হালদা থেকে ডিম সংগ্রহে আগেভাগে ব্যাপক প্রস্তুতি

71

হালদায় কার্প জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা-মাছের ডিম ছাড়াকে কেন্দ্র করে নদীর পাড়ে এখন উৎসবের আমেজ। প্রতি বছর এপ্রিল মাসে প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও মেঘের গর্জনে ডিম ছাড়ে মা-মাছ। এবার পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হওয়া, পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, নিষিদ্ধ যান্ত্রিকযানের অবাধ চলাচল এবং দখল-দূষণে মা-মাছের ডিম ছাড়তে দেরি হচ্ছে।
তবে এ মাসের চলতি সপ্তাহে ভরা পূর্ণিমার দ্বিতীয় জো’তে মা-মাছ ডিম ছাড়তে পারে বলে আশা করছেন হালদা বিশেষজ্ঞরা। তাই জাল, নৌকা, ডিম ধরার মশারি জাল, বালতিসহ ডিম সংগ্রহের নানা সরঞ্জাম নিয়ে প্রায় পাঁচশ নৌকা নিয়ে সহ¯্রাধিক জেলে ও ডিমসংগ্রহকারীরা অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
সরেজমিন হালদা পাড়ে দেখা গেছে, এবার ডিম আহরণকারীদের আগাম প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে ডিম সংগ্রহের প্রস্তুতি হিসেবে তারা তৈরি করে রেখেছেন রেণু ফোটানোর জন্য দুই পদ্ধতিতে মাটির কুয়া। নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু ফোটাতে কেউ কেউ নদী তীরে মাটির কুয়া তৈরি করছেন। এসব কুয়া দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫ ফুট ও প্রস্থে ১০ ফুটের মত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার সরকারিভাবে কংক্রিট দিয়ে চারকোণার কিছু কুয়া তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ডিমসংগ্রহকারীদের।
হাটহাজারী উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আজহরুল আলম জানান, রাউজান উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে দেড়
শতাধিক মাটির কুয়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি ৩টি হ্যাচারিতে ৮৯টির মধ্যে প্রায় ৬০টি কুয়া প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে হাটহাজারী অংশে ৬০টি মাটির কুয়ার পাশাপাশি ৩টি হ্যাচারিতে ১১৮টি কুয়া ডিম রাখার জন্য প্রস্তুত আছে। সব মিলিয়ে এবার ৪১৭টির মতো কুয়া ডিম রাখার কাজে ব্যবহার করা হবে।
এদিকে হালদা নদীতে দিনরাত নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মা-মাছ সংরক্ষণ, ডিম থেকে রেণু তৈরির কুয়া সংস্কার, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাসহ নানা উদ্যোগের কারণে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে- এমন আশা করছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমীন।
তিনি বলেন, নদীতে মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে গত ৭ মাসে ছোট-বড় প্রায় ৪০টির মত অভিযান পরিচালনা করে প্রায় ১ লক্ষাধিক মিটার ঘেরা-ভাসা জাল জব্দ ও ৫টি ড্রেজার ধ্বংস করা হয়েছে। আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এজন্য এবার ডিম ও রেণু বেশি হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইউএনও বলেন, মাছুয়াঘোনা, শাহমাদারি ও মদুনাঘাটসহ ৩টি হ্যাচারির ১০৮টি কংক্রিট ও ১০টি প্লাস্টিকের কুয়ায় হালদার ডিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। তবে প্রায় ৫ বছর ধরে সংস্কারের অভাবে এসব কুয়ার ৪৫টি নষ্ট হয়ে যায়। গত কয়েক সপ্তাহে নষ্ট হওয়া কুয়াগুলো সংস্কার করেছি আমরা। জেলেদের বলেছি, প্রয়োজনে আরও কুয়া তৈরি করে দেবে উপজেলা প্রশাসন। হালদায় জেলেদের ডিম সংগ্রহে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে চাই আমরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক হালদা গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, সাধারণত প্রতি বছরের এপ্রিল মাসে অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের সাথে পাহাড়ি ঢল নামলেই হালদায় ডিম ছাড়া শুরু করে কার্প জাতীয় মা-মাছ। এবার ৩ থেকে ৯ এপ্রিল অমাবস্যার সময় পাহাড়ি ঢল কম থাকায় ডিম ছাড়েনি মা-মাছ। এপ্রিল মাসের চলতি সপ্তাহে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে পূর্ণিমার সময় হালদায় মা-মাছ ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এবার ভরা পূর্ণিমার সময় ডিম সংগ্রহে এবার নতুন রেকর্ড যুক্ত হবে- এমন আশা করা যায়।
গত ৬ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এপ্রিলে হালদায় মা-মাছ সাধারণত প্রথম দফায় ডিম ছাড়ে। এরপর কোন কোন বছর মে-জুনে দ্বিতীয় দফায় ডিম ছাড়ে। হালদা থেকে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালের ২ মে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল প্রথম দফা ও ১৩ জুন দ্বিতীয় দফায় ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল ১৬ হাজার ৫০০ কেজি এবং ২০১৩ সালে ৬ এপ্রিল ৪ হাজার ২০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। ২০১৬ সালের এপ্রিলে হালদাতে তিন দফা নমুনা ডিম ছাড়লেও শেষ পর্যন্ত ডিম ছাড়েনি মা-মাছ।
পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, যান্ত্রিকযানের অবাধ চলাচল ও দখল-দূষণকে দায়ী করে হালদা পাড়ের কয়েকজন ডিমসংগ্রহকারী কামাল সাওদাগর বলেন, কয়েক বছরের খরা কাটিয়ে গত বছর (২০১৮) আমরা ভালো ডিম সংগ্রহ করেছিলাম। এবার মা-মাছ রক্ষায় গত কয়েক মাস ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) এর হালদা প্রকল্পের কর্তারা। নদীতে মা-মাছের আনাগোনা বেড়েছে। এখন আমরা ডিম সংগ্রহে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি।
প্রসঙ্গত, হালদা থেকে রুই জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। হাটহাজারী-রাউজান-ফটিকছড়ি উপজেলা সীমানা দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদীতে প্রতি বছর বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে ডিম ছাড়ে মা-মাছ। হ্যাচারি পোনার চেয়ে হালদার পোনা দ্রæত বর্ধনশীল বলে এ পোনার কদর সারাদেশে। ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম সংগ্রহ করে তা থেকে রেণু ফুটিয়ে বিক্রি করেন। রেণুর আয় দিয়ে পুরো বছর জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।