সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে

51

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীতে শুরু হওয়া ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ-২০১৯’ গত সাত দিনে জরিমানা আড়াই কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ৪০ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। তারপরেও সড়কে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। গাড়ি চালকেরা নিয়ম না মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, যাত্রী উঠানামা করছেন। পথচারীরা নিজেদের মত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ২২১ জন। প্রতিদিন গড়ে ২০ জন । চট্টগ্রামে প্রতিদিন বি আর টি এ’র ৩ টি পৃথক ভ্রাম্যমাণ আদালত নগরের বিভিন্ন স্থানে লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেস বিহীন গাড়ি ও ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মামলা, জরিমানা, গাড়ি ডাম্পিং করছেন।

বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম মনজুরুল হকের সাথে আলাপকালে জানান,পরিবহন খাতের অনিয়ম, অদক্ষ চালক, ফিটসেনবিহীন গাড়ি, যাত্রী-পথচারীর ট্রাফিক আইন অমান্য সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণ। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা চেষ্টা করছি। গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। বিরল কিশোর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাশ, ট্রাফিক সপ্তাহ পালনসহ কিছু পদক্ষেপের ফলে সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে আসলেও কয়েকদিন পর আবারো পুরোনো অনিয়মে ফিরে যায়। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ সড়কের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও সড়কে শৃঙ্খলা আসছে না। বিআরটিএ চালকদের লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয়ে দালালের মাধ্যমে করার ফলে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। ফলে অনুপযুক্ত গাড়ি ও চালক লাইসেন্স ও ফিটনেস পেয়ে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ায়। বিআরটিএ অফিসে দুদকের আকস্মিক অভিযানেও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রীও বারবার বি আর টি এ কে দুর্নীতিমুক্ত করার ঘোষণা দেন। কিন্তু বি আর টি এ দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কতিপয় ট্রাফিক পুলিশের মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক চাঁদাবাজি ও টোকেন বাণিজ্য সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণ। মাঠ পর্যায়ে যারা ট্রাফিক আইন বাস্তবায়ন করবেন তাদের যদি দুর্নীতিমুক্ত করা না যায় তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। সড়কে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক ক্ষেত্রে মামলা না করে মোটা অংকের টাকা লেনদেনে তা সমঝোতা করা হয়। ক্ষতিপূরণে পার পেয়ে চালকেরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। অদক্ষ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, মাদকাসক্ত চালক, চলন্ত অবস্থায় চালকের মুঠোফোন ব্যবহার, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, ট্রাফিক আইন মানার ক্ষেত্রে অনিহা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা কিংবা দখল হওয়া, ছোট ও অযান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি সড়কে বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মালিক-চালকদের মানসিকতা পরিবর্তন হতে হবে। শুধু মাত্র টাকা আয়ের প্রতিযোগিতার বদলে যাত্রী, পথচারীদের প্রতি সহনশীল, মানবিক হতে হবে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সাম্যক ধারণ ও মানার মানসিকতা গড়ে উঠতে হবে। যাত্রীরা হয়রানী, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ কোনো অনিয়মের অভিযোগ করলে যাত্রীর সাথে তর্ক, মারধর, হত্যা করার বদলে আমলে নিয়ে তা সংশোধন করতে হবে। একজন যাত্রীর কাছে দ্রুত ও নিরাপদ ভ্রমণ যেমন কাম্য। একজন চালক হেলপারেও সতর্কতার সাথে গাড়ি চালানো ও ট্রাফিক আইন মানা দরকার। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ ও দুর্ঘটনার জন্য চালকদের লাইসেন্স পয়েন্ট কর্তনের নিয়ম করা প্রয়োজন। এখন সড়কে লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালে লাইসেন্স বিহীন চালক ও ফিটনেস বিহীন গাড়ি কিছুদিন সড়কে চলাচল বন্ধ থাকে। পরে আবারো সড়কে দাপিয়ে বেড়াই পিষে মারে মানুষ, স্বপ্ন। পথচারিদেরও সচেনতার অভাব রয়েছে। ট্রাফিক আইন মানতে চাই না। ফুটপাত, জেব্রাক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনিহা। ট্রাফিক পুলিশ, স্কাউট সদস্যরা জোর করেও ট্রাফিক আইন মানাতে পারছে না। অনেকে ক্ষেপে তর্ক, মারামারিতে লিপ্ত হয়। তাড়া আছে, অসুস্থ, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বিরক্তসহ নানা অযুহাত দেখায়। অনেক গাড়ি জেব্রাক্রসিংয়ে না থামানোর কারণে পথচারীদের হাতের ইশারায় গাড়ি থামিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। শহরের অধিকাংশ ফুটপাত দখলে থাকায় পথচারী রাস্তার উপর হাঁটতে বাধ্য হয়। তাই ফুটপাতগুলো উদ্ধার করে পথচারী চলাচলের উন্মুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন। সচেতনতার বিকল্প নেই। যাত্রী পথচারী যতদিন সচেতন হবেনা ততদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে না। নিরাপদ সড়কের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে গণ সচেতনতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। নিরাপদ সড়কের বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তরভুক্ত করা, রুট সংখ্যা কমানো, সড়কে আলাদা লেন, যাত্রী উঠানামার জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ, ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস) ই-টিকেট ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সড়কে তদারকি, পুরাতন ও ছোট যানবাহনের পরিবর্তে নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে আধুনিক ও আরামদায়ক বাস সার্ভিস চালু, যে কোন সমিতির নামে চাঁদাবাজি বন্ধ, বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগে দুর্নীতি রোধ, বাস টার্মিনাল নির্মাণ (চট্টগ্রামে ২৭ বছরেও কোন নতুন কোনো বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়নি), সড়ক পরিবহন আইন ২০১৯ কার্যকর করা সহ করণীয় বিষয়ে বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি।
প্রতিশ্রæতি, ঘোষণা, সাময়িক পদক্ষেপ কিংবা নিরাপদ সড়কের বিষয় ইশতেহারে অন্তরভুক্ত নয় পুরো পরিবহন খাতকে আমূল পরিবর্তন করে ঢেলে সাজিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা দেশের ভাবমূর্তির বিষয়। যাদের পরিবারের কেউ দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হয়েছে একমাত্র তারা বুঝতে পারেন। একটি দুর্ঘটনা কিভাবে একটি পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। নিজে ও অন্যকে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে সবার ট্রাফিক আইন মেনে চলে দরকার। পরিবহন খাতে চলা ভয়াবহ নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি রোধ ,আধুনিক ও সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা, আইনের যথাযথ প্রয়োগে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব।

লেখক : প্রাবন্ধিক