স্মৃতিগুলো থাকুক অটুট

71

নুসরাত সুলতানা

সুতীক্ষè ধারালো ছুরির খোঁচায় যেমন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে সবুজাবরণ ডাবের পানি ঠিক তেমনি মাঘ মাসের ১৪ তারিখের এই সকাল বেলায় মিষ্টি কোমল মোলায়েম সূর্যালোকে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের মধ্যে ছিটকে পড়েছিলো আনন্দের উচ্ছ¡ল তরঙ্গ। ফাগুন আসতে এখনও ১৫ দিন বাকি! কিন্তু কলেজের চত্বর দেখে বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে, এখন বসন্তকাল নাকি শীতকাল! হাজার রঙের ফুলে ফুলে ভরে গেছে কলেজ ক্যাম্পাস। তার মধ্যে মাথায় ফুলের টায়রা দেয়া, রঙিন ফুল গুজে দিয়ে খোঁপা সাজিয়ে, বিভিন্ন রঙে সজ্জিত রঙিন প্রজাপতির মতো প্রাক্তন ছাত্রীরা এসেছে একত্রিত হওয়ার জন্যে। এই সাত-সকালে সবাই এতো সুন্দর পরিপাটি করে সেজে এসেছে দেখলে যে কারোরই অবাক হতে হবে, আশ্চর্য হতে হবে! এই সোনালী সকালে আর কেউ হোক বা নাহোক আমি কিন্তু অনেক আশ্চর্য হয়েছি এতো সুন্দরী, রূপসী, অপ্সরীদের দেখে। বেশ কয়েকবার মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো তৃতীয় পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের। দফায় দফায় বিভিন্ন আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো তৃতীয় পুনর্মিলনী হবে আনন্দ ভ্রমণের মাধ্যমে। গন্তব্য-বেশি দূরে নয়, আমাদেরই খুব নিকটে মিরসরাইয়ের ‘আরশিনগর ফিউচার পার্ক’। ৬৯ ব্যাচের ছাত্রী শ্রদ্ধেয় জিনাত আজম ম্যাম থেকে শুরু করে যারাই সানন্দে সাগ্রহে পুনর্মিলনীতে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলো সবাই যথাসময়ে কলেজ প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হয়েছে। যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে রঙিন ফুলে ফুলে ভরে ওঠা বাগানে নির্মল সকালের কোমল আলোয় ছবি তোলার হিড়িক লেগে‌ গেলো। তিনটা সাজানো বাস কলেজ থেকে ছেড়ে যাবে গন্তব্যে। শ্রদ্ধেয় নিলুফার ম্যাডাম আমাকে ডেকে বললেন, নুসরাত কোথায়! আপনাকেই খুঁজছিলাম। একটা রেফেল ড্রয়ের টিকেট বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এগুলো বিক্রির সময় বলবেন, ‘অনেক ভালো ভালো গিফট আছে’। আমি অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে গেলাম! ম্যাডাম, ‘প্লিজ, আমাকে তুমি করে বলবেন। আমি আপনাদের অনেক জুনিয়র’। অসাধারণ একটা মুহূর্ত! স্মৃতিতে স্মৃতিতে ভরপুর এই কলেজ! অনেক আগে আমি যখন কলেজের স্টুডেন্ট ছিলাম তখন শিক্ষা সফরে যাওয়ার সময় রেফেল ড্র এর টিকেট বিক্রির দায়িত্ব পড়তো আমার উপর। কেনো যেনো আবারও একই দায়িত্ব এসে গেলো! আজ আবারো আমার বাসে টিকিট বিক্রি করবো। কিন্তু আমার ব্যাচমেটদের মধ্যে কে কোন বাসে তখনও জানিনা তাই সাথে সাথে টিকেট বিক্রি শুরু করে দিলাম! যেহেতু দূরে যেতে হবে তাই কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই নির্ধারিত বাসে উঠে বসলাম। আগে যখন শিক্ষা সফরে যেতাম তখন অধিকাংশ ছাত্রীই ছিলাম অবিবাহিতা আর যতটুকু জানি আজ যারা যাচ্ছি সবাই বিবাহিতা, ব্যতিক্রম শুধু এটুকুই। কিন্তু চলতি পথে যতটুকু ফিল করেছি সবাই আজ আবার আমরা কলেজের তরুনী ছাত্রী হয়ে ফিরেছি। আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়া প্রতিটা মুহূর্ত আমি উপভোগ করছিলাম দারুণভাবে। বহু বছর পর আবার সবাই মিলে একসাথে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বাসে করে বাইরে বেড়াতে যাওয়া, এর যে কি পরিমান আনন্দ মিশ্রিত অনুভূতি হচ্ছিলো তা আসলে ভাষায় কোনোভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আজ আমরা সব ধরনের পিছুটান ফেলে, সন্তানদের ছেড়ে, ঘর সংসারের কথা ভুলে, সারাটা দিন নিজের মতো করে সময় কাটাবো। প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দের সাথে উপভোগ করবো। আল্লাহ যেনো আমাদের নিরাপদে রাখেন।
বাসে বসেই ব্রেকফাস্ট করতে করতে পাশাপাশি বসে সুরাইয়া, আমি, রিনা, বিজলী এতো দিনের জমানো গল্পে মেতে উঠলাম, সময় এতো দ্রæত কেটে গেলো…! কয়েকটা গান শুনতে শুনতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দারুণ পরিপাটি পিচ ঢালা রাস্তা ধরে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের নির্ধারিত স্থানে। তিনটা বাসই একই সাথে পৌঁছেছে। সবাইকে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে বরণ করা হলো। আরশিনগর পার্কে প্রবেশ করেই আমরা আমাদের জন্য সাজিয়ে রাখা স্টেজের সামনে গিয়ে বসলাম। রাহিমা ফেরদৌসী ম্যাডামের সঞ্চালনায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অতিথিদেরকে স্টেজে ডেকে নেয়া হলো। আজ এখানে উপস্থিত প্রিন্সিপাল ম্যাডাম, ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডাম, আমাদের সবার অতি প্রিয় হোসাইন স্যার এবং প্রাক্তন ছাত্রী যারা পুনর্মিলনী সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে আছেন তাঁরাই আমাদের আজকের অতিথি।
প্রত্যেকের বক্তৃতা শেষে দুপুরের খাবারের আয়োজন হলো। এতো ডিসিপ্লিনড একটা প্রোগ্রাম, যেখানে কোনো শাসন নেই, কোনো ধরনের তাড়া নেই, কাউকে লাইন করতে বলার প্রয়োজন নেই, কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো নেই, সবাই যার যার প্রয়োজন মতো খাবার নিয়ে খেতে বসলেন। ছয় জন লোক খাবার ডিস্ট্রিবিউট করে দিচ্ছিলেন। পানি, কোক স্প্রাইট ঢেলে দিচ্ছিলেন অন্য দু’জন।
অত্যন্ত সুশৃংখল ভাবে খাওয়া-দাওয়া শেষে শুরু হলো স্মৃতিচারণ, সবাই সুন্দর সুন্দর স্মৃতিগুলো তুলে ধরলেন, মুখরিত জীবনের চলার মাঝেও কলেজের স্মৃতিগুলো সবার হৃদয়ে তরতাজা। সবাই কথার মালা সাজিয়ে মনের মাঝে যত স্মৃতি আছে সব শেয়ার করে যাচ্ছেন। প্রাক্তন ছাত্রীদেরই অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও চলছিলো। সুরের মূর্ছনায় ছন্দের ঝংকারে সবাই নাচ-গানে ব্যাকুল হলো। অভিনয়ও ছিলো চমৎকার আয়োজন। পাশাপাশি চলছে দলে দলে ছবি তোলা। আজ এখানে কেউ বড় নেই কেউ ছোট নেই, সবাই সবার বন্ধু, সবাই সবার আপন, সবাই সবার প্রিয়জন। যখন আমি বাংলা সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছিলাম তখন বর্তমান প্রিন্সিপাল তাহমিনা আক্তার নূর ম্যাডাম (বাংলা) আর ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর সালমা রহমান ম্যাডাম (অর্থনীতি) দুজনই ছিলেন প্রভাষক। তারা দুজনেই বর্তমানে কলেজের কর্তধার। শ্রদ্ধেয় এই দু’জন মানুষ যেনো এক বৃন্তে ফুটে থাকা দুটি ফুল। সবাইকে আপন করে কাছে টেনে রাখার অদম্য সম্মোহনী শক্তি আছে দুজনেরই। প্রত্যেক ছাত্রী তাদেরকে এতো ভালবাসে, যখনই যেখানে যাই গল্পের মাঝে তাঁদের কথাই উঠে আসে। তাহমিনা ম্যাডামের সাথে আমার হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার থেকে শুরু করে মাস্টার্স শেষ পর্ব পর্যন্ত প্রতিটা দিন উনার কাছ থেকে অনেক শিক্ষা গ্রহণ করেছি। একসাথে বহুবার বিভিন্ন শিক্ষা সফরে গিয়েছি। সব সময় উনি মায়ের স্নেহ দিয়ে আমাদের বেঁধে রাখেন। সালমা ম্যাডামের কথা বলে শেষ করা যাবে না, তিনি এ কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্রী। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, অমায়িক, স্নেহবৎসল একজন সফল শিক্ষক। এছাড়াও বর্তমানে কলেজের বাংলা বিভাগের শাহনাজ ম্যাডাম এবং রাহিমা ফেরদৌসী ম্যাডাম, সাইকোলজির নিগার সুলতানা ম্যাডাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নাসরিন জাহান ম্যাডাম, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ইশরাত জাহান ম্যাডাম, আরও কজন আছেন গেস্ট টিচার সবাই এ কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী। মোট কথা অংশগ্রহণকারী সবাই এ কলেজের সাথে এতোটাই ওত প্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এবং সবার মায়ার বন্ধন এতোটাই গভীর যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। হুসাইন স্যার – যাঁকে এক বাক্যে সবাই ভালবাসে, তিনিও সবাইকে স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছেন এতো বছর ধরে। আমরা অনেক শিক্ষা সফরে উনাকে পেয়েছি। আজ উনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে সবাই অন্যরকম খুশি হয়েছি। স্মৃতিচারণ শেষে রেফেল ড্রয়ের আয়োজন ছিলো, সাথে চলছিলো শীতের বিকেলে গরম গরম চা। ষোলটা প্রাইজ রাখা হয়েছিলো। ১৬তম বিজয়ীর নাম্বার ঘোষণার পর মিলি আপার উল­াস দেখে মনে হয়েছে উনি প্রথম হয়েছেন। এভাবে নিচের দিকে নামতে নামতে প্রথম পুরস্কার উঠে এলো মর্জিনা আপার হাতে। আসলে প্রত্যেকটা পুরস্কারের ঘোষণায় সবাই খুশি। সবাই আনন্দিত। কে পাচ্ছে কার ভাগ্যে যাচ্ছে তা কেউ দেখছি না। নাম্বার মিললে শুরু হয় চিৎকার। প্রত্যেকের কাছে মনে হচ্ছে প্রত্যেকেই পুরস্কার পাচ্ছে, ভাগ্য বিজয়ী হচ্ছে। যে আমার জীবনে কোনোদিন রেফেল ড্র কিংবা লটারিতে নাম ওঠেনি সে আমারও দুই দুইটা পুরস্কার পাওয়ার ভাগ্য নির্ধারিত হলো। এতো মন খোলা অনুষ্ঠান আমি কখনো পাইনি। প্রত্যেক অনুষ্ঠানে কোনো না কোনো অভিযোগ আসে, অভিমান করে অনেকেই কিংবা অনেক সময় সমালোচনায়ও পড়তে হয়। কিন্তু আজ এই আয়োজন অভিযোগহীন অনুযোগহীন, ভালোলাগা, ভালোবাসায় ভরপুর। এরপর শুরু হলো নাচে গানে উল্লাস থেকে উল্লসিত হওয়ার পালা। যে গাইতে পারে, যে গাইতে জানেনা প্রত্যেকেই মাইক্রোফোন হাতে গান ধরেছে। এখানে থামানোর কেউ নেই, থামার কেউ নেই। এখানে কোনো অভিভাবক নেই, কোনো অবাধ্য সন্তান নেই, এখানে নিষেধ করার কেউ নেই, এখানে হিংসে করার কেউ নেই, এখানে যারা ছোটোবেলার মতো আনন্দে মেতে উঠেছে তারা প্রত্যেকেই বর্তমানে বিভিন্ন পদে সু-প্রতিষ্ঠিত! মুহূর্তেই সময় গুলো যেনো শেষ হয়ে যাচ্ছিলো….! এতো বড় আরশিনগর ফিউচার পার্কে ঘুরে দেখার মতো সময় আমাদের কারোরই নেই। আমরা সবাই সারাক্ষণ মাতোয়ারা হয়েছিলাম নিজেদেরকে নিয়ে। পরিবারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কেউ বাসা থেকে ফোন করলে রিসিভ করেছি শুধু। নিজ থেকে একটা কলও করিনি কোথাও। এমন একটি নির্মল ভালো পরিপাটি আনন্দের দিন এতো দ্রæত শেষ হয়ে গেলো! স্টেজের ওখান থেকে পার্কের গেইট পর্যন্ত আসতে আসতে যে যেভাবে পারি ছবি উঠিয়ে নিচ্ছিলাম। কার ক্যামেরায় ছবি কে উঠাচ্ছে তা দেখার প্রয়োজন নেই, সিনিয়র-জুনিয়র, আমার দল তোমার দল দেখারও প্রয়োজন নেই, সময় শেষ হয়ে আসছে যত দ্রæত পারা যায় সবাই স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টায় পাগলের মতো মত্ত ছিলাম।
মনে হচ্ছিলো, এ সময় যদি না ফুরাতো! এ দিন যদি শেষ না হতো! আজ ফিরে না গেলে কি হতো না! আহারে সময়! আজ এত দ্রæত কেটে গেলো! ফিরে আসার পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত এই আনন্দের রেশ কাটেনি কারো। ছবি বিনিময়, ভালোবাসাময় মেসেজ আদান-প্রদান চলেছে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের। প্রাক্তন ছাত্রী পরিষদের পুনর্মিলনীতে প্রত্যেক শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা সকলেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানকে এতো সুন্দর করে সাজিয়েছেন। একটা বিষয় খুবই শিক্ষনীয়, যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধান অতিথি হন; আলোকিত করে রাখেন স্টেজ, যাদের দ্বারা পরিপূর্ণতা পায় অনুষ্ঠান, সেরকম আলোকিত মানুষ যখন নিজেদের মধ্যেই থাকে, তখন বাইরের কোনো মানুষকে মোটেও অতিথি করে আনার প্রয়োজন পড়েনা। আমাদের আলোকিত মানুষ, আমাদের প্রাক্তন শ্রদ্ধেয় মানুষেরাই আয়োজনকে আলোকিত করে রেখেছিলেন পুরোটা সময়। আমরা চাই এরকম আনন্দঘন সময় বারে বারে ফিরে আসুক। তাইতো বলি,
‘অভিযোগহীন আনুযোগহীন,
নির্মল আনন্দের একটি স্মরণীয় দিন…
…অতি শীঘ্রই আবারো হোক আয়োজন,
এমনতর দিন আমাদের অতি প্রয়োজন।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক