স্মরণ : হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ্ (র.)

99

আমাদের চট্টগ্রামে, একদিকে যেমন বহু অলীয়ে কামেলের আগমন ঘটেছে অন্যদিকে বহু অলীয়ে কামেলের জন্মস্থান এই চট্টগ্রামে মাইজভান্ডারী তরিকার মহান প্রবর্তক, অলীকূল শিরোমনি আওলাদে রাসূল শাহসূফী সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ্ শাহ্ মাইজভান্ডারী (ক.) এর কথা জানে না এমন মানুষ বাংলাদেশে খুব কমই আছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় জন্ম নিলেও এই মহান সূফীসাধকের পরিচয় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমধিক ব্যাপৃত। দিন আর রাতের তফাৎ ভুলে গিয়ে যে মুহূর্তে ছুটে এসে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর প্রেম সাগরে ডুব দিয়ে নিজেকে ধন্য করেন আশেক ভক্তবৃন্দ। পাশাপাশি আরেকজন আধ্যাত্মিক সাধক যার এশকে রাসূল সুন্নী জনতার কাছে কালের সাক্ষী হয়ে আছেন। তিনি হলেন ফানা ফির-রাসূল হযরতুল আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা (র.) হাটহাজারী উপজেলায় এই মহান অলী তাঁর পবিত্র মাজারে শুয়ে আরাম করছেন। চট্টগ্রামের পুরনো ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে একথা প্রতীয়মান হয় যে, চট্টগ্রামের কমবেশি প্রতিটি অঞ্চলে যুগে যুগে অনেক অলী সাধক জন্ম নিয়েছেন। এ সমস্ত অলীরা নিজেদের আধ্যাত্মিকতার পরশে ধন্য করেছেন নিজ এলাকার মানুষকে। কখনো বা তাদের আধ্যাত্মিকতার পরশ ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশব্যাপি। চট্টগ্রামের বুকে জন্ম নেয়া এমন এক অলীয়ে কামেল, মহান আধ্যাত্মিক সাধক হচ্ছেন কুতুবুল আকতার শাহসুফী হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ (র.)। আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে আনুমানিক ১৮৪৭ সালে চট্টগ্রাম হাটহাজারী থানাধীন ফতেয়াবাদের খাগড়িয়া ছড়ারকূল থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে প্রসিদ্ধ চৌধুরী বাড়ীতে এই মহান সাধকের জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন ঐতিহাসিক চৌধুরী পরিবারের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব রজু চৌধুরী। এলাকার প্রবীণতম মুরুব্বীদের মারফত জানা যায়। একই এলাকায় মুহতারাম জনাব রজু চৌধুরীর ওয়ারিশ তিনজন পুত্র সন্তান গ্রহণ করেন।
১. হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ (র.) ২, হযরত গরীব উল্লাহ শাহ (র.) ৩, হযরত তুফান আলী শাহ (র.), জানা যায় হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ (র.) এর পরিবারে ধর্মীয় আবধারার উপর পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ ও মারেফাতে ইলাহী, অদম্য বাসনা হযরত দায়েম উদ্দিন শাহ্ (র.) এর জীবনে যথার্থ বাস্তবায়ন ছিল। শৈশবকাল থেকে হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ্ (র.) এর পরহেজগারিতা নিস্বার্থপরায়নতা পরোপকারিতা ইবাদতের প্রতি যতœশীল মনোভাব আর-শিষ্টাচারিতা ইবাদতের এই মহান অলীর ভাবী-বেলায়তের কথা প্রকাশ করে দিয়েছিল। এই মহান সাধকের বাল্যকাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও দেখা যায় পেশাগত জীবনে তিনি প্রথমে মায়ানমারের তৎকালীন রেঙ্গুন শহরে ডাক-বিভাগে চাকুরী করতেন। মহান আল্লাহর পরম ইচ্ছায় তিনি রেঙ্গুন ত্যাগ করে খেদমতে আনজাম দেয়ার জন্য নিজ দেশে ফিরে আসেন, দেশে ফিরে তিনি দক্ষিণ মাদার্শা সিকদার পাড়া নবাব চাঁদ মিয়া মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। ইমামতির পাশাপাশি মহান আধ্যাত্মিক সাধনায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। সাংসারিক জীবনে এই মহান অলি তিনি পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। সুন্নাত রাসুলাল্লাহর উপর প্রতিষ্ঠিত এই মহান অলী থেকে ধীরে ধীরে বহু কারামতি প্রকাশ পেতে থাকে। দূরদূরান্ত থেকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশষে সর্বস্তরের মানুষ তার সাহচর্য লাভে ধন্য হত। বেলায়তী শক্তির নূরানী পরশে সিক্ত হয়ে অদৃশ্য এক সুত্রায় একীভূত হয়ে ছুটে আসত এই মহান অলীর দরবারে, ইতিহাসের যথাযত সংরক্ষণের অভাবে এই মহান অলীর কথা ঘটনা ও কারামতি কালের অতল গহŸরে তলিয়ে গেছে। শতাধিক বছর আগের এসব অলৌকিক কারামতি ধারক বাহক সাক্ষী ব্যক্তিরাও আজ পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। স্থানীয় মান্যবর মুরুব্বী হাজী আবু বকর ডিলার সূত্রে জানা যায় একবার একলোক মান্নাত করে যে তার ফলবান কাঁঠাল গাছের সবচেয়ে বড় কাঁঠালটি হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ (র.) এর দরবারে হাদীয়া দিবেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্ত্রীর কথায় বিভ্রান্ত হয়ে তুলনামূলক ছোট একটা কাঠাল হুজুরের দরবারে নিয়ে আসে। লোকটি দরবারে পৌঁছার সাথে সাথে হুজুর বলে উঠলেন- আমি ছোট কাঁঠাল খাব না। বড় কাঁঠাল খাব। যাও এই কাঁঠালটা পুকুরে পুঁতে দিয়ে আসো, এতে লোকটি বর্তমানের রজু পুকুরে কাঠালটি পুঁতে দিল। তার আফসোসের সীমা থাকল না। পরবর্তী বছর তিনি নিয়ত পরিশুদ্ধ করে গাছের সবচেয়ে বড় কাঁঠাল নিয়ে হুজুরের দরবারে হাজির হলে হুজুর বললো যাও। গত বছরের পুঁতে রাখা কাঁঠাল তুলে নিয়ে আসো। কী আশ্চর্য লোকটি পুকুরে গিয়ে আগের কাঁঠালটি অক্ষত অবস্থায় পেলেন। দু’টো কাঁঠালকে একসাথে করে সবাইকে নিয়ে হুজুর, কাঠাল ভক্ষণ করলেন (সুবহানাল্লাহ)। সময়টা তখন ১৯১০ ইং, হুজুরের বয়স তখন ৬৩ বছর। কে জানতো ৬৩ বছরে জিন্দেগী করে ইহকাল থেকে তিনি সফর করবেন। সে বছর ২৮ মাঘ এই মহান আশেকে রাসূল, নায়েবে মোস্তাফা তার অসংখ্য ভক্ত অনুরক্তকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পাড়ি জমালেন মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে। তার পবিত্র আস্তানা শরীফের পাশেই ব্যথাহত হৃদয়ে শোকভাবে আনত ভক্তকুল পরমাদরে মাজারে পাকে শুইয়ে দেন তাঁকে। হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ (র.) এর পাশে শুইয়ে আছেন আরেক মহান অলীয়ে কামেল হযরত বশীর উল্লাহ শাহ (র.)। হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ (র.) এর মেঝভাই হযরত গরীব উল্লাহ শাহ (র.) এর সুযোগ্য পুত্র ছিলেন এই মহান অলী হযরত বশীর উল্লাহ শাহ (র.) তিনি আনুমানিক ১৮৭৯ সালে এই অলী একই এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা হযরত গরীব উল্লাহ শাহ (র.) একজন বড় মাপের অলী ছিলেন। ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকা বার্মায় তিনি ইসলাম প্রচার কার্য চালিয়ে যান। তিনি বার্মায়
আমৃত্যু ইসলাম প্রচার করেন, এক পর্যায়ে তিনি সেখানেই শেষনিঃশাস ত্যাগ করেন এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান হযরত বশীর উল্লাহ শাহ (র.) একজন মহান আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। তরিকতের মহান সাধক এই অলীয়ে কামেল ১৯৪১ সালের কোন একদিনক্ষণে অজস্র ভক্তবৃন্দকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরজগতে গমন করেন।
এলাকাবাসীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতি বছর বাংলা সন অনুযায়ী ২৮ মাঘ হযরত দায়েম উদ্দীন শাহ (র.) ও ২৮ ভাদ্র হযরত বশীর উল্লাহ শাহ (র.) এই দরবার শরীফে বেশভাব গাম্ভীর্যের সাথে মহান ওরশ শরীফ পালিত হয়।

লেখক : সহকারী শিক্ষক
বুড়িশ্চর জিয়াউল উলুম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা।