হলুদ হেমন্ত

421

‘বাংলাদেশে ছয়টা ঋতু। হেমন্ত হচ্ছে একটা ঋতুর নাম। পাকা ধানের ঋতু। মাঠগুলো হলুদ হয়ে যায়। চাষাপাড়ায় আশা বাড়ায় পাকা ধান। নতুন চালের ভাত। মন মাড়ানো ঘ্রাণ। পাখিগুলো তাজা হয়ে ওঠে। পালকগুলো করতে থাকে চিকচিক। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বিলের ওপড় ওড়ে-ধানের ক্ষেতে পড়ে; ধান খায়, পেট ভরলে উড়ে যায়।’ -ঠাকুরমা’র কাছে হেমন্ত ঋতু সর্ম্পকে এ ভাবে জেনেছে রুনু।
পুকুরের পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে রুনু অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পাকা ধানে ভরা বিলের দিকে। বড় ভালো লাগে। নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় তুলো মেঘের ভেলা।
খাবার সময় হলে ঠাকুরমা পুকুর ঘাটে এসে নাম ধরে ডাক দেন। অনিচ্ছা স্বত্বেও গিয়ে খেয়ে আসে রুনু। বাতাসে শীতের পরশ। স্নান করতে মন চায় না তার । ঠাকুরমা গরম পানি মিশিয়ে দু’তিন দিন পর পর মল্লমস্তি করে স্নান করিয়ে দেন।
নবান্নের ঋতু হেমন্ত। পিঠা তৈরীর ধূম পড়ে কৃষাণ পল্লীতে। রুনুর বড় ইচ্ছে হয় চাষার ঘরের নবান্ন খেতে। ঠাকুরমার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ পর্যন্ত যাওয়া-খাওয়া হয়নি।
ঠাকুরমার সাথেই তার যত আবদার। মায়ের সাথে পাশের ঘরের ছেলের মতই সম্পর্ক। ঠাকুরমার মন-মেজাজ ভালো থাকলে বইয়ের ভাষায় কথা বলেন। চটে গেলে ঘোর চাটগাঁইয়া ভাষায় খিস্তি পর্যন্ত বের হয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রুনু তখন দুনিয়ার সব চেয়ে অসহায় নাতিটার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু নির্বাক!
কোন দরকারে ঠাকুরমা পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখেন গুণধর নাতি চুপচাপ গাছের ছায়ায় বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বুড়িবিলের দিকে।
‘অমন নিবিড়ভাবে মন দিয়ে ওদিকে কী দেখিস ননাইয়া?’
চমকে ওঠে রুনু। বলে, ‘সারা বিলটা হলুদ হয়ে গেছে। কেউ যেন হলুদ বেটে ছিটিয়ে দিয়েছে।’
‘এই হেমন্ত ঋতুতেই তো বাংলা মায়ের বিয়ে হয়। দেখিস না, সারা গায়ে হলুদবাটা মেখে বসে হাসছে।’
‘তাই বুঝি? কার সাথে ঠাম্মা?’-উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে বসে রুনু।
‘কার সাথে আবার, ঋতুর সাথে’-ঠাকুরমা উত্তর দেয়।
‘ঋতুর সাথে বাংলা মার বিয়ে’?-প্রচÐ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রুনু ঠাকুরমার দিকে।
‘ও ঠাম্মা, এ কথা তো আর কোনোদিন শুনিনি।’
মেজাজ চটে গেল ঠাকুরমার।
‘মার পেডততুন্ মাডিত্ পইরগ্যাস্ যে পঁড়–য়া বেয়ানে। মু-উততুন্ দুধর গন্ধ গিয়েনি? ক্যাএনে হুনিবি? এ্যাঁ?’(মার পেট থেকে মাটিতে পড়লি পরশু সকালে। মুখ থেকে দুধের গন্ধ গেছে কি? শুনবি কি করে,বল?)
আর কোন প্রশ্ন পাড়বার সাহস উবে গেল রুনুর। ঠাকুরমা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘আজিয়া তোর সিয়ানের দিন। চল, চুলাত্ পানি গরমত্ দি।’
(আজকে তোর স্নান করার দিন। চল, গিয়ে চুলায় গরম করার জন্য জল বসিয়ে দেই)
উপায়ন্তর না দেখে রুনু বাড়ির দিকে দিল দৌড়। মাকে ধরে যদি বাঁচা যায়, সেই আশায়!