স্থানীয়রাও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে

92

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদর এইচআইভি-এইডস’র পাশাপাশি এবার কলেরা রোগের জীবাণু শনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গত দুই মাসে প্রায় সাড়ে তিনশ রোহিঙ্গার মধ্যে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। এজন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ঘিঞ্জি পরিবেশে বসতিকে দায়ী করছেন ক্যাম্পের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত দুই মাসে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে প্রায় সাড়ে চারশ মানুষের মধ্যে কলেরার জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে সাড়ে তিনশ রোহিঙ্গা।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরাণার্থী শিবিরে দিন দিন কলেরা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত দুই মাসে তিন শতাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে কলেরা রোগের জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রাহিঙ্গারা জলাশয় ও পাহাড়ি ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে ব্যবহার করায় কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাছড়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলো বিভিন্ন গ্রামের পাশপাশি হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যেও এ রোগ ছড়াচ্ছে।’
কলেরা যাতে না ছড়ায়, তাই ৮ ডিসেম্বর থেকে টিকা প্রদান করা হবে বলে জানান সিভিল সার্জন।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) বাংলাদেশের একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যা বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪ রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ গত দুই মাসে উখিয়া-টেকনাফে সাড়ে চার শতাধিক লোকের মধ্যে কলেরা রোগের জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য লেদা শরাণার্থী শিবিরের একটি ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টার রয়েছে আইসিডিডিআরবি’র। তারা রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের নিয়ে কাজ করছেন। তাদের আরেকটি ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টার রয়েছে টেকনাফে। তবে সেখানে রোহিঙ্গা রোগী আসলে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়।
এ দুই সেন্টারে গত দুই মাসে প্রায় দেড় হাজার ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই শতাধিক কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। শুধু লেদা ডায়রিয়া সেন্টারে চলতি মাসের ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৮’শ জন ডায়রিয়া রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শতাধিকের কাছ থেকে কলেরা জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া টেকনাফ সেন্টারে ৩০ জন, বাকিগুলো শালবাগান ও উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের। এর মধ্যে ৫ বছরের নিচে ৭’শ জন শিশু এ রোগে আক্রান্ত।
আইসিডিডিআরবি’র লেদা শরাণার্থী শিবিরের ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারের চিকিৎসক ডা. জাকারিয়া সেলিম ঈমন বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা সেদেশে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। এ কারণে তারা নানা রোগে আক্রান্ত’।
তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগই অস্ব্যাস্থকর পরিবেশ ও খাবার থেকে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মানসম্মত খবার ও বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। না হলে এ রোগ সব শিবিরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া স্থানীয়দের বসতি একই পরিবেশে হওয়ায় তাদের মাঝেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।’
টেকনাফ উপজেলা স্ব্যাস্থা কর্মকর্তা ডা. সুমন বড়ূয়া বলেন, ‘প্রতিদিন রোহিঙ্গা শিবির থেকে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়ার খবর আসছে। এনজিওসহ পাঁচটি টিম সেখানে কাজ করছে। এ রোগের সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সেভাবে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে।’
এ চিকিৎসক বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেসব পানি ব্যবহার করছে, সেটি বিশুদ্ধ ও নিরাপদ হতে হবে, না হলে এ রোগ বাড়বে। পাশপাশি রোহিঙ্গাদের নিরপদ খাবার খেতে হবে এবং অস্ব্যাস্থকর পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে।’
স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ অপুষ্টির শিকার। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে অপুষ্টির শিকার বেশির ভাগই রোহিঙ্গা শিশু। তাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, আইসিডিডিআরবি লেদা ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারে বেশিকিছু রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে আসেন। এ সময় চার জনের কাছে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। সেখানেই কথা হয় রাখাইনের হাদুরছড়া থেকে পালিয়ে আসা জাহেদা বেগম এর সঙ্গে। লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ই-বøকে স্বামী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন তিনি।
জাহেদা বলেন, ‘একটি ছোট ঝুপড়িতে সাত জনকে থাকতে হচ্ছে। বেশকিছু দিন ধরে খাবার পানি সংকট। যে টয়লেট রয়েছে সেটিও নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর থেকে পরিবারে দু’জনের ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে।’
এক বছরের শিশু সন্তান সোহেলকে নিয়ে ডায়রিয়া সেন্টারে আসেন হাসিনা বেগম (২৫) নামে রোহিঙ্গা নারী। তিনি বলেন, ‘গত দু’দিন ধরে বাচ্চার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। ফলে এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি। তবে আগের তুলনায় ছেলের অবস্থা উন্নতি হয়েছে।’
দীর্ঘদিন পর রোহিঙ্গাদের কারণে এ অঞ্চলে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ স্ব্যাস্থা বিভাগের চিকিৎসক টিটু চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অর্ধশতাধিক রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। তার মধ্যে অর্ধেক রোহিঙ্গা।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়দের মাঝে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া এদের অধিকাংশই সর্দি, জ্বর, কাশি, ম্যালেরিয়া, ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এসব রোগীর ৭০ ভাগই শিশু। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ‘৮ ডিসেম্বর থেকে কলেরা টিকা দেওয়া শুরু হবে। এবার কক্সবাজারের ৪ লাখ ৯২ হাজার স্থানীয় জনগণ ও দেড় লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে এ টিকা দেওয়া হবে। এর আগে গত বছরে নভেম্বরের মাঝামাঝি চতুর্থ রাউন্ডে উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি রোহিঙ্গাক্যাম্পে কলেরা টিকা খাওয়ানো হয়। তখন এ টিকা পেয়েছেন ২ লাখ ২৪ হাজার ৯৫১ জন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশে অবস্থিত ১ লাখ ৩ হাজার ৬০৫ জন স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও এ টিকা খাওয়ানো হয়।’