স্বাধীনতার কিংবদন্তি মহসিন খাঁন ও সিএমএইচ সমাচার

46

মোঃ নাজিম উদ্দীন

১৫,আগস্ট’৭৫ পরবর্তী ত্রাতাহীন বাংলাদেশ এর দৃশ্যপট সকলের জানা। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী’র দায়িত্ব ভার যখন দেওয়া হয়েছিলো, তখন ডুঁকরে কেঁদে উঠে আত্মাহুতি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, এই সেই মহসিন খাঁনরাই ! জাতির পিতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নয় বরং সমূলে নির্বংশ করবার আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে সহ্য না করতে পেরে, যারা দক্ষিণ চট্টগ্রামকে সর্বাত্মক অচল করে দিয়ে শোকের মাতম বয়ে দিয়ার মুখ্য ভূমিকা পালন করে প্রতি শোধের দ্বাহকে বেগবান করবার প্রাণপন লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অকুতোভয় নেতা মহসিন খাঁন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
পিতা হত্যার পর সামরিক জান্তা কর্তৃক দেশ যখন কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিলো, বাড়ি ঘরে হামলা-মামলা, নৃশংসতা বর্বরতার শিকারের অসহ্য প্রহসনে টিকতে না পেরে বনে-বাদারে, খালে-বিলে, নদীর তীরে স্বপরিবারে আত্মগোপনে রাতের পর রাত খড়-খুঁটো খেয়ে আলোর প্রহর গুনছিলেন মহসিন খাঁনেরা’ই। অগণিত সহযোদ্ধার রণাঙ্গনের মৃত্যু যন্ত্রণার অন্তর্দহনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমৃত্যু বাকরুদ্ধ হয়েছেন মহসিন খাঁনেরাই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রক্তে কেনা স্বাধীনতার লাল সূর্যটি উদিত করেছিলেন মহসিন খাঁনরা’ই। ১৬,ডিসেম্বর’১৯৭১ তারিখে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত মানুষের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও, পটিয়া থানা কম্পাউন্ডের মধ্যে থেকে ১৩ ডিসেম্বর’১৯৭১ তারিখে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে বিশ্ববাসীর সামনে উদয়ের হাসি ফুটিয়ে ছিলেন মহসিন খাঁনেরই মূল নেতৃত্বে।
বীর পটিয়ার মাননীয় সাংসদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ, আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজনেষু জনাব শামছুল হক চৌধুরী ঢাকায় অবস্থান করলেও, জাতীয় নেতা মোঃ নাসিম এর অন্তিম বিদায়ী শোকে বিমর্ষ থাকায়, তিনি গুলশান সিকদার হাসপাতালে এক নজর দেখতে যেতে না পেরে মর্মে আহত হয়ে বেদনাবিধুর এক শোকবার্তায় প্রকাশ করেন যে, ‘পটিয়ার স্বনামধন্য আমার প্রিয়ব্যক্তিত্ব, মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধকালীন কমান্ডার, পটিয়া উপজেলার প্রথম ও ২য় বারের নির্বাচিত সুযোগ্য চেয়ারম্যান, পটিয়ার মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা, জঙ্গলখাইন ইউনিয়ন কৃষি স্কুল এন্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মহসিন খাঁন এর ইন্তেকালে, আমি একজন নিষ্ঠাবান সৎ উপদেশ প্রদানকারীকে হারালাম।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, রণাঙ্গনের নিপীড়িত ও পরীক্ষিত সৈনিক, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও প্রবীণ সাংবাদিক জনাব নাসির উদ্দিন চৌধুরী’র ফেইসবুক স্ট্যটাসে তাৎক্ষণিক শোক প্রকাশ করে লিখেন, “He contacted with Shahjahan islamabadi, Sergeant alam, Captain karim, Shamshuddin, Ahmed sharif monir, Ahmed nabi, Hafez ahmedul hoque, Nurul islam and many other leading freedom fighter. He was my relative and I worked with him. He recruited many youths to his group, thus his group became a vast group. He took leading part in jiri madrasha operation, Anwara thana operation and he hoisted Swadhinatar flag at patiya police station. Abu syed group and Shah alam group also there. Mohsin will be remembered for his heroic role in our liberation war”.!

১৯৬৭ সালে স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ এর আইএসসির ছাত্র মহসিন খাঁন কলেজ শাখার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক, বিজ্ঞান সংসদের দপ্তর সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন শাণিত মেধাবী নেতৃত্বের মধ্যে দিয়েই। ২৫, মার্চ’১৯৭১ এ রাত দ্বি-প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনতিবিলম্বে বন্দি হওয়ার সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে, রাত ১২ টার পূর্বেই টিএন্ডটি ও ইপিআর এর বেতারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া ঘোষণা, “This is may be my last message from today Bangladesh is independent. I call upon the people’s of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the Army of occupation the last. You fight must go on until the last soldier of Pakistan occupation army is expelled from the Soil of Bangladesh and final victory is achieved”..!

বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণায় শরীরে বয়ে যাওয়া রক্তে যখন প্রতিশোধ এর তীব্র জ্বালা দাউ দাউ করে জ্বলছিলো, শুরু করে দিলেন বোয়ালখালী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ডের এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান বারিক চৌধুরী গং সহকারে কালুরঘাটে দুনিয়া কাঁপানো গোলাগুলি তে লিপ্ত ছিলেন মহসিন খাঁন এর দল, গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুন, ডাক্তার জহিরুল হক তার চিকিৎসায় রক্তঘর্ম বিসর্জন দিতে থাকলেও, তখনো করলডেঙ্গা পাহাড়ে আশ্রিত ছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়া ও তার দল। অতঃপর রণকৌশল এর অংশ হিসেবে আনোয়ারা জুট মিলে আত্মগোপনে থাকা ত্যেজস্বী স্বাধীনতা পিপাসু মহসীন খাঁনেরা মীরসরাই হয়ে দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে ফেনি থেকে হানাদারদের বাধার মুখে আর এগুতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন বাড়ি। এসেই পেয়ে যান কিংবদন্তি নেতা এস.এম.ইউসুফ মহাশয়ের দিকনির্দেশনা সমেত চিরকুট। শুরু হলো আরেকটি অধ্যায়ের। একে একে সংগঠিত হতে থাকেন সার্জেন্ট মহি আলম, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান সহ বহর নিয়ে হুলাইনের রফিকের বাড়িতে জড়ো হন। অতঃপর নৌকা, সাম্পান, পায়ে হেঁটে চলতে থাকে শ্বাসরুদ্ধকর ভারত অভিযাত্রা। শ্রীনগর যখন পৌঁছে যান তখনও অনাহারে অর্ধাহারে প্রাণে বেঁচে থাকার পরেও বিচলিত না হয়ে হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছে সেই সেনা তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া, ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক মহসীন খাঁন কে কমিশন রেঙ্কে নির্বাচন, সদলবলে সফল প্রশিক্ষণ গ্রহণ, দেশপ্রেম এর অনিবার্য টানে লোভ লালসা কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেশে ফিরে এসে প্রাণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার কথা, ঐ ক্যাম্পে অবস্থানকারী অধ্যক্ষ নুর মোহাম্মদ, হাফেজ আহমেদ উল হক, এস.এম.ইউসুফ, ছাবের আহমদ আজগরী,আবু মোহাম্মদ হাসেম, মোক্তার আহমদ, এডভোকেট রফিক ও আবু ছালেহসহ মান্যগণ্য আওয়ামী লীগ নেতাদের কে না জানে, সেই সময়ে মহসিন খাঁন দের আত্মস্বার্থ বলীদানের এসব রূপ কথার মতন বাস্তবতার স্বরূপ ! স্বাধীনতার কিংবদন্তি মহসিন খাঁন ও সিএমএইচ সমাচার
১১০ জনের বিশাল গ্রুপের বহর, ছাবের আহমদ আজগরী সাহেবের স্নেহের পরশে পকেটে গুজে দেয়া দশ টাকার নোট টি কে সম্বল করে এতো বিড়াট বহরে নয় কেজি চাউল, কয়েক কেজি চিড়া কে পূজি করে ফিরে আসা চৌকস এই নেতার বিচক্ষণ অপারেশন দলের মারমুখো রণকৌশলে একে একে জিরি, আনোয়ারা থানা, ইন্দ্রপোল, বসরত নগর মাদ্রাসা, গৈড়লার টেক, রায়খালী, কালাইয়ার হাট রাজাকার ক্যাম্প, বাঁশখালী অপারেশন, বেঙ্গুরা রেল স্টেশন এছাড়াও কর্ণফুলী নদীতে পাক্ হায়েনাদের যুদ্ধ জাহাজ অপারেশন উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে কালাইয়ার হাট রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, বেঙ্গুরা রেল স্টেশন সহ বোয়ালখালী উপজেলার বেশ কয়েকটি অপারেশন এর লোমহর্ষক কাহিনী স্বয়ং বাবার মুখে শুনেছি। গাঁ শিউরে উঠে, বাবার কথা মনে পড়ে যায়, হৃদয়ের বাঁধ ভেঙে আটকে যায় কলম। থমকে যায় কালি, কেননা এই বাবার ভাগ্যে জোটে নি দীর্ঘ দিন ধরে পিটুইটারি মাইক্রো এডিনোমায় অসহ্য যন্ত্রণায় সরকারি কোনো সহযোগিতা। বাবা বিগত হয়েছেন গত বছর। বাবা কে নিয়ে স্বপ্ন জাগে অনেক, ইচ্ছে করে বাবার মতো নিজেকে বিলিয়ে দিতে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পদতলে। কিন্তু এরই আগেই পূর্ব সূত্রীয়দের থাবায় হাড্ডি-চামড়া শুদ্ধ নিলাম এ উঠার পালা। থাকুক নাই বা ইত্যবৎ জ্বালা।
মহসীন খাঁন মহাশয় যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পরম আকুতি জানিয়েও পেলেন না একটু সামরিক হাসপাতালে পরিচর্যার সুযোগ (!) তবে কোন গলায় বা বলি (?), আমি নিয়াজী-ভূট্টু’র নব্বই হাজার সেনা’কে লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া সেই বীরের সন্তান ? বীরের নামে ট্রাস্ট করার পরিণতি যে দেশে মিথ্যা মামলার কবলে পড়ে শংকায় কাটে দিন, যেখানে আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক, অসা¤প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার লড়াকু সৈনিক মহসিন খাঁনদের আকূতি সিএমএইচ থেকে বঞ্চিত হয়, যেখানে মৌলভী ছৈয়দ মহাশয়দের নাম ধরলে সন্ত্রাসী দিয়ে হামলায় আহত করা হয় শ্রেষ্ঠ সন্তান সহ প্রজন্ম দের, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা গণের রসদ সরবরাহ করতে গিয়ে পোস্ট মাস্টার কমরেড আহমদ হোসেন মহাশয়েরা আপাদমস্তক ফতুর হয়েও নিভৃতে ওকূল পাড়ি জমান অভিমন্যূ দের কাতারে, সেখানে মহসিন খাঁন মহাশয়’দের মহান আত্মার মাগফিরাত কামনা বিনা অন্যথা শুধুই অরণ্যে রোদন বৈ কী ! জয় হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ এর, জয় হোক বিশ্ব মানবতার। সমাজ বিনির্মাণ এর মূল প্রতিপাদ্য হউক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়..!!

লেখক: সার্জেন্ট (অব) পুলিশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম