হঠাৎ উচ্ছেদে গৃহহীন দেড় শতাধিক পরিবার

42

কক্সবাজারে বিনা নোটিশে অকস্মাৎ উচ্ছেদে দেড় শতাধিক পরিবারের সহস্রাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ফাতের ঘোনার এসব মানুষ মাথাগোজার ঠাই পেতে রাজপথে বিক্ষোভ করছে। গতকাল বৃহ¯পতিবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল সহকারে ক্ষতিগ্রস্ত নারী-পুরুষ ও শিশুরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে এসে অবস্থান ধর্মঘট করে। অবস্থান ধর্মঘটকালে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, গত মঙ্গলবার বিকেলে জেলা প্রশাসন ও দুদকের একটি টীম এলাকায় গিয়ে সরকারি খাস জমিতে বসবাসকারি এসব লোকজনকে রাতের ভেতর চলে যেতে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে আসেন। এ সময় বিদ্যুত বিভাগের কর্মীদের দিয়ে দেড়যুগ আগে নেয়া বিদ্যুতের লাইনও কেটে নিয়ে যান তারা। এত অল্প সময় তার উপর শীতের রাতে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের নিয়ে কোথায় যাবে- তা ঠিক করতে না পেরে কেউ সরে যাননি। কিন্তু বুধবার সকালে পুলিশ, র‌্যাব ও দুদকের টীম নিয়ে বুলডোজারসহ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফাতের ঘোনায় যান। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগে অভিযানকারিরা বুলডোজার ও মাথায় লাল ফিতা বাধা শতাধিক শ্রমিক দিয়ে পাহাড়-সমতল সব জায়গার কাঁচা ও আধাপাকা ঘর ভাঙা শুরু করে। ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ির কোনো মালামালও বের করতে দেয়া হয়নি। ভাঙনের কবলে পড়েছে রেজিস্টার জায়গার ঘরও। তাদের জমি রেজিস্ট্রি রয়েছে জানানোর পরও কর্ণপাত করা হয়নি বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচেই রাত যাপন করেছে ঘর ভেঙে দেয়া শতাধিক পরিবার। রান্না করতে না পেরে মুড়ি ও অন্যান্য শুকনো খাবার দিয়ে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষিধে নিবারণ করা হয়েছে।
দিনব্যাপি ভাঙন অভিযান শেষে প্রশাসন একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে চলে যায়। বাকি ঘরগুলো আগামি রবিবার ভাঙা হবে বলে মৌখিক জানিয়ে যান অভিযানকারিরা। ক্ষতিগ্রস্ত ইমরান, আবদুল ওদুদ, মরিয়ম, জয়নাল, সেলিম, ফারুক, হাফেজ, মেহেদীসহ অনেকে জানান, ভাঙনের কবলে পড়া অনেক পরিবারে ২ ফেব্রæয়ারি শুরু হওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী রয়েছে। যার সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক। অকস্মাৎ বিদ্যুত ও গৃহহীন হয়ে শেষ প্রস্তুতির পড়াও তারা পড়তে পারছে না। এটি রেজাল্টে প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা তাদের। এছাড়াও বিদ্যুত না থাকায় দু’দিন ধরে মোটর থেকে পানি তোলা বন্ধ। ভেঙে দেয়া হয়েছে প্রায় প্রতিটি বাড়ির বাথরুম-টয়লেটও। ফলে প্রাকৃতিক ডাক সাড়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অনেকের শেষ সম্বল বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে দেখে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কয়েকজন।
গতকাল বৃহ¯পতিবার সকালে এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কেউ ভাঙা ঘরের স্তুপের সামনে অসহায় হয়ে বসে আছেন। আবার কেউ তেরপল টাঙিয়ে মাথায় ছায়া দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন শতাধিক শিশুর মায়েরা। বাচ্চাদের ঠান্ডা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। সবার চোখে মুখে অজানা আতংক ভর করে আছে।
কক্সবাজার পৌরসভার পূর্ব লাইট হাউজ ফাতেরঘোনা সমাজ কমিটির সাবেক সভাপতি সোনামিয়া (৭৪) জানান, ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জেলার বিভিন্ন উপক‚লীয় এলাকা হতে পাহাড় ঘেরা এ এলাকায় এসে আবাস গড়ে শত শত মানুষ। তারা এখানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যুগ যুগ ধরে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনসহ রাষ্ট্রীয় নানা কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে। এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এলাকায় রয়েছে অর্ধসহস্রাধিক নানা বয়সের শিক্ষার্থী। রয়েছে নানা কর্মজীবী মানুষ। ঘর ভেঙে দেয়ায় সবাই ভোগান্তিতে পড়েছে।
এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ মকবুল আহমদ বলেন, সরকারি খাস জমি হলেও চিহ্নিত দখলদার থেকে নিজ নিজ ভিটা ক্রয় করতে হয়েছে এখানকার অধিবাসীদের। কিন্তু মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ হাজার একরেরও বেশি পাহাড়ি ভ‚মি বিরাণ করে আশ্রয় দিয়েছেন। সেখানে আমাদের শেষ সম্বল দিয়ে তৈরি করা মাথাগোজার ঠাঁই বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করে গৃহহীন করা হয়। ভিনদেশীদের প্রতি মানবতা দেখিয়ে দেশীয় উদ্বাস্তু লোকজনের উপর এমন খড়গ চরম অমানবিক। আমরা মানবতার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশের মানুষ। তার কাছে এ ঘটনার বিচার চাই।
এবিষয়ে জানতে পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী মোরশেদ আহমদ বাবুর সাথে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, প্রতি বর্ষায় পাহাড় ধ্বসে পাদদেশে বসবাসকারী লোকজন মারা যায়। তাই আমরা তাদের এসব এলাকার বসতি তুলে চলে যেতে মাইকিং করি। কিন্ত তারা যায় না। এখন দুদক এটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে আর আমরা তাদের সহযোগিতা করছি। ক্ষতিগ্রস্তরা জলবায়ু উদ্বাস্তু এটি স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে জেলা প্রশাসক বলেন, পাহাড় কর্তন ও সেখানে বসবাস কোনোভাবে গ্রাহ্য নয়। যদি এখানকার অধিবাসীরা জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ভ‚মিহীন হয়ে থাকে তবে তারা আবেদন করলে তাদের জমি ও ঘর দুটোই দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, টানা দুইদিন গত মঙ্গলবার ও বুধবার অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার শহরের লাইটহাউজ ফাতেরঘোনা এলাকায় ৭৮ একরের সরকারি একটি পাহাড় দখলমুক্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।