স্টল বরাদ্দে স্বজনপ্রীতি অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ

59

নগরীর এম.এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম মাঠে চলছে অমর একুশে বইমেলা। গত ১০ ফেব্রæয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা শুরু হলেও এখনও বেচাকেনা জমে উঠেনি।
এবার বইমেলার আয়োজন নিয়ে আয়োজক কমিটির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টরা নানা ধরনের অভিযোগ তুলেছেন। মেলার স্টলগুলো নির্মাণের সময় সামনের দিকে বেশি স্থান রেখে পেছনের গলিকে সরু রাখা হয়েছে। লটারির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দের কথা বলা হলেও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়েছেন আয়োজকরা। মেলায় সামনের দিকে বড় জায়গায় স্টল পেয়েছেন কমিটির নেতারা আর পেছনে চিপাগলিতে ফেলেছেন কমিটির ‘অপছন্দের’ প্রকাশকদের। এছাড়াও স্টলগুলোতে নির্দিষ্ট সাইনবোর্ডে ধারাবাহিকভাবে স্টল নম্বর লেখা হয়নি। এতে স্টল চেনাও পাঠকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বজনপ্রীতি আর নানা অব্যবস্থাপনার কারণে মেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এসব ব্যাপারে বইমেলা কমিটির আহবায়ক ও কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক পূর্বদেশকে বলেন, মেলায় ঢুকার পথ ও মাঝখানে রাস্তা প্রশস্ত রাখা হয়েছে কিন্তু পেছনে ছোট রাখা হয়েছে বিষয়টি আমি দেখেছি। ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার হোসেন কাজটি করেছেন। তিনি আমাকে প্রবেশের পথ একটু বড় রাখার পরামর্শ দেয়াতে আমরা ওভাবে কাজটা করেছি।
স্টল বরাদ্দে স্বজনপ্রীতির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযোগ তুলতেই পারে। আমরা লটারির মাধ্যমে দোকান দিয়েছি, যারটা যেভাবে পড়ছে সেভাবে স্টল দেয়া হয়েছে।
তাহলে প্রথমদিকের স্টলগুলো সব কমিটির লোকজনই কিভাবে পেয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে যারা বড় প্রকাশনা আছে এবং আগে থেকে আমাদের সাথে মেলা করে আসছে বলে তাদেরকে একটু সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যেটি সব জায়গায় দেয়া হয়।
স্টলে ক্রমিক নম্বরের ব্যাপারে তিনি বলেন, ক্রমিক নম্বর কোনটিতে দেয়া হয়েছে আর কোনটিতে দেয়া হয়নি তা আমি এখনো দেখিনি। আমি সরাসরি দেখে সে ব্যাপারে কি করা যায় দেখব।
গতকাল বিকালে মেলায় ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মেলা শুরু হওয়ার পর তিনদিন কেটে গেছে। দর্শনার্থী আসলেও বই বিক্রি হচ্ছে না এবং স্টল বরাদ্দে স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি বৈষম্য নেতাদের প্রাধান্য, স্টল ছোট এবং অতিরিক্ত টাকা নির্ধারণ, স্টলের সামনে ক্রমিক নম্বর না থাকা, পেছনের যাতায়াতের পথ প্রশস্ত না করে সরু করা, নির্দিষ্ট প্রকাশনীর বাইরে অন্য প্রকাশনীর বই রাখাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে মেলা কমিটির বিরুদ্ধে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রকাশনীর মালিকরা বলেছেন, এত অনিয়মের মধ্যে আমরা কোণঠাসা হয়ে আছি। এটা নিশ্চিত যে, আমরা লাভের মুখ দেখব না। শতকরা ৫ ভাগ স্টল মালিক লাভ করবেন বাকিরা লোকসান নিয়ে ফিরবেন।
আয়োজকরা বলছেন, মেলা কমিটির সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে। এখানে বৈষম্যের সুযোগ নেই। কারো কোন অভিযোগ থাকলে আমাদের অভিযোগ করতে পারবেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেলার মূল ফটক দিয়ে ঢুকার পর কয়েকটি নাম করা প্রকাশনীর স্টল দেখা যায়। সামনে চলাচলের জন্য প্রশস্ত জায়গা থাকলেও শেষের গলিটা ছিল সরু। সেখানে দর্শনার্থীর আনাগোনাও কম দেখা গেছে। পুরো মেলাজুড়ে লটারির মাধ্যমে স্টলগুলো বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও এখানে স্বজনপ্রীতি ও মেলা কমিটির সদস্যদের সামনের স্টলগুলো পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন পেছনের স্টলগুলো। আবার স্টলগুলোতে সঠিক ক্রমিক নম্বর সাইনবোর্ডে লিখা হয়নি। কয়েকটি স্টল পর পর স্টল নম্বর দেখা গেছে। অনেক স্টলে শুধু প্রকাশনীর নাম ছিল তবে স্টল নম্বর ছিল না ।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন স্টল মালিক পূর্বদেশকে জানান, বইমেলার পরিসর গতবারের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু স্টলের সাইজ ছোট করে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে সিঙ্গেল স্টলের ভাড়া হচ্ছে ২ হাজার টাকা আর পাশাপাশি ডাবল স্টলের ভাড়া ৭ হাজার টাকা হবে কেনো? এটা অতিরিক্ত নয় কি? তাছাড়াও প্রতিবারের মেলায় ইসলামি বইয়ের স্টল রাখা হলেও এবারের মেলায় কোন ইসলামি বইয়ের স্টল রাখা হয়নি। গতবারের মেলায় ১০টি ইসলামি বইয়ের স্টল ছিল। এমনকি বর্তমানে বই তো দূরের কথা কোন স্টল মালিকদের ইসলামি কোন বইও বিক্রি করতে দেয়া হচ্ছে না।
তারা আরও বলেন, মেলায় নিজের প্রকাশনার বই ব্যতিত অন্য প্রকাশনার বই না রাখার নির্দেশনা থাকলেও মেলা কমিটির সামনে আবির ও বঙ্গজ প্রকাশনাসহ কয়েকটি প্রকাশনীর স্টল অন্য প্রকাশনার বই বিক্রি করছে।
বই বিক্রি না হওয়ার ক্ষোভ নিয়ে বিদ্যা প্রকাশনীর মোতালেব বলেন, সামনের দিকে ক্রেতারা এসে বই কিনে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা পেছনে থাকাতে বেশিরভাগ দর্শনার্থী এদিকে না এসেই চলে যাচ্ছে।
হাসি প্রকাশনের সজল মাহমুদ বলেন, তিনদিনে বই বিক্রি হয়েছে মাত্র ৯০০ টাকার অথচ দৈনিক খরচ হচ্ছে এক হাজার টাকারও বেশি। অনেক আশা নিয়ে ৫ লাখ টাকার বই নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছি। লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ফিরে যেতে হবে। অন্য প্রকাশনীর বই রাখার অনুমতিও নেই, ওটা থাকলেও অন্তত লাভের আশা দেখতাম।
মহাকাল প্রকাশনীর সাদি বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বইমেলার মধ্যে ইসলামি বই রাখার অনুমতি দেন। কিন্তু কোন স্টলে ইসলামি বই রাখতে দিচ্ছেন না মেলা কমিটি। ইসলামি বই না রাখলে তো মেলা জমবে না। তাই আমি মনেকরি গতবারের মেলার তুলনায় এবারের মেলা খুবই খারাপ হবে।
শিকড় প্রকাশনীর মো. সজীব বলেন, প্রচার প্রচারণার অভাবে দর্শনার্থী কম। সুতরাং ক্রেতাও কম।
দাঁড়িকমা ও জনতা প্রকাশনার স্টলে বঙ্গবন্ধু নিয়ে কয়েকটি বই বিক্রি হয়েছে বলে জানালেন মামুন।
ইতিহাসের খসড়া প্রকাশনীর মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, মোটামুটি দর্শক আসছে এবং বই কিনছে। কাল (শুক্রবার) আরও ভাল বিক্রি হবে আশা করছি।
দর্শনার্থী মিজানুর রহমান বলেন, মেলা দেখতে এসেছি এবং কিছু বই কিনলাম। মেলা উপলক্ষে সিটি কর্পোরেশনের উচিত আরও প্রচার প্রচারণা বাড়ানো। আমরা কাজির দেউড়ীতে কয়েকজন ঘুরতে এসে দেখলাম বই মেলা হচ্ছে তাই এদিকে ঢুঁ মারা। মেলার আগে যথাযথ প্রচারণা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
মেলা কমিটির সদস্য বলাকা প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী জামাল উদ্দিনের কাছে নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে গতকাল ফোন করা হলে তিনি মেলায় দেখা করতে বলে মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।
মেলা উপ কমিটির সাংস্কৃতিক আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ বলেন, পুরো মেলা জুড়ে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলামি মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের কোন স্টল দেয়া হয়নি এবং তাদের বইও আমরা রাখতে দিচ্ছি না। আমরা যা কিছু করছি সবার সাথে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজগুলো করছি। তাছাড়া কারও কোন অভিযোগ থাকলে আমাদের রিপোর্টিং বই এবং অভিযোগ দেয়ার ব্যবস্থা আছে। স্টল মালিকরা আমাদেরকে জানালে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।