সড়ক দুর্ঘটনার এ রায় ঐতিহাসিক ও দৃষ্টান্তমূলক

34

গত বছর রাজধানী ঢাকার শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় করা মামলার রায় হয়েছে গত রবিবার। রায়ে দুই বাসের চালক এবং একজন সহকারীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। অভিযোগে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এক বাসের মালিক ও একজন সহকারীকে খালাস দিয়েছেন বিচারক। সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মামলার এ রায় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। এটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে শিক্ষার্থী ও পথচারীদের ওপর উঠে গিয়েছিল রেষারেষিমূলক যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুটি বাস। এতে নিহত হয় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব; আহত হয় আরো কয়েকজন। ওই দুর্ঘটনার দিনই বাস দুটির চালক, হেল্পার ও মালিককে আসামি করে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন নিহত মিমের বাবা। মামলার তদন্তে জানা যায়, একটি বাসের ফিটনেসের মেয়াদ দুই বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ট্যাক্স টোকেনেরও মেয়াদ ছিল না। অন্য বাসটির রুট পারমিটই ছিল না। আসামিদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ২৭৯, ৩২৩, ৩২৫, ৩০৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয় অভিযোগপত্রে। মিম ও করিমের মৃত্যুর পর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নয় শুধু; পুরো দেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলনে উত্তাল করে তোলে রাজপথ। এক সপ্তাহ অচল ছিল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের সবকটি বিভাগীয় শহরের সড়ক। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলায়। সরকারের পক্ষ থেকে এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক ভূমিকার প্রতি সংহতি প্রকাশসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের সব দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। সংসদেও এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রেখে পরিস্থিতি শান্ত করেন তিনি। শিক্ষার্থীদের দাবিতেই সংসদে পাস হয় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। সর্বশেষ গত ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে এ আইন কার্যকর শুরু হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন থেকে ৯টি দাবি উঠে আসে শিক্ষার্থীদের ¯স্লোগানে, ইন্টারনেটে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যাতে সমর্থনও দিতে দেখা যায় রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলকে।
সড়ক দুর্ঘটনা দেশে নতুন নয়, আবার লাইসেন্সহীন, ফিটনেসহীন গাড়ি, অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ চালকের হাতে গাড়ি সড়ক দাপিয়ে চলার খবরও নতুন নয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের নরম-গরম পদক্ষেপ দৃশ্যমান হলেও বাস্তবে কথিত গাড়ির মালিক-শ্রমিকের তাণ্ডবের কাছে সবাই যেন অসহায়ই ছিল। ফলে অনেক মূল্যবান প্রাণ, মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। আমরা হারিয়েছি চিত্রনায়ক ইলিয়াছ কাঞ্চনের স্ত্রীকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও খ্যাতিমান সিনেমাটোগ্রাফার মিশুক মুনীরকে। হারিয়েছি চট্টগ্রামের দুই কীর্তিমান শাহেদ কাদেরী, প্রকৌশলী হারুন সালামকে। আমরা হারিয়েছি, দেশের দুই দ্রুততম মানবকে। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে পরপর দুইবার রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন শাহ আলম। অনিরাপদ সড়কের বলি হয়েছিলেন এই কীর্তিমান অ্যাথলেট। অনিরাপদ সড়ক শাহ আলমের মতোই কেড়ে নিয়েছিল আরেক দৌড়বিদকে, তিনি মাহবুব। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতেছিলেন মাহবুব। ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি জাতীয় দলের এক তরুণ ক্রিকেটারকে। তিনি মানজারুল ইসলাম রানা।
এভাবে কত হাজারো জীবন আমরা হারিয়েছি, যাদের নানামুখি স্বপ্ন হয়ত একটি পরিবার, একটি সমাজ, আমাদের এ দেশ আরো কত সমৃদ্ধি হতে পারত। কিন্তু বিপরীতে যা ঘটল একেকটি দুর্ঘটনা কত হাজারো পরিবারকে সর্বহারা করেছে! দেশ কত মেধা হারিয়েছে! কত মানব সম্পদ হারিয়েছে! নিহত পরিবারের পরের দুর্বিষহ জীবনের গল্প হয়ত আমরা আর জানার চেষ্টা করি না। অনেক পরিবার আছে তাদের আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হয়, সড়ক দুর্ঘটনার মর্মবেদনা।
সরকার সড়ক পরিবহন আইন করেছে, তা পরিপূর্ণ কার্যকর হওয়ার আগেই মিম ও রাজিব নিহত হওয়ার ঘটনার যে বিচার হয়েছে-তাতেই নিহতের পরিবারসহ দেশবাসী সন্তুষ্ট। আমরা আশা করি, বাকি বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে শিগগির। আমরা সরকারের সদ্য প্রণীত ও বাস্তবায়নাধীন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরে কোনোরকম শিথিলতাও দেখতে চাই না।