হজ মুসলিমদের মহাসম্মেলন

94


হজ বিশ্ব মুসলিমের এক মহাসম্মেলন। ইসলামে পাঁচ স্তম্ভের একটি। পবিত্র কোরআনের সূরা হজের দু’টি আয়াতে করিমায় হজ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। হজের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায় তাঁদের কল্যাণ অবলোকন করবে। (সূরা হজ, আয়াত:২৭) আল্লাহ পাকের প্রদেয় পশু তাঁর নামে জবাই করে নিজে খাবে এবং গরিব মিসকিনদের খেতে দেবে। হজ এমন একটি ইবাদক যা অর্থ দৈহিক পরিশ্রমের ফসল। এতে রয়েছে ত্যাগ, কল্যাণ ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা। (সূরা হজ, আয়াত : ২৮)।
প্রত্যেক সুস্থ ও আর্থিক সামর্থবান মুসলমানের উপর হজ ফরজ। মহান আল্লাহ্পাক জাল্লে শানহু ইরশাদ করেদেন, মহান জাতির জন্য যে ঘরটি সর্বপ্রথম নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা বক্কাতে। এটি সমগ্র জগতের পথনির্দেশনাকারী কল্যাণময়। এতে নিদর্শন আছে, ‘মাকামে ইব্রাহিম’ যে এর ভিতরে প্রবেশ করবে সেই নিরাপদ থাকলো। মানব সম্প্রদায়ের ওপর আল্লাহর অধিকার এখানে যার উপস্থিত হবার সামর্থ রয়েছে, সে যেন ‘হজ’ করে। কেউ যদি এই বিধান অমান্য করে (সে যেন জেনে রাখে) আল্লাহ সমগ্র জগতের পরোয়া করেন না। (সূরা : ৩, আয়াত : ৯৬-৯৭)
হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ সংকল্প, ইচ্ছা, কামনা, কোন পুণ্য উদ্দেশ্য সাধনের দৃঢ় সংকল্প করা। ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় আল্লাহ পাকের পবিত্র ঘর জিয়ারত করাকে ‘হজ’ বলে। মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত নরমশুল ও ভূমÐের সমস্ত কিছু সৃষ্টি করার পূর্বে সর্বপ্রথম পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেন। কাবাঘরকে কেন্দ্র করে ছয়দিনে সমগ্র সৃষ্টি জগৎ তৈরী করেন এবং কাবাকে মানবজাতির জন্য হিদায়তের কেন্দ্রস্থল করেন। পবিত্র কোরানে আল্লাহ্পাক ইরশাদ করেন, ‘এবং স্মরণ কর যখন এ ঘরকে আমি মানব সভ্যতার কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিয়েছিলাম এবং মাকামে ইব্রাহিমকে মুসাল্লাহ করার নির্দেশ করেছিলাম, আর ইব্রাহিম ও ইসমাঈলকে এ ঘরের তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী এবং রুকু সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখার হুকুম দিয়েছিলাম। ( কাবাঘর নির্মাণের পর) যখন ইব্রাহিম ফরিয়াদ করেছিল, হে আমার প্রভু তুমি এই নগরীকে নিরাপদ জনপদে পরিণত কর এবং এর মাধ্যমে বসবাসকারীদের যারা আল্লাহ ও পরকারের প্রতি আস্থাশীলদের জন্য বিভিন্ন ফল মূল দ্বারা জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা কর। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১২৫-১২৬)
সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) হজের জন্য সর্বজনীন আহব্বান জানিয়েছিলেন, তার জবাবে আল্লাহর ঘরের মেহমানগণ দোয়াপাঠ করে থাকেন। আল্লাহর রাস্তায় আহব্বানকারী নবী ইব্রাহিম (আ.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহর বান্দাগণ ! আল্লাহর ঘরে দিকে ছুটে আস, পৃথিবীর প্রান্ত হতে হাজির হও! পায়ে হেঁটে কিংবা যানবাহনে চড়ে আস’। (সূরা হজ)।
এই আহব্বানের জবানে আজ পর্যন্ত আল্লাহর পথের হাজিরা উচ্চারণ করেন তালবিয়া ‘ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক্ … আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির।
তোমার কোন শরীক নেই, আমি তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছি। সকল প্রশংসা তোমার এবং সমস্ত নিয়ামত তোমারই, আর সমগ্র রাজ্য তোমারই, তোমার কোন শরীক নেই। (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)।
হজের মতো মহাসম্মিলন কোন ধর্ম জাতির কাছে অনুষ্ঠিত হয় না। একমাত্র একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলমানগণেই পৃথিবীর দিক দিগন্ত হতে ছুটে আসে খানায়ে কাবার নিকট আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। এখানে বর্ণ নেই, ভাষা নেই, ধনী নেই গরিব নেই, সকল পার্থক্য ভুলে সবাই এক সাথে উচ্চারণ করেন আল্লাহর প্রশংসা ও একত্ববাদের কথা।
লক্ষ লক্ষ আল্লাহর পাগলবান্দা কন্ঠ মিলিয়ে তালবিয়া পাঠ করে। এই তালবিয়ায় আওয়াজ কাবা ঘরে ধ্বনিত হয়ে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায় তখন মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দার ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘হে আমার প্রিয় বান্দা! আমি তোমার সাথে আছি। তুমি আমার নিকট যা প্রার্থনা কর আমি তোমাকে দিতে প্রস্তুত আছি। এই মহামিলনে আল্লাহ নৈকট্য লাভের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়। বান্দা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে পরম তৃপ্তি অনুভবে ধন্য হন।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এক ওমরা হতে অন্য ওমরা আদায় করা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে ওমরা দ্বারা গুনাহ সমূহ মাফ হয়ে যায় এবং মকবুল হজের প্রতিদান বেহেশত ছাড়া আর কিছুই নয়। (বোখারী ও মুসলিম)
আল্লাহর মেহমান আল্লাহর মহাপূণ্যময় ঘর খানায়ে কাবা প্রদক্ষিণ করা কর্তব্য। এ প্রদক্ষিণের অর্থ কী ? গূঢ় রহস্যই জানতে হবে। বিশ্ব বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ঈমাম গাযযালী (রাহ.) লিখেছেন, ‘ আল্লাহর ঘর প্রদক্ষিণ একত্ববাদী ধারণার সাথে গভীরভাবে সংয্ক্তু। এর প্রকৃত শপথ হচ্ছে আত্ম্যোন্নয়নের মাধ্যমে পরম ঐক্যের আবেষ্টনীর মধ্যে নিজ আত্মাকে পরিবেষ্টিত করে রাখা। তাওয়াফ মানে কাবাগৃহের চতুর্দিকে কেবল দৈহিক প্রদক্ষিণ নয় বরং হৃদয়পটে সার্বক্ষণিকভাবে মহান আল্লাহর স্মরণে সংযুক্ত করে রাখা। বিষয়টি আধ্যাত্মিক। আধ্যাত্মিকতার সাথে বিশ্বাসের প্রশ্নটি গভীরভাবে জড়িত। আমাদের বিশ্বাস কাবাগৃহ আসমানে অবস্থিত ‘বায়তুল মামুর’-এর প্রতিরূপ এবং কাবা তাওয়াফ, ফেরেশতাদের তাওয়াফ সাদৃশ্য যারা আরশের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করছে। আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে সাধারণ লোকের জ্ঞান সীমিত বলে অবস্থানুসারে তাদেরকে ফেরেশতাদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যেই বলা হয় : কাবা সেই লোকেরা তাওয়াফ করছে এবং সাক্ষ্য দিচ্ছে। (এহইয়াউ উলুমদ্দিন ২য় খন্ড পৃ: ৭৭)।
হজের তিনটি ফরজের প্রধান ফরজ হলো আরফাতের ময়দানে ৯ জ্বিলহজ মধ্যাহ্ন হতে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত অবস্থান করা। উফূফে আরফা বা আরফাতের ময়দানে অবস্থানের তাৎপর্য রয়েছে। আমাদের আদি মানব-মানবী হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.) বেহেস্ত হতে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। দীর্ঘকাল অনুতাপ-অনুশোচনার আগুণে দগ্ধ হয়ে আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) পরস্পর আরফাতের ময়দানেই মিলিত হন এবং তাঁরা এখানে একে অপরকে চিনতে পারে। শুধু চেনা নয় তাদের এখানে আত্ম্যোপলব্ধি ও আত্মজ্ঞানও জাগ্রত হয়।
সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রেমের রহস্য উদ্ঘাটনে তাঁরা সমর্থ হন। মহান আল্লাহ কাছ হতে সাময়িক বিচ্যুতির পর পুনরায় সংযোগ স্থাপনে সফল হন। তাই আরাফাতের ময়দানে শুধু পাপ মার্জনার স্থান নয় মানবসত্তা পরমসত্তার সাথে প্রেমময় মিলনের স্থানও।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক