স্মৃতিতে অলিয়ে সম্রাট শাহ্ আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল- কুতুবী (রহ.)

1337

উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ,কুতুব শরীফ দরবারের পীর, গাউসে মোখতার হযরতুল আল্লামা শাহ আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল-কুতুবী (রা.)১৯তম বার্ষিক ওরস ও ফাতেহা শরীফ আজ(১৯-০২-২০১৯ইং)। তিনি ১৯১১ সালে কক্সবাজার জেলাস্থ পূণ্যভূমি, পর্যটন শিল্পে ঘেরা কুতুবদিয়া দ্বিপের বিখ্যাত এক হাফেজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ২০০০ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি লক্ষ ভক্ত রেখে ইহকাল ছেড়ে পরকালে গমন করেছেন। প্রতিবছর ৭ফাল্গুন ১৯ ফেব্রুয়ারী লাখ কোটি ভক্ত, আশেকানদের অংশ গ্রহনে মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে কুতুবদিয়া দ্বীপে ‘কুতুব শরীফ’ এ দরবারে।
আধ্যাত্মিকতা : তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ক্ষমতাবলে মানুষের মনের খবর জানতে পারতেন।যখনই কোন আশেক বিপদে পড়ত তিনি সাথে সাথে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে দোয়া করতেন। সাথে সাথে বিপদ থেকে রক্ষা পেতেন । “আল্লাহর কোন বান্দার যখন তাঁর প্রেমে মশগুল হয়ে যায় তখন বান্দা তার মুখ দিয়ে যাহা বলে তাহা সাথে সাথে হয়ে যায়” কেননা হাদিসে কুদসী অনুযায়ী ঐ প্রিয় বান্দাহর মুখ আল্লাহর মুখে পরিনত হয়ে যায়। হয়ত এ জন্যই হযরত আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল-কুতুবী(রাঃ)যখন যা বলতেন তখন তা হয়ে যেত। চট্টগ্রাম হালিশহরের দরবারের পীর হযরতুল আল্লাম হাফেজ মুনির সাহেব (রাঃ) বলেছিলেন, তোমরা আবদুল মালেক মহিউদ্দিন (মালেক শাহ) এর কাছে যেতে একটু সম্মানের সাথে যেও তার হাকিকত ও তরীকতের প্রখরতা অনেক। তিনি মজযুব, আল্লাহ মহান আধ্যাত্মিক সাধক হিসাবে তাকে কবুল করেছেন। অবশ্যই দুজনই একই তরিকতের একই ছিলছিলার বায়েত ছিলেন বলে জানা যায়।
আলৌকিক ঘটনা : হযরত আবদুল মালেক মহিউদ্দিন কুতুবী অলৌকিক ঘটনা অসংখ্যা মানুষের মুখে মুখে শুনতাম যখন ছোট্টজীবনে আমার পদার্পন কুতুব দরবার শরীফে। কথিত আছে, চট্টগ্রাম শহর থেকে এক ভদ্র লোক মহান এক সমস্যা নিয়ে কুতুব শরীফদরবারে যান, এ ভদ্র লোককে কোনভাবে শহরে আসতে দিচ্ছে না কুতুব শরীফ দরবারের পীর আল্লামা হযরত আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আলকুতুবী (রাঃ)। (নানাজান) হঠাৎ করে রাত বারটার এজাযত (অনুমতি) দিলেন তাকে হঠাৎ চলে যাওয়ার জন্য। গো বেচারা চিন্তা করলে এত রাতে কিভাবে পার হবে কুতুবদিয়া দ্বীপ থেকে। তখন কুতুবদিয়া থেকে পারাপারে রাত্রে কোন নৌযান কিংবা কোন বাহন ছিল না। কিন্তু এ ভদ্রলোক পরিবারকে নিয়ে এ রাতে কুতুবদিয়া ঘাটে আসলেন। তখন দেখা গেল এক নৌকার (নৌযান) মাঝি বলতে লাগল চট্টগ্রাম শহরে কে যাবেন আসেন। ভদ্রলোক নৌকায় উঠলেন এবং সকাল হতে না হতে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছে গেলেন। যে সমস্যা নিয়ে এ ভদ্র