হরিপদ মল্লিক : এক মহৎপ্রাণ

109

পটিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ধাউরডেঙ্গা। এখানে তেমন কোন সরকারি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। গ্রামের তিন পাশ খালবেষ্টিত। অত্র গ্রামবাসীসহ কয়েক গ্রামের পারাপারের একমাত্র মাধ্যম বাঁশের সাঁকো। সাঁকো দিয়ে এলাকার অনেক শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজে আসা যাওয়া। কিছু দিন পর পর সাঁকোগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে অভিভাবকরা সবসময় ভয়ে থাকেন, কখন যে কি হয়? এছাড়া গরু ও কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে চলাফেরায় ভয়ংকর অবস্থা; মৃত্যু যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে! গ্রামের গুটিকয়েক পরিবার ছাড়া সকলের আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। একাধিক মেয়ের বিবাহ, জটিল রোগের চিকিৎসা, আর্থিক অভাব অনটন সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজমান। সমাজের এমন করুন দশা দেখে এগিয়ে আসেন হরিপদ মল্লিক। যার সাহায্যে অভ‚তপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে এ গ্রামে। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজ খরচে গ্রামে চারটি কালভার্ট নির্মাণ করেন। আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়ান বহু মেয়ের বিয়েতে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন যে যখনই তাঁর কাছে গেছেন তিনি সাধ্যমত তাদের সহযোগিতা করেছেন। কাউকে কখনও নিরাশ করেননি।


হরিপদ মল্লিক ১৯৩৩ সনে ধাউরডেঙ্গা গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কালিয়াইশ শ্যাম-সুন্দর বিদ্যালয় হতে প্রাক্ প্রাথমিক ও ভাটিখাইন নলিনীকান্ত মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাস করেন। এরপর পাকিস্তান পিরিয়ডে চট্টগ্রামের বৃহৎ ওষুধের পাইকারী প্রতিষ্ঠান বোম্বে ফার্মে তিনি কর্মে নিয়োজিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি ওষুধের ব্যবসা শুরু করেন। হরিপদ মল্লিক গত ২৮ অক্টোবর ২০১৯ইং তারিখে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি এক কন্যা ও তিন পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী সবিতা মল্লিক একজন রতœগর্ভা। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. লিটন মল্লিক তাঁদের জ্যেষ্ঠ সন্তান। মধ্যম ছেলে সমিত্র মল্লিক একজন প্রবাসী। কনিষ্ঠ ছেলে সিদ্ধার্থ শংকর মল্লিক অস্ট্রেলিয়া থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ¯œাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ডা. প্রিয়তোষ দাশ তাঁদের কন্যা রিখা মল্লিকের স্বামী।
কর্মই ধর্ম। এ কথাটি হরিপদ মল্লিক মনে পুষে সর্বদাই সামাজিক কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। সমাজের যেকোন কাজে তিনি এগিয়ে আসতেন। তাঁর চিন্তা চেতনা ছিল অনন্য। সমাজের সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর ভাবনায় ছিল- আমরা প্রত্যেকে ভালো হলে আমাদের চারপাশের সবাই ভালো হবে। হবে আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণ। এজন্য সমাজের ধনী-গরিব, সকল বর্ণের মানুষকে সমভাবে গুরুত্ব দিতেন। বিধর্মীদের তাঁর জমিতে চাষ করে জীবন নির্বাহের সুযোগ দিতেন এবং সহায়তা করতেন। সবার প্রতি দয়া, ভালোবাসা, দান, উত্তম ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। আচার-আচরণ ব্যবহার দেখে তাঁর প্রতি বিশ্বাস আনতে কেউ দ্বিধাবোধ করত না। বার বার বিভাজিত সমাজকে একত্রিতকরণের চেষ্টা করেছেন। পাড়ায়-পাড়ায় বিভেদ কখনও পছন্দ করতেন না। পাড়া প্রতিবেশীকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। সমাজের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম ও শ্রদ্ধা ছিল।
তিনি কখনও সমাজে নেতা হতে চাননি। নেতা সাজতেও চাননি। আজীবন সমাজের সেবক হয়ে কাজ করে গেছেন। সমাজের যেকোন অনুষ্ঠানে তাঁর নাম আসুক বা না আসুক এ নিয়ে তিনি কখনও মাথা ঘামাননি। হরিপদ মল্লিকের চেতনা হলো-‘আমরা মানুষ; সামাজিক জীবন। এত ভাগাভাগি না করে, সবাই মিলে সুন্দরভাবে বাঁচতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো অনেক দূর এগিয়েছে। আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার, সকলে একসাথে থাকলে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’ সমাজ থেকে অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন ও হানাহানি দূর করে মানুষে-মানুষে অকৃত্রিম ভালবাসা ও স¤প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলাই ছিল তাঁর মূল ভাবনা। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সকলের প্রতি আহŸান জানাতেন। একটি মানবিক সমাজ গঠনে পারস্পরিক সদ্ভাব ও শ্রদ্ধাবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। তিনি এ কথাগুলো বলতেন। সমাজ থেকে অবিচার ও কুসংস্কার দূর করতে সবাইকে পরাশর্ম দিতেন।
তিনি এলাকায় ব্যয়বহুল যে চারটি সেতু নির্মাণ করেছেন কোনটিতে নিজের নামে নামফলক দেননি। এ বিষয়ে যাঁরা নামফলক ও সংবর্ধনা দেওয়া উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তাঁদেরকে তিনি বলেন, “আমার নামে নামফলকের কোন প্রয়োজন নেই এবং সংবর্ধনা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তোমরা আমার পেছনে যে টাকা খরচ করবা, সে টাকা গ্রামের অন্যান্য কাজে ব্যবহার করো। এতে সমাজের সবার উপকারে আসবে।” তাঁর চিন্তা চেতনা ছিল মহৎ। তিনি কথায় নয় কাজে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। এ ধরণের গুণী মানুষ বর্তমান সমাজে খুবই বিরল।
হরিপদ মল্লিক কর্ম জীবনে যে অসাধারণ নিষ্ঠা, আত্মপ্রত্যয় ও কর্মদক্ষতা দেখিয়েছেন তা সমাজে অ¤øান হয়ে থাকবে। কর্মের মাধ্যমে শূন্য থেকে পূর্ণের যে নজির তিনি সৃষ্টি করেছেন এর তুলনা হয় না। স্বল্পভাষী, সদা প্রফুল্ল এ অসাধারণ মানুষটি পটিয়াবাসী তথা আত্মীয়-স্বজনের মনে যে সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত, এর মূলে রয়েছে ভালো ব্যবহার এবং কর্মযোগ। মানব সেবা দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে তিনি সমাজের কল্যাণসাধন করেছেন। মানুষ নশ্বর হলেও তাঁর কর্ম অবিনশ্বর।
পৃথিবীতে কদাচিৎ এমন সব ত্যাগী ও সৎ মানুষের জন্ম হয় যাঁদের প্রভাব কালজয়ী হয়ে চিরদিন মানুষের কল্যাণপ্রসূ হয়ে থাকেন। মানবজীবনে মৃত্যু অবধারিত। প্রত্যেক ধর্ম এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। বিশ্বজগতে অনন্তকাল প্রবাহে মানুষের জীবন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। এ ক্ষণস্থায়ী জীবন ও মহিমা পেতে পারে মানুষের মহৎ কর্মে এবং অবদানে। মহৎ কীর্তির মাধ্যমেই মানুষের জীবন সফল ও সার্থক হয়। কাজের মাধ্যমেই মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে- ‘এৎবধঃ সরহফং ধৎব রসসড়ৎঃধষ. কীর্তিমানের মৃত্যু নাই।’ ঠিক তেমনি কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন হরিপদ মল্লিক। মোদ্দা কথা, তাঁর আদর্শ সমাজ চিন্তা, জ্ঞান-কর্ম ও উৎকৃষ্ট ব্যবহারে তিনি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। এ ধরনের মানুষের জীবনাদর্শ অনুসরণ করা উচিত। এতে করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্য-ন্যায় ও সুন্দরের। সমাজে জয় হোক মনুষ্যত্বের, জয় হোক মানবতার।

লেখক : প্রাবন্ধিক