স্মরণের জানালায় বিচারক ও দানবীর ছালেহ আহমদ চৌধুরী

53

চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের তৎকালিন জুরী বোর্ডের জুরার (বিচারক), শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এয়াকুবিয়া দাখিল মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) উচ্চ বিদ্যালয়ের আজীবন দাতা সদস্য এবং বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দাতা আনোয়ারা উপজেলার অন্যতম কৃতিপুরুষ মরহুম আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার অন্তর্গত বটতলী গ্রামে ও প্রসিদ্ধ সাধক হযরত শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এর পুণ্যভূমিতে ১৯১৯ ইংরেজি সালের ২৭ মে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন মরহুম আবদুল আজিজ চৌধুরী এবং চাচা ছিলেন মরহুম আলহাজ্ব এয়াকুব আলী চৌধুরী।
মরহুমের পিতামহ মরহুম আছদ আলী চৌধুরী দোভাষী একজন স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তৎকালিন বার্মার সাথে ব্যবসা করতেন। আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ক্রীড়া সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং একজন স্বনামধন্য ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। জনাব চৌধুরী অত্যন্ত ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের তৎকালিন জুরি বোর্ডের জুরার (বিচারক) এর দায়িত্ব পালন করেন এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মভীরু ও ন্যায় বিচারক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। এছাড়া তিনি একজন দক্ষ বিচারক হিসেবে সকলের কাছে সমাদৃত ছিলেন। তিনি কোনদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। তার কাছে বিচারপ্রার্থী জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হননি।
মরহুম আছদ আলী চৌধুরী দোভাষী ২২ জুলাই ১৯০৭ ইংরেজি হতে আমরণ বটতলী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্বে ছিলেন। আছদ আলী চৌধুরীর মৃত্যুতে তার জ্যেষ্ঠপুত্র অথ্যাৎ মরহুমের পিতা আবদুল আজিজ চৌধুরী ১৯২৪ ইংরেজি সনে বটতলী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে ও জুরি বোর্ডের সদস্য পদে আসীন হন। শিক্ষায় অনগ্রসর এলাকাকে আলোকিত করার লক্ষ্যে মরহুম আবদুল আজিজ চৌধুরী নিজ অর্থায়নে ও জমিতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯১৬ ইংরেজি সালে বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এম, ই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার পিতা আবদুল আজিজ চৌধুরী ও চাচা এয়াকুব আলী চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এম.ই বিদ্যালয়কে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯৪৮ ইংরেজি সালে নি¤œ মাধ্যমিক ও ১৯৫৪ ইংরেজি সালে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন।
জনাব চৌধুরী একজন উক্ত বিদ্যালয়ের আজীবন দাতা। মরহুমের পিতা আবদুল আজিজ চৌধুরী বিভিন্ন ১৯৩৫ ইংরেজি সালের ১১ নভেম্বর তিনি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মহিলা ওর্য়াড নির্মাণ করার নিমিত্তে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদান করেন। তিনি বিভিন্ন অবদান রাখায় ১৯৩৭ ইংরেজি সালে তৎকালিন ইজওঞওঝঐ সরকার কর্তৃক স্বর্ণপদকে ভূষিত হন এবং এড়া.ড়ভ ইধহমধষ সরকার কর্তৃক একাধিক সনদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যার স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালিন সরকার আবদুল আজিজ চৌধুরী ডি,সি সড়ক (বটতলী-বৈরাগ) হিসেবে নামকরণ করেছে। তিনি ২১ জানুয়ারি ১৯৪৫ ইংরেজিতে পরলোক গমন করলে পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আবদুল আজিজ চৌধুরীর অনুজ এবং মরহুমের চাচা আলহাজ্ব এয়াকুব আলী চৌধুরী ১৯৪৫ ইংরেজিতে বটতলী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনিও চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের তৎকালিন জুরি বোর্ডের জুরার (বিচারক) এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তীতে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৬ বৎসর কাল বটতলী ইউ.পি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
মরহুম আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী একজন দানবীর ছিলেন। তিনি দান করতেন অত্যন্ত নিরবে ও নিভৃতে। জনাব চৌধুরী অত্র এলাকার সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষার অভাব অনুভব করায় মহৎ উদ্যেশে তিনি ১৯৭৬ ইংরেজি সালে প্রতিষ্ঠা করেন শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এয়াকুবিয়া দাখিল মাদরাসা এবং উক্ত মাদ্রাসার জন্য নিজস্ব জমি দান করেন বিশিষ্ট দানবীর মরহুম ছালেহ আহমদ চৌধুরী। এই আলোকবর্তিকা উক্ত মাদরাসা পরিচালনা কমিটির প্রথম সভাপতি পদে ছিলেন। তিনি অত্র মাদরাসার জন্য আর্থিকভাবে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেন। যা আজ শিক্ষায় ও ঐতিহ্যে আনোয়ারা উপজেলার শ্রেষ্ঠ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ছালেহ আহমদ চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য ব্যক্তিগত চল্লিশ শতক জমি, হলিদর পাড়া জামে মসজিদ নির্মাণে নিজস্ব জমি ও অর্থায়ন করেন এবং বটতলীতে পল্লী বিদ্যুৎ সাব স্টেশনের জন্য নিজ জমি দিয়ে অনন্য অবদান রাখেন। ধর্মভীরু আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী হযরত শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) মাজার শরীফের প্রধান তোরণের জন্য তিনি পরিবারিক জমি দান করেন।
মরহুমের পিতামহ মরহুম আছদ আলী চৌধুরী দোভাষী মাজার শরীফের প্রধান ফটকের পূর্ব পার্শ্বে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। বটতলী শাহ্ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) জামে মসজিদ, রুস্তম হাট জামে মসজিদ সংস্কার করেন। বটতলী হলিদর পাড়া জামে মসজিদ নির্মাণে নিজস্ব জমিও অর্থায়ন করেন। বটতলী রুস্তম হাট উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মরহুম আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী, তার পিতা আবদুল আজিজ চৌধুরী ও চাচা এয়াকুব আলী চৌধুরী নিজস্ব জমি দান করেন। তৎকালে যানবাহন তেমন ছিল না। পদব্রজে মানুষ বিভিন্ন স্থানে চলাফেরা করতো। তাই ক্লান্ত পথচারিদের বিশ্রাম ও একটু সুশীতল ছায়ার জন্য তিনি গ্রাম্য মেটোপথের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণস্থানে বৃক্ষ রোপণ করতেন মানবপ্রেমি ছালেহ আহমদ চৌধুরী। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালিন সরকার বটতলীতে “আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী সড়ক” নামকরণ করেন। শিক্ষা, ধর্মীয় ও জনকল্যাণ কার্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অনন্য অবদান রাখেন।
আলোকিত ব্যক্তি ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী ২০০৩ সালের ০২ ডিসেম্বর ৮৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তার স্মরণাতীত কালের বিশাল এ জানাজায় পাঁচ/দশ সহ¯্রাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল। তাকে যে সর্বস্তরের মানুষ ভালোবাসতো এ জানাজার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছিল। মানুষ সেদিন এ গুণী মুরুব্বীকে হারিয়ে শোকার্ত হয়ে পড়েছিল।
সর্বজনবিদিত আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সকলে তাকে শ্রদ্ধা করতেন। প্রচারবিমুখ ও অত্যন্ত নিভৃতচারি আলহাজ্ব ছালেহ আহমদ চৌধুরী ছিলেন একজন সৎ, ধর্মভীরু, নির্লোভ, নিরাহংকার ও আদর্শবান পুরুষ। কখনো তিনি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। আজীবন তিনি মানবসেবা করে গেছেন। নির্লোভী জনাব চৌধুরী গরিব, দুঃখী, অসহায় ও অবহেলিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তি শৈশবকালে তিনি নিজম্ব ঘোড়া নিয়ে চলাফেরা করলেও সর্বদা অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। মরহুম ১৯৮৮ সালে পবিত্র হজ্বব্রত পালন শেষে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তিনি নিজ গৃহে সর্বদা নামাজ আদায়, কোরআন তেলোয়াত এবং এবাদত বন্দেগিতে ব্যস্ত সময় পার করতেন। তার মতো একজন গুণীব্যক্তি বর্তমানে বিরল। মরহুম স্বীয় কর্মগুণে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তরে।

লেখক : কলামিস্ট, গবেষক, রাজনীতিক