হিজল তমালের দেশে

107

-বাবা,আমরা কি সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি! যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা অনিকের।
-হ্যাঁ বাবা। সত্যি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। বার বার এই প্রশ্নটি করছে অনিক বাবার কাছে। জানে গাড়ি চলছে গোপালগঞ্জের পথে। তবুও প্রশ্নটি করছে। মন তার আনন্দে ভরে আছে। দেশের বাইরে থাকলেও ছোটোবেলা থেকে বাবার কাছে বাংলাদেশের কথা শুনে শুনে এদেশের প্রতি তৈরি হয়ে গভীর টান। বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। শুনেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। বাবার মুখে যুদ্ধের কথা শুনে অনিকের চোখে ভেসে ওঠে যুদ্ধের ছবি। ইংরেজদের দেশে বসে শিখেছে বাংলা।
-তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু কেন হয়েছিল জানো?
– কেন? প্রশ্ন নিয়ে অনিক তাকায় বাবার দিকে।
– তিনি ছিলেন এদেশের দুঃখী মানুষের বন্ধু। তাই ভালোবেসে সবাই তাঁকে বঙ্গবন্ধু ডাকে। তাঁর জন্যেই এসেছিল বাংলাদেশে স্বাধীনতা।
বাবার কাছ থেকে শুনেছে এই নেতার বীরত্বের কথা। তাই সুদূর কানাডায় থেকেও অনিক ভালোবেসেছে এই নেতাকে। এই দেশকে। তার কামরার ছোটো লাইব্রেরিতে রাখা আছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী,আমার কিছু কথাসহ তাঁকে নিয়ে লেখা অনেক বই।
অনিকের স্কুল বন্ধ। চলছে সামার ভেকেশন। এই বন্ধে বাবা যখন দেশে আসার কথা বললো,অনিকের খুশি কে দেখে!
-আমি লাস্ট কখন বাংলাদেশ গিয়েছি বাবা?
-তখন তোমার বয়স পাঁচ বছর হবে।
লাগেজ গোছানোর কাজে মা’কে সাহায্য করতে করতে বললো বাবা।
-ওহ্। তখন অনেক ছোটো আমি। সে-ও এগিয়ে দিচ্ছে এটা সেটা।
– হ্যাঁ। তুমি তখন বেশ ছোটো।
– এখন আমি ক্লাস এইট স্ট্যন্ডার্ডে! কত্তো বছর পর যাচ্ছি!
-কাজের ব্যস্ততায় কখন এতগুলো বছর চলে গেলো বুঝায় যায়নি। গুছানো একটি লাগেজ একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে মা বললো।
-বাবা,এবার কিন্তু আমি টুঙ্গিপাড়ায় আমি যাবোই যাবো। অনিক বায়না ধরে।
-হ্যাঁ বাবা। আমরা নিশ্চয় যাবো আমার প্রিয় নেতাকে দেখতে।
দেশে আসার দু’দিন পর ওরা যাচ্ছে গোপালগঞ্জ। কানাডাও গ্রীন কান্ট্রি। কিন্তু ওখানকার সবুজ গোছানো। কিন্তু এদেশের সবুজ তেমন নয়। পথের দু’পাশে বিস্তৃত সবুজ কখনো গোছানো ধান গাছে। বাতাসের দোলায় সাগরের ঢেউয়ের মতো দুলছে গাছগুলো। কখনো অগোছালো নাম না জানা বিভিন্ন রকম ছোটো বড়ো গাছে। কখনো রুক্ষ মাঠ। দেখতে বেশ ভালোলাগে অনিকের। বাবা বলেছে তারা পাটগাতী গ্রামে যাচ্ছে। বাবার খালার বাড়ি ওই গ্রামে।
গাড়ি যখন পাটগাতী গ্রামে এসে পৌঁছুল, তখন বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। বাবার খালার বাড়ি এই গ্রামে। টুঙ্গিপাড়ার পাশেই পাটগাতী। অনেকবছর পর ভাগ্নেকে দেখে খালা কেঁদে ফেললেন জড়িয়ে ধরে। অনিক দেখছিল বিকেলের নরম আলোয় সবুজের মেলা আর গ্রামের অপরূপ সৌন্দর্য! এই সুন্দরের মাঝেই শুয়ে আছেন তার প্রিয় বঙ্গবন্ধু!
-কি দাদাভাই! গ্রাম ভালো লাগছে না? বাবার খালু অনিকের পাশে দাঁড়িয়ে।
-খুউব ভালো লাগছে দাদুভাই। গ্রাম অনেক সুন্দর! আমি আগে কখনো দেখিনি।
-এবার দেখবে। দাদুভাই তোমাকে গ্রাম দেখাবো। খুশিতে ঝলোমল করে ওঠে অনিকের চোখ। দাদুভাইয়ের কথা শুনে।
-দাদুভাই? টুঙ্গিপাড়া কতদূর এখান থেকে?
-আমাদের পাশের গ্রাম দাদুভাই। হেঁটেই যাওয়া যায়।
-এতো কাছে! অনিক অবাক হয়।
-চলো যাই!
– কাল সকালে দাদুভাই। দেখো, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। অন্ধকারে কিছুই ভালো করে দেখা যাবেনা।
– ওকে। অনিক সায় দেয় দাদুভাইয়ের কথায়।
সুন্দর বিকেল বেয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় উঠোন। সবাই চেয়ার পেতে বসে গল্প করছে। জোনাকির ঝাঁক টিমটিম করে আলো জ্বালিয়ে উড়ছে। অনিক মুগ্ধ হয়ে দেখছে এই সৌন্দর্য। বড়দের গল্পে তার মন নেই। তার অপেক্ষা সকালের।
রাতে বিছানায় শুয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, মাঝে মাঝে কুকুরের ডেকে ওঠা শুনতে শুনতে ঘুম নেমে আসে চোখে। সকালে নাস্তা সেরে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে অনিক বায়না ধরলো হেঁটেই যাবে। মা একটু আপত্তি করেছিল হাঁটতে পারবে কিনা। বাবা বললো,
-কেন পারবে না? অনিক সাহসী ছেলে। বেশ পারবে।
বাবার কথায় খুশি অনিক। বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর গ্রামটি দেখে মুগ্ধ অনিক! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো পাথরে খোদাই করা ‘একটি অমর সমাধি’ কবিতাটি। পথের দু’পাশে ফুলের বাগান, কৃত্রিম পাহাড়। শান্ত, স্নিগ্ধতায় মিশে রয়েছে কেমন একটা বেদনা। লাল সিরামিক ইট আর শাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি সমাধিস্থলে এসে অনিকের মন ভার হয়ে এলো। এখানেই শুয়ে আছেন সেই নেতা বঙ্গবন্ধু। ওপরের দেয়ালে জাফরি কাটা। আলোছায়ার মায়াবী খেলা সমাধিসৌধ ঘিরে। চারদিকে কালো, মাঝখানে শাদা মার্বেল পাথরে বাঁধানো বঙ্গবন্ধুর কবর। অনিকের মন শ্রদ্ধায় ভরে এলো। বাবা চোখ মুছে নিলো।
হিজলতলা ঘাটে দাঁড়িয়ে অনিক যেনো দেখতে পাচ্ছিল শৈশবের বঙ্গবন্ধুকে! সেই দুরন্ত কিশোরকে, নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া, মেঠো পথের ধুলোবালি মাখা,বর্ষার কাঁদা পানিতে ভেজা! বাস্তবে অনিক এসব কিছুই দেখেনি। কিন্তু বাবা তাকে ইউটিউবে দেখিয়েছে গ্রামীন জীবন। তার মনে হচ্ছে ট্যাবে দেখা সেই দৃশ্য একদম জীবন্ত হয়ে তার চোখের সামনে। অদ্ভুত এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে তার মনে। কল্পনার চোখে সে যেনো দেখতে পাচ্ছে টুঙ্গিপাড়ার সেই দুরন্ত কিশোর খোকাকে। সেদিন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল,এই কিশোরই একদিন হয়ে উঠবেন জননেতা! তারা ঘুরে দেখে বঙ্গবন্ধুর আদি বাড়ি,ছেলেবেলার খেলার মাঠ,বালিশা আমগাছ। সব ঘুরে দেখতে দেখতে কখন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে খেয়ালই করেনি।
জীবন্ত ইতিহাসের কাছে এসে অনিক ভাষা হারিয়ে ফেলে। ফেরার পথে অনিক মনে মনে আওড়াচ্ছে কবিতার সেই লাইনগুলো –
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান
হঠাৎ মনে হলো, কেউ যেন স্নেহভরে ঢেকে বলছে,
-অনিক ফিরে যাচ্ছো? তোমরাই তো আমার দেশের রতœ! কোথায় যাচ্ছো এদেশ ছেড়ে? কণ্ঠস্বর খুব পরিচিত! রেসকোর্স ময়দানে দেয়া সেই ভাষণ অনিক অনেকবার শুনেছে। এ যেন সেই কণ্ঠস্বর! অনিক চমকে পেছনে তাকালো। কেউ নেই।
আছে শুধু হিজল, তমাল, তালগাছের ছায়া। রাশি রাশি সবুজ। দাদুভাই,মা,বাবা ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। ওই কণ্ঠে এতো স্নেহ মাখা ছিল,অনিক ভয় পায় না। কাউকে কিছু বলেও না। ভাবনার গভীরতম স্তরে গেলে এমন হয়। অনিক জানে সেটা। দাদুবাড়ির পথ ধরে হেঁটে আসতে আসতে অনিক মনে মনে উত্তর দেয়,
-কিছু সময়ের জন্যে যাচ্ছি।আমি আবার ফিরবো। এই সবুজ সোনার দেশে আমি আবার ফিরে আসবো। আমার বন্ধুর কাছে আমি ফিরে আসবো।