স্বাধীনতার অঙ্গীকার হোক মুজিবাদর্শের দেশ গড়ার

37

স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা অর্জন এই পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাইতো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এই মহান পুরুষকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। জাতীয় দিবস পালনের লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের সন্তানদেরকে মুজিবীয় আদর্শে গড়ে তোলা। জাতির জনকের আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য একটি সুন্দর ও নিরাপদ আবাস ভূমি তৈরীর দায়িত্ব আমাদের। বঙ্গবন্ধু সব সময় শিশুদের সানিধ্যে এসে আনন্দিত হতেন। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপিত হয়। তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবের কোট পরে অবিকল বঙ্গবন্ধু সেজে রাজপথে শোভাযাত্রা। দেখে মনে হচ্ছিল জন্মদিনে রাজপথে একজন বঙ্গবন্ধু। সেই গানটি সাথে সাথে মনে পড়ে গেল- ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি- এমন সোনার দেশ।’ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক কর্মসূচির মধ্যে অটিজম আক্রান্ত বিশেষ শিশুদের আঁকা ছবি নিয়েও ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। এই সোনার বাংলার প্রতিটি শিশু যাতে সঠিক পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ এখন অটিজম বিষয়ে বিশে^ রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। শিশুকে শিশুর মত বড় করে তোলার দায়িত্ব মা-বাবার পাশাপাশি সরকারও এগিয়ে এসেছে। নিশ্চিত শিক্ষার জন্য শেখ হাসিনার সরকার বছরের প্রথমে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। প্রতি বছর দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করে। মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। ছেলে-মেয়েদের সুবিধার কথা চিন্তা করে বিদ্যালয়গুলোতে টিফিনের ব্যবস্থা করে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার নিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাউল, গম বিতড়ণের ব্যবস্থা করেন।
বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা তৈরি করতে হলে শৈশব থেকেই শিশুকে শিক্ষার একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। শিশুদের সানিধ্য বঙ্গবন্ধুকে সব সময় প্রশান্তি ও মুক্তি দিত। সুযোগ পেলেই তিনি শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন মিলন মেলায় ছুটে যেতেন। এই প্রসঙ্গে রোকনুজ্জামান দাদাভাই বলেন, ‘শিশুদের সব অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যেত। ১৯৭২ এর মার্চ মাসে গণভবনে ‘সুগন্ধায়’ ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আঁকা ছবিগুলো বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছিল। ছবি আঁকায় আমাদের শিশুদের পারদর্শিতায় তিনি বিমোহিত হয়েছিলেন।তিনি শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার উপর জোড় দেন। প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পুরোপুরি অবৈতনিক করে দিয়ে যান। শিশুদের সকল প্রকার অগ্রযাত্রাকে সহজ ও সুগম করার জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম শিশু আইন প্রণয়ন করেন। এখানে উল্লেখ্য, যখন তিনি বাংলাদেশে এই আইন প্রণয়ন করেন তখনও জাতিসংঘ শিশু আইন প্রণয়ন করেন নাই। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও নিরক্ষরবিহীন জাতি গড়ে তোলার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করছে । ইতিমধ্যে অনেক কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোকে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ব্যবস্থা নিয়েছেন। শিশুদের জন্য একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকছে। ১৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুর জীবন করো রঙ্গিন,’ এই প্রতিপাদ্যে সকল শিশুর সম অধিকার, নিরাপদ আবাস ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিশুদের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত সুনির্দিষ্ট চার (৪) টি পদক্ষেপ শিশুদের নিশ্চিত ভবিষ্যত নিশ্চিত করেছে। এক (১) শিশু কল্যাণের জন্য মায়েদের সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশু কল্যাণ অধিদপ্তর, দুই (২) শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু একাডেমি, তিন (৩) শিশু শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্তি করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ৩৭,০০০ (সাইত্রিশ হাজার) প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, চার (৪) ১৯৭৪ এর ২২ জুন শিশু আইন জারি করা। তারই পথ ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবৈতনিক শিক্ষার পাশাপাশি বছরের শুরুতে সারা দেশে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছেন, শিশুশ্রম বন্ধের জন্যে প্রয়োজনীয় আইনের পাশাপাশি দরিদ্রদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে আইন করেছেন। ১৯৭৯ -২০১৯ সাল অর্থাৎ ৫০ বছর দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল। এই প্রায় পঞ্চাশ (৫০) বছরে আমাদের রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। তাইতো বঙ্গবন্ধুকে জানতে ও জানাতে আমরা মুজিব বর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত নিই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারি সিদ্ধান্ত। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর আমাদের ইতিহাস অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের একটি বড় অংশ সঠিক ইতিহাস জানতে ব্যর্থ হয়। ইতিহাসের সঠিক তথ্যগুলো বিকৃত করে তাদের মাথার মগজ ধোলায় করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে ধর্মকে পুঁজি করে শিক্ষার্থীদের মানসিকতাকে পিছিয়ে নেওয়া হয়। তাইতো এক সময় এদেশে জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও অন্যান্য উন্নয়ন ধারাগুলো বার বার বাধা প্রাপ্ত হয়।
সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, কৃষি উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সঠিক সরবরাহ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা অনেক সফলতা অর্জন করে যাচ্ছি। বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ও টিভি চ্যানেলের ব্যাপক ব্যবহার, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত সাফল্য, আমাদের দেশে বাল্য বিবাহ রোধ,নারীদের ক্ষমতায়ন সামগ্রিক উন্নয়নকে বোঝাচ্ছে। তাছাড়া সারা বিশে^ আমাদের পোশাক শিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারার সুফল বোঝাচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে সময় ও ঝামেলা এড়াতে বিমান পথের ব্যাপক ব্যবহারও আমাদের সামগ্রীক উন্নয়ন বোঝায়। তবু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালে আমাদের কিছু কিছু প্রকট ব্যর্থতা প্রকাশ পায়। তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়নের জন্য একতার ও সুস্থ মনমানসিকতায় এগোতে হবে। বিশাল জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হচ্ছে নারী। কিন্তু আজো নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত হয়। আজো অনাহারে অর্ধাহারে নিজ শিশুবিক্রির খবর প্রকাশিত হয়। আজো খোলা আকাশের নিচে পাঠদানের তথ্য আসে।
নদী ভাঙ্গনে বাস্তুহারা মানুষের হাহাকার আমাদেরকে কষ্ট দেয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ শিক্ষায় আলোকিত হবে- এ কামনায় এগোতে হবে। আমাদের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে হবে। বর্তমানে আমাদের মুজিবীয় বর্ষে শুধু ইতিহাস ভিত্তিক গবেষণায় লিপ্ত না হয়ে বরং শেখ মুজিবের আদর্শে নিজেদের শুদ্ধতায় এগিয়ে আসতে হবে। এদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। চাকুরীর পিছনে না দৌঁড়িয়ে নিজেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে। চাকুরীর ক্ষেত্রে তৈরি করে গ্রামাঞ্চলের অনগ্রসর যুুব সমাজকে উৎপাদানমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। সব উন্নয়নের মূল শর্ত হচ্ছে শিক্ষা। তাই শিক্ষাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে সকলের জন্য শিক্ষা অর্জনের পথকে সুগম করতে হবে। যদিও আমরা আমাদের সোনালী আঁশের গর্ব কিছুটা হলেও হারিয়ে ফেলেছি, তবুও আমাদের রূপালী ইলিশ, শীতল পাটি, মৃৎশিল্প, স্বর্ণালি পোশাক শিল্প, দিন দিন আরো বেশি প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের শ্রম ও মেধা শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ১৭৩টি দেশে ১ কোটি ২৬ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধু সেটেলাইট স্থাপন এক অবিস্মরণীয় সাফল্য। তাছাড়া সমুদ্র বিজয়, মেট্রোরেল স্থাপন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন উন্নয়নের চিত্র। আজকাল বিভিন্ন কর্মসূচিতে শিশুদের ব্যবহার করে অনেকেই রাজনৈতিক ফয়দা লুটছে। যে কোন মানববন্ধন, সভা সমাবেশে ও প্রতিবাদ মিছিলে শিশুকে ব্যবহার করা কারো কাম্য নয়। ঠিক তেমনি এদেশের প্রতিটি নাগরিক যদি মুজিবীয় আদর্শকে ধারণ করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় তবে ইনশাল্লাহ আমাদের এই দেশ একদিন সোনার বাংলায় পরিণত হবে। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির হাত ধরে এখনো স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী হয়ে এদেশ ও জাতিয় ভাগ্যেন্নয়নে তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশংসনীয়। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার কার্যকরীর মাধ্যমে এদেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিতে চিহ্নিত করে এদেশকে কলঙ্কমুক্ত করার চেষ্টা করছে। একজন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসার আদর্শে এদেশে নারী উন্নয়নের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেছেন। নারীদের উপয্ক্তু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। নারীর যথার্থ ক্ষমতায়নের মাধ্যমে এদেশের নারীশক্তিকে দেশের উন্নয়নে সম-অধিকার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই মুজিবীয় বর্ষের প্রধান উদ্দেশ্য হোক- সকলের সমঅধিকার সমকর্ম ক্ষমতায় এদেশের গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়ন।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর,চট্টগ্রাম।