লোক কুতুব শরীফ দরবারে গিয়েছিলেন তা তো মুশকিল আহসান হয়েছেন বরং ঐ দিন সকালে তা পরিবারে ঘটে যাওয়া আরো একটি মহাসমস্যা থেকে মুক্তি পেলেন। এ ধরনের অসংখ্যা অলৌকিক ঘটনা কথিত আছে কুতুব শরীফ দরবারের। যা লিখনি দিয়ে শেষ করা যাবে না। অপর এক অলৌকিক ঘটনা, তৎকালীন সময়ে হযরতুল আল্লামা শাহ আবদুল মালেন আল-কুতুবী(রাঃ) এর সান্নিধ্যে নিয়মিত আসতেন কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার বরইতলীর খতিবে আজম নামে খ্যাত ও হযরতুল আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ (রাঃ)। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে যে ,তাকে হযরত শাহ সুফি আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল কুতুবী (রাঃ) খুবই সম্মান করতেন। একবার তাঁকে শাহ আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল কুতুবী (রাঃ) একজোড়া জুতা উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ জুতা হযরত মালেক শাহ (রাঃ) কে কোন ভক্ত উপহার দিয়েছিলেন। এ জুতার নাম্বার ছিল ৫ এবং খতিবে আজমের জুতার নাম্বার ছিল ৮। খতিবে আজমের পায়ে এ জুতা স্বভাবত হবে না মনে করে নিতে অস্বীকৃতি ভাব। এমতাবস্থয় হযরত শাহ আবদুল মালেক (রাঃ) তাঁকে ধমক দিয়ে জোর করে ঐ জুতা জোড়া পরিধান করিয়েছিলেন। দেখা গেল অলৌকিকভাবে এ জুতা বরাবরই হয়ে গেল। আসলে তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মানুষের মনের কথা জানতে পারতেন। আল্লাহর কাছে ধ্যানে যা চাইতেন তা সম্ভব করতে পারতেন। এটাই একটা অলৌকিক কেরামত। অপর অন্য অলৌকিক ঘটনা হলো, চট্টগ্রামের মিরসরাই নিজামপুর কলেজের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম কবির কল্যাণকর কাজের জন্য কুতুব শরীফ দরবারের নামে একটি ছাগল মানত করেছিলেন। অলৌকিকভাবে তার এ কাজ সফল হয়ে যায়। মানত অনুযায়ী ছাগল নিয়ে কুতুবদিয়ার কুতুব শরীফ দরবারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তার চিন্তা ছিল কিভাবে ছাগলটা ঐ দরবারে নেবে। অধ্যাপক মো. গোলাম কবির ও অধ্যাপক চঞ্চল সরকার মানতের ছাগলটি নিয়ে চকরিয়া বর্তমানে পেকুয়া থানার মগনামা ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন, তাদের ভাষ্য মতে ,হঠাৎ করে লুঙ্গী পড়া এক ভদ্র লোক স্বপ্নের কথা বলে তাদের কে জানান, মালেক সাহেব হুজুর আমাকে বলছেন চট্টগ্রাম শহর থেকে দুই জন লোক একটি ছাগল নিয়ে মগনামা ঘাটে এসেছে তুমি তাদেরকে দরবারে নিয়ে এস। তারপর তারা ছাগলটা সহ ঐ ভদ্রলোকের সাথে কুতুব শরীফ দরবারে পৌঁছে যান। কিছুক্ষণ পর অলৌকিকভাবে কোথায় চলে যায় তাদের বুঝে উঠার আগেই। এভাবে হাজারে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল হযরতের জীবনে যা লিখে শেষ করা যাবে না।
আধ্যাত্মিক জীবনে হযরত মালেক শাহ (রাঃ) নানাজান ঃ হযরত শাহ আবদুল মালেক আল কুতুবী (রাঃ) সম্পূর্ণ জীবটাই ছিল অলৌকিক ঘটনাবলীতে ভরপুর শুধু তাই নয়, চালচলন ছিল স্বাভাবিক জীবনের মত। জীবনে খাওয়া, দাওয়া, চাওয়া, পাওয়ার তেমন কিছু ছিল না, নিজে আল্লাহ তায়ালার জিকিরে মগ্ন থাকতেন বিধায় অনেক বেল তিনি আহার করতেন না । আহার করলেও কখন করেছে তা কেউ তেমন দেখননি। কিন্তু তার কাছে আসা লোকদেরকে তিনি পেট ভরে খাওয়াতেন। তিনি সীমাহীন দায়ালু ও অতিথিপরায়ন ছিলেন। তামাকের হুক্কা ছিল হযরতুল আল্লামা শাহ আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল কুতুবী (রাঃ) নানাজানের প্রিয় নয় শীত নয় গরম কাল একটি হাফ হাতা গেঞ্জি নিয়ে তিনি মহান আল্লাহ তালার ধ্যানে মশগুল থাকতেন। শৈশব জীবন থেকে হযরত শাহসুফি আল্লামা আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল কুতুবী (রাঃ) (নানাজান কেবলা) কে যে অবস্থায় দেখায় সৌভাগ্য হয়েছে, তার এক চুম্বুকে বর্ণনা করলে দেখা যায়, কখন কি করেছেন তা কেউ দেখেন না। কিন্তু যা বলত তাই ঘটে যেত। আরাম ভোগ-বিলাস পছন্দ করতেন না। তার বৈঠক খানায় একটা বেতের পাটি, বেতের চেয়ার ছিল মাত্র। হুজারা খানায় আল্লাহর ধ্যানে মসগুল থাকতেন। শৈশবে দেখা হযরত শাহসুফি আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আল কুতুবী (রাঃ) (নানাজান কেবলা) খুব কম পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতেন। এমনকি দিনের বেলায় অনেক সময় কোন খাদ্যও গ্রহণ করতেন না। তার প্রিয় জিনিস ছিল ‘হুক্কা’ খাওয়া। হুক্কা হচ্ছে সিসার একটি পাত্র। যেটার নিচের অংশের পানি উপরের অংশে একটি মাটির কিংবা দস্তার একটি পাত্র থাকে গ্রামীন ভাষায় ‘কলকি’ বলা হয়। পানির উপরিভাগে নল দিয়ে সামান্য সামান্য করে ধোঁয়ার স্বাদ নিতেন। নানাজান কেবলা আধ্যাত্মিক জীবনের শুরু থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত দিনের পর দিন মাসের পর মাস অনেক ক্ষেত্রেই অনাহারে থাকতেন। সাধনায় এমন মশগুল থাকতেন খাদ্য গ্রহণের সময়টা এমনি এমনিতে চলে যেত। তিনি ঘুমাতেন কম। তিনি নিজে ছিলেন ত্যাগী, সারা জীবনই ত্যাগ ও সাধনায় কাটিয়েছেন। বলতে গেলে নানাজান কেবলার জীবনটাই ছিল ‘তাওয়াক্কালতু, আল্লাহ উপর। তিনি ভবিষ্যতের জন্য জমা করার চিন্তা করতেন না। বরং অকারতে দান করে যেতেন। দরবারে আসা মানুষদের আতিথেয়তার খুব বেশি খুশি হতেন। তার সান্নিধ্যে যে যেতে পেরেছে সে কিছু না কিছু পেয়েছেন। নানাজান কেবলা অকাতরে দান করতেন কিন্তু এত অর্থ কোত্থেকে আসত আল্লাহ মালুম। শৈশব জীবনে বহুগুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। খোদাভীরুতা তো ছিলই, তাছাড়া সহনশীলতা, সততা, পরোপকারীতা, উদারতা, দানশীলতাসহ এ গুণাবলী নজর কাড়ার মত।
কুতুব শরীফ দরবারের অবস্থান ঃ কুতুব শরীফ দরবার কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপে অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর ও কক্সবাজার সদর থেকে বাইরোডে অত্যন্ত সহজেই এ দরবারে যাওয়া যায়।উল্লেখ্য যে,১৯৬০ সালে প্রলয়ংকরী ঘুর্নিঝড়ের পর আল্লামা হযরত আবদুল মালেক মহিউদ্দিন আলকুতুবী (রাঃ) কুতুবদিয়ার নিজ বাড়িতে কুতুব শরীফ দরবার প্রতিষ্ঠা করেন।
লেখক : আইনজীবী ও সাংবাদিক