ ও বয়স্কভাতা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে মোট বরাদ্দ ১১ কোটি টাকা। হিজড়া সংগঠনগুলো বলছে, এটা একেবারেই অপ্রতুল। এ অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করেন প্রকল্প পরিচালক আবদুর রাজ্জাক হাওলাদারও। বাংলাদেশ ব্যাংক হিজড়াদের জন্য বিশেষ ঋণের যে উদ্যোগ ঘোষণা করেছিল, তারা সে সুবিধাও ভোগ করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন হিজড়া সংগঠনগুলোর নেত্রীরা।
হিজড়াদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলেও তারা তা গ্রহণ করে না বা করছে না। তারা বুঝতে পেরেছে যে, কাজ করে যে টাকা তারা পায় তার চেয়ে বেশি পায় ভিক্ষাভিত্তির নামে বৈধ চাঁদাবাজিতে। চাকরি-বাকরি করে তারা যে টাকা পাবে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পাচ্ছে তাদের চলতি চাঁদাবাজিতে। এখন তাদের এ কর্মকাÐে নগরবাসি তথা পুরো দেশবাসি অতিষ্ঠ তথা বিরক্ত। প্রয়োজনে আলাদা কমিটি করে তাদের জন্য আয়বর্ধনমূলক কাজে তাদেরকে জড়িত করা হোক। অন্যথায় তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভুক্তভোগীদের আইন তাদের হাতে তুলে নেয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। দেশের বাইরে হিজড়ারা বিভিন্ন পেশায় জড়িত। কত সুন্দরভাবে শৃঙ্খলার সাথে কাজে করছে। আমাদের দেশেও তাদেরকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করতে হবে এবং তা করতে হবে খুব শিগগিরই।
বিত্তবানদের সহায়তায় সকলের সাথে পরামর্শক্রমে যত দ্রুত সম্ভব হিজড়া সম্প্রদায়কে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবতে হবে। এতে করে মানুষ হিসেবে এই শ্রেণির লোকেরা যেমন নিজেদের মূল্যায়ন পাবে, তেমনি বিড়ম্বনা থেকেও রক্ষা পাবে নগরবাসী।

লেখক : প্রাবন্ধিক