সড়কের ওপর ১২শ ‘টোকেন ট্যাক্সির’ অবৈধ স্ট্যান্ড!

82

চারটি রাস্তা এসে মিলেছে অক্সিজেন মোড়ে। উত্তর চট্টগ্রাম থেকে শহরে প্রবেশের অন্যতম ব্যস্ত মোড় এটি। তবে যে পাশ থেকে গাড়ি আসুক না কেন, যানজটে আটকে যাওয়া যেন এ মোড়ের নিয়মিত চিত্র। প্রবেশের অনুমতি নেই অথচ সেখানে সড়ক দখল করে স্ট্যান্ড করেছে ১২শ সিএনজি ট্যাক্সি। শ্রমিক সংগঠনের তিনটি গ্রুপ ‘টোকেন মানি’ দিয়ে পুলিশ ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এ স্ট্যান্ড বসিয়েছে। এমনকি এ সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় স্থানীয় কাউন্সিলরও। ফলে দীর্ঘ যানজট ও ভোগান্তি যেন জনগণের নিয়তি। তবে শীঘ্রই অভিযান চালিয়ে মোড়ের অবৈধ গাড়ির স্ট্যান্ডগুলো উচ্ছেদ করা বলে জানিয়েছেন সিএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) হারুনুর রশিদ হাজারী।
সরিজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী সড়কের উভয় পাশে দ্ইু সারি করে দাঁড়িয়ে আছে সিএনজি অটোরিকশা। তার ওপর আরেক দফা রাস্তা দখল করেছে যাত্রীবাহী বাসগুলো। পার্কিংয়ে রাস্তার অর্ধেক বেদখল, বাকি অংশে চলছে বাসগুলোর যাত্রী উঠানামার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তবে সবগুলো সিএনজি অটোরিকশা জেলা এলাকার রেজিস্ট্রশন প্রাপ্ত। তাদের সীমানা নির্ধারণ করা আছে বালুচরা এলাকার নতুন ব্রিজ পর্যন্ত। অর্থাৎ সীমানা লঙ্ঘন করে মেট্রো এলাকায় গাড়ি চালাচ্ছেন তারা। এরপর রাস্তা দখল করে এমন দাপুটে আচরণের পেছনে রয়েছে ‘টোকেন’ রহস্য। শ্রমিক সংগঠনের তিনটি গ্রুপ আলাদা হয়ে গাড়িতে টোকেন দেয়। মাসে ৩শ ৩০ টাকা ও প্রতিদিন ২০ টাকার চাঁদার বিনিময়ে এ টোকেন দেওয়া হয়। গাড়িতে টোকেন থাকলে সীমানা অতিক্রম যেমন করা যায়, তেমনি ট্রাফিক পুলিশকে পরোয়া করারও কোনো প্রয়োজন পড়ে না। কেননা এ ‘টোকেন মানির’ একটি বড় অংশ চলে যায় সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশদের কাছে। এমনকি কোন সংগঠন কয়টি টোকেন দিতে পারবে, তাও নির্ধারণ করে দেয় পুলিশ। অক্সিজেন মোড়ে সিএনজি অটোরিকশা চালকদের সাথে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।
জানা গেছে অক্সিজেন মোড়ে সক্রিয় রয়েছে তিনটি শ্রমিক সংগঠন। যারা মূলত টোকেন নিয়ন্ত্রণ এবং পুলিশকে ম্যানেজ করে। সংগঠন তিনটি হল, সজল ও নাছিরের নেতৃত্বে জেলা অটোরিকশা অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়ন, জিএস করিমের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পু ড্রাইভার্স সহকারী ইউনিয়ন ও সাজ্জাদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়ন। এ তিনটি গ্রুপের অধীনে অক্সিজেন মোড়ে প্রায় ১ হাজার ২শ সিএনজি অটোরিকশা চলে। মাসিক টোকেন মানির পাশাপাশি প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ২০ টাকা চাঁদা তুলে প্রথম দুইটি গ্রæপ। তবে তৃতীয় গ্রæপটি প্রতিদিন ১০ টাকা করে চাঁদা তুলে। পূর্বদেশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব টাকার সিংহভাগ পায় পুলিশ, বাকি টাকা দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ ও নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা ।
চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের সংগঠনের নীতিমালা অনুসারে প্রতিজন সদস্য থেকে ১০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। ওই এলাকায় আমাদের ৮শ সিএনজি রয়েছে। বাকিরা ২০ টাকা কেন নেন, সেটা আমার জানা নেই। টোকেনের বিষয়ে তিনি বলেন, টোকেনের টাকা আমরা পাই না। আমি এসব বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।
জেলা অটোরিকশা অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক সজল বলেন, আমরা সংগঠনের উন্নয়ন ফান্ডের জন্য মাসিক ৩শ ৩০ টাকা করে নিই। সংগঠনের নিয়মিত খরচের জন্য ২০ টাকা করে নিই। অনুমতি না থাকলেও বিভিন্ন কলাকৌশলে মেট্রো এলাকায় গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করেন বলে জানান তিনি।
অক্সিজেন মোড়েই রয়েছে পুলিশ বক্স। পুলিশ বক্সের সামনে পুরো রাস্তাটা দখল করে আছে সিএনজি টেম্পুগুলো। রাস্তার দুইপাশে পার্কিংয়ের পাশেই বসেছে ভাসমান ভ্যানের দোকানগুলো। এ দোকানগুলোও রাস্তা দখল করে ব্যবসা করছে দৈনিক ভাড়ার বিনিময়ে। অক্সিজেন-কুয়াইশ রোড়ের মুখেও দুই দফায় রাস্তা দখল করেছে সিএনজি অটোরিকশা। রাস্তাটি কাঁচা বাজার ও সিএনজি মিলে দিনের বেশিরভাগ সময় বøক করে রাখে। ফলে দীর্ঘ যানজট পাড়ি দিয়ে মানুষকে গন্তব্যে যেতে হয়।
এ মোড় থেকে আরেকটি সড়ক গেছে ২নং গেটের দিকে। এ সড়কে চলে সিএনজি চালিত লেগুনা ও বাস। মোড়ের মুখটিতেই সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে লেগুনাগুলো। লাইনম্যানের সিরিয়াল অনুসারে চালকেরা যাত্রী নিয়ে চলে যান। তবে যাত্রী তুলতে আর নামাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন চালকেরা। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাগরিকের পথ চলতে হয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২নং ওয়ার্ড জালালাবাদের কাউন্সিলর শাহেদ ইকবাল বাবু পূর্বদেশকে বলেন, আমি রীতিমত যুদ্ধ করছি। চট্টগ্রাম রেঞ্জের সিএনজিগুলোর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আসার কোনো অনুমতি নেই। তারপরও তারা এসে রাস্তা দখল করে থাকে। এ সিএনজি স্ট্যান্ডের কারণে অক্সিজেন মোড়ে সবসময় যানজট লেগে থাকে। লোকজনকে নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অক্সিজেন জোনের ট্রাফিক ইন্সেপেক্টর হেমায়েত উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, টোকেন দেওয়ার বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। এখানে তিন-চারটি শ্রমিক সংগঠন এসব নিয়ন্ত্রণ করে বলে শুনেছি। আমি এ জোনের দায়িত্ব নিয়েছি বেশিদিন হয়নি। এমনকি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িগুলো সরিয়ে দিই। চেষ্টা করছি এ মোড়টিকে যানজট থেকে মুক্ত রাখতে।
সিএমপি’র উপ পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) হারুনুর রশিদ হাজারী পূর্বদেশকে বলেন, আমি গত তিন আগেও সেখান থেকে পাঁচ-ছয়টি গাড়ি টো করে নিয়ে এসেছি। টোকেনের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এমন কিছু হয়ে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আমাদের ট্রাফিক পুলিশের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় শতভাগ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। তবে থানার মোবাইল টিম যদি একুট এদিকে নজর দেয় তাহলে আমাদের ট্রাফিক পুলিশের জন্য ভালো হয়।
জেলা রেঞ্জের গাড়ি মেট্রো এলাকায় প্রবেশ করতে পারে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মেট্রো এলাকায় তাদের প্রবেশ করার কোনো অনুমতি নেই। তবে সিএনজি গ্যাস নিতে আসলে কোনো রকম দাঁড়ানো ছাড়া চলে যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমি মেয়র মহোদয়কে বিষয়টি অবহিত করবো। যাতে প্রশাসনের সহায়তায় এ মোড়কে সিন্ডিকেটমুক্ত করা যায়। তাছাড়া এ স্ট্যান্ড থেকে সব ধরনের ক্রাইমের জন্ম হচ্ছে। এমনকি অক্সিজেন থেকে দেখে বালুচরার ওদিকেও কয়েকটি গ্রুপ চাঁদাবাজি শুরু করেছে।