স্বস্তিতে শুরু ঈদযাত্রা

44

কোনো মহাসড়কে নেই যানজট, ঢাকার কাউন্টারগুলো থেকে সময়মতো ছাড়ছে বাস, তাৎক্ষণিক টিকেটও মিলছে-ঈদযাত্রার শুরুতে স্বস্তির কথাই জানালেন ঘরমুখো মানুষ। সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রীরা। ঈদ সামনে রেখে দ্বিতীয় মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু খুলে দেওয়ায় এতদিনের যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছেন তারা। তাদের পাশাপাশি ঢাকা থেকে সিলেটের যাত্রীদেরও বড় ভোগান্তির অবসান ঘটেছে কাঁচপুরে দ্বিতীয় শীতলক্ষ্য সেতু চালু হওয়ায়। কাঁচপুর পার হতে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত এখন সেখানে কয়েক মিনিটের এই পথ পেরিয়ে যেতে পারছেন তারা। ঈদের লম্বা ছুটি শুরুর আগে অফিস খোলা মাত্র একদিন, সোমবার। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওই দিনকেও ছুটির আওতায় এনে কর্মীদের ঈদে বাড়ি যাওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছে।
তাই শুক্রবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা।
ঈদের মওসুমে এবার রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি ভালো দাবি করে সড?ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এবারের ঈদযাত্রা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘স্বস্তিদায়ক’ হবে বলেই তার প্রত্যাশা।
সকালে রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল ও শ্যামলী এলাকায় বিভিন্ন বাস কাউন্টারে দেখা যায় ঈদযাত্রীদের বাস ধরার তোড়জোড়। তবে কোনো কাউন্টারেই যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ নেই। যারা আগাম টিকেট কেটেছেন এবং যারা সদ্য আসছেন তারাও যেতে পারছেন।
উত্তরবঙ্গের রুটের বাস কাউন্টারগুলোতে যাত্রীদের বেশ চাপ দেখা যায়। নওগাঁ ও রংপুরগামী শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের কর্মী রাকিব জানান, তাদের শুক্রবারের সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। শনিবারের টিকেট বিক্রি করছেন তারা।
সকালে গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা কেমন হচ্ছে, সে বিষয়ে ধারণা নেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে যশোর কুষ্টিয়া বাগেরহাট খুলনা বরিশাল পটুয়াখালী অঞ্চলের বাস কাউন্টারগুলোতে নির্বিঘেœ তাৎক্ষণিক টিকেট পেতে দেখা গেছে যাত্রীদের। ঈগল পরিবহন, হানিফ পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, গোল্ডেন লাইন পরিবহন, সাকুরা পরিবহন, সরকার ট্রাভেলসসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস চলে এসব জেলায়।
টেকনিক্যাল মোড়ে সরকার ট্রাভেলসের যাত্রী নুরুজ্জামান জানান, সকাল সাড়ে ৮টায় কাউন্টারে এসে ৯টার টিকেট পেয়েছেন। অন্য সময় ৩০০ টাকা ভাড়া নিলও এখন নিয়েছে সাড়ে চারশ টাকা। তবে যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ নেই, গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে যথাসময়ে।
বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে সরকার ট্রাভেলসের কাউন্টার কর্মী সুজন মাহমুদ বলেন, “সরকার নির্ধারিত ভাড়াই ৪২০ টাকা। অন্য সময় কম ভাড়া নেওয়া হলেও এখন সঠিক ভাড়াটাই নেওয়া হচ্ছে।” ঝিনাইদহগামী রয়েল পরিবহনের যাত্রী শফি জানান, সকালে এসেই তিনি তাৎক্ষণিক টিকেট কিনেছেন। তবে ভাড়া নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১০০ টাকা বেশি নিয়েছে। তাৎক্ষণিক টিকেটে বাড়তি ভাড়ার অভিযোগের পাশাপাশি অনলাইনে টিকেট কিনে কিছু টাকা গচ্ছা যাওয়ার কথা শুনিয়েছেন কেউ কেউ।
ড্যাফোডিল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অভি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, টিকেট নিয়ে ঝামেলার আশঙ্কায় তিনি পাঁচ দিন আগেই অনলাইনে টিকিট কেটে রেখেছিলেন। ৭৪ টাকা সার্ভিস চার্জসহ ৬৭৪ টাকায় তিনি টিকিট কেনেন। কাউন্টারে এসে দেখছেন ৪৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে টিকেট।
নিজে যেতে দুদিন দেরি হলেও স্ত্রীকে শুক্রবারই পাঠিয়ে দেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাহিদ হোসেন।
অনলাইনে টিকেট কেটে তিনিও প্রায় দুইশ টাকা গচ্ছা দেওয়ার দাবি করলেন।
“নওগাঁ রুটের ভাড়া সাধারণত ৪৫০ টাকা, অনলাইনে কেটেছি ৬৩০ টাকায়, সাথে রয়েছে ৭৪ টাকা ভ্যাট,” বলেন নাহিদ।
সায়েদাবাদ থেকেও স্বস্তিতে বাড়ির পথ ধরেছেন চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের যাত্রীরা। নতুন চালু হওয়া তিনটি সেতু পাল্টে দিয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্র। কাঁচপুরে দ্বিতীয় শীতলক্ষ্যা এবং দ্বিতীয় মেঘনা ও গোমতী সেতু চালু হওয়ায় এবার দেশের ব্যস্ততম এই মহাসড়কে নেই কোনো যানজট। ফলে সায়েদাবাদেও নেই বাসের সংকট।যাত্রীতে বাস ভরে গেলেই টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বাস। ঢাকা-সোনাপুর রুটে চলাচলকারী একুশে পরিবহনের ব্যবস্থাপক জহিরুল ইসলাম তারেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগে এই পথের যাত্রা ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। এখন তিনটি সেতু হওয়ায় মহাসড়কের চিত্র পুরোই পাল্টে গেছে।
“এমনও সময় গেছে সোনাপুর থেকে ঢাকায় আসতে ১৮ ঘণ্টা লেগেছে। আর জ্যাম না থাকলে একটা গাড়ি আসতে ৫-৬ ঘণ্টা লাগত। এখন কুমিল্লা বিশ্বরোড পার হওয়ার পর সর্বোচ্চ পৌনে দুই ঘণ্টা লাগছে।”
তিনি বলেন, “আগে ব্রিজ ছিল সিঙ্গেল লেইন। আর সড়ক ডাবল লেইন। এজন্য সব গাড়ি ব্রিজের গোড়ায় জমে যেত। আগে ফেনী থেকে ঢাকায় আসতে ৪-৫ ঘণ্টা লাগত। যানজট হলে ১২ ঘণ্টাও লাগত। কিন্তু এখন আড়াই ঘণ্টার বেশি লাগছে না।”
শুক্রবার ঈদে বাড়ি ফেরার প্রথম দিন ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ফেনী পর্যন্ত বাসে গিয়ে তাদের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে। ঢাকা-ফেনী রুটের একটি বাসে সায়েদাবাদ থেকে ফেনী পর্যন্ত গিয়ে কোথাও যানজটে পড়তে হয়নি।
সায়েদাবাদ থেকে দুপুর পৌনে ২টায় বাস যাত্রা শুরু করে। চিটাগাং রোড, কাঁচপুর সেতু পার হয়ে বেলা আড়াইটায় মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা পর্যন্ত চলে যায় বাস। বেলা পৌনে ৩টায় মেঘনা-গোমতী সেতু পার হয়ে বেলা ৩টা ২০ মিনিটে কুমিল্লার আলেখারচরে থামে এনা পরিবহনের বাসটি।
সেখানে ‘জমজম’ নামে একটি হোটেলে ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়। ওই হোটেলে বসে কথা হয় চট্টগ্রামগামী সৌদিয়া পরিবহনের যাত্রী নাজমুল হাসান মুন্নার সঙ্গে।
ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা মুন্না ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। তিনি বলেন, “খুব তাড়াতাড়ি চলে আসলাম। কোথাও যানজটে পড়িনি। ঈদের আগে আমাদের জার্নি সাধারণত এত নির্ঝঞ্চাট হয় না।
“কোথাও না কোথাও যানজটে আটকে থাকতেই হয়। বিশেষ করে মেঘনা আর দাউদকান্দি ব্রিজের কাছে সব সময়ই জ্যাম লাগত। নতুন ব্রিজ চালু হওয়ায় অবস্থা পাল্টে গেছে।” কুমিল্লা থেকে ছেড়ে বেলা সাড়ে ৪টায় ফেনীর মহিপাল পৌঁছায় বাসটি।
মেঘনা সেতুর টোল প্লাজায় লেগে থাকত যানবাহনের দীর্ঘ সারি, দ্বিতীয় মেঘনা সেতু চালুর পর টোল প্লাজায় আর কাউকে দাঁড়াতে হয় না।
মেঘনা সেতুর টোল প্লাজায় লেগে থাকত যানবাহনের দীর্ঘ সারি, দ্বিতীয় মেঘনা সেতু চালুর পর টোল প্লাজায় আর কাউকে দাঁড়াতে হয় না। আগে মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা, দাউদকান্দি, গৌরীপুর, মাধাইয়া বাজার, চান্দিনা, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডে যানজটে আটকে থাকতে হত যানবাহনকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করায় এসব জায়গায়ও যানজটে পড়তে হয়নি। এছাড়া কুমিল্লা ও ফেনীতে দুটি রেল ওভারপাস হওয়ায় সেখানেও যানবাহনকে আটকে থাকতে হচ্ছে না।
এই বাসে সহযাত্রী মোহাম্মদ জিয়াউর রহমানের বাড়ি ফেনীর ফরহাদ নগরে। ব্যবসা করেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি।
জিয়াউর বলেন, “বাড়ি গিয়ে আবার সময়মতো ফিরতে পারবেন কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু এখন প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাই।
“আগে কাঁচপুর ব্রিজ পার হতেই এক ঘণ্টা লেগে যেত। আজ তো তিন মিনিটেই পারে হয়ে গেলাম। আগের সঙ্গে এখনকার আকাশ পাতাল পার্থক্য।”
ফেনী পৌঁছে কথা হয় স্টার লাইন পরিবহনের চালক সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, অনলাইনে টোল দেওয়ার সুবিধা থাকায় সময় অনেক সাশ্রয় হয়েছে। এটাও যানজট কমিয়েছে।

“আগে তো টোল দেওয়ার লাগি লাইন পড়ি যাইত। অহন আমরা তো গাড়ি নিয়া টোল প্লাজার সামনে খাড়াই না। সোজা চইলা যাই। ট্রাকের লগে পাড়াপাড়ি করা লাগে না।”
এবার ঈদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে করছেন হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের এসপি মো. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “এতদিন যানজট ছিল মেঘনা সেতুকেন্দ্রিক। ব্রিজগুলো ওপেন হওয়ার পর আমাদের এই অংশে জ্যাম হচ্ছে না। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। সবগুলো বাজার এবং মোড়ে আমাদের লোক নিয়োগ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে দ্রæত সমাধান করতে পারব আশা করি।”
শুক্রবার যানজট ছিল না ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও। অনেকটাই স্বভাবিক গতিতে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। সকালের দিকে মহাসড়কে গাড়ির চাপ থাকলেও তা যানজটে রূপ নেয়নি